অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০৫:০৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

টার্গেট কি চৌর্যবৃত্তি, না ব্যক্তিবিশেষ

টার্গেট কি চৌর্যবৃত্তি, না ব্যক্তিবিশেষ

সম্পাদনা যিনি করেন তিনিই সম্পাদক। নিঃসন্দেহে তার দায় সবচেয়ে বেশি; কিন্তু পর্ষদে যে বা যারা থাকেন তারাও কি কম দায়ী? তা ছাড়া অপরাধ ও অপরাধী চিহ্নিত করাটাও জরুরি বৈকি। সপ্তম শ্রেণির একটি পাঠ্যবই নিয়ে তোলপাড় হওয়া দেশে এগুলো এখন বড় বিষয় নয়। পাঠ্যপুস্তকে ভুল ছিল কিনা, সেটিও বড় কথা নয়। কপি করে দুর্বল ইংরেজি তর্জমা চালিয়ে দেওয়া নিয়েই উত্তপ্ত সমাজ। দেশ ও দেশের বাইরে চলছে বাকযুদ্ধ।

কী ঘটেছে বা এমন বড় একটা ভুল কীভাবে হলো সেটি জানা যতটা দরকারি, তার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ব্যক্তিবিরোধিতা। এই ব্যক্তিটি দেশ ও জাতির অতি পরিচিত একদা মধ্যপন্থিদের নয়নমণি, বহুল জনপ্রিয় দৈনিকের নিয়মিত লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। যখন থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও সরকারের পক্ষে গণজাগরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখলেন, তখন থেকে তিনি এক ধরনের হুমকির মুখে।

এসব বিষয় বলার আগে দেখে নেওয়া যাক ক্যালিফোর্নিয়া নিবাসী বাংলাদেশি গবেষক নাদিম মাহমুদ কী লিখে এমন বিস্ফোরণ ঘটালেন : অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে পাঠ্যপুস্তকটি পড়া শুরু করেছিলাম। দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ, লেখকদের সম্পাদনায় প্রকাশিত বইটি হাতে পাওয়ার পর সত্যি এক ধরনের অস্বস্তিবোধ কাজ করছে। শুরুতে যেভাবে লাইন টু লাইন অনলাইন ওয়েবসাইট থেকে কপি করে বাংলা অনুবাদ করেছে, সেটি দেখার পর মনে হয়েছে, আমরা ঠিক কোন শিক্ষাব্যবস্থা কোমলমতি শিশুদের সামনে তুলে ধরতে যাচ্ছি? আমার চোখ যতগুলো পৃষ্ঠা নজর দিয়েছে, তার অংশ এভাবে গুগল ট্রান্সলেটরে ভাষান্তর করা হয়েছে। আমরা হয়তো ভুলে গেছি, গুগল আমাদের বাংলা ভাষার ভাষান্তর এখনো সঠিকভাবে দিতে পারে না। ভুলভাল ইংরেজিতে বাংলার ভাষান্তর হয়, সেটি সম্ভবত লেখকরা ভুলে গেছেন।

একজন গবেষক হিসেবে পাঠ্যপুস্তকের এমন চৌর্যবৃত্তি আমি অন্তত কামনা করতে পারি না। এটিকে আমরা একাডেমিক ভাষায় প্লেইজারিজম বলি, যা গুরুতর অপরাধ বটে। আমি ঠিক জানি না কারা, কীভাবে এ বইটি লিখেছেন? তবে এটুকু নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, যে সময় ও শ্রম দিয়ে বইটি লেখার প্রয়োজন, যে টপিকগুলো তুলে ধরা প্রয়োজন, তা এই পরীক্ষামূলক সংস্করণে ব্যর্থ হয়েছে।

আমাদের দেশের এ পাঠ্যপুস্তকের লেখকরা এমনভাবে লেখাটি লিখেছেন, তাতে মনে হবে, এসব তথ্য নিজেরা এক্সপেরিমেন্ট, জরিপ করে পেয়েছেন আর তার আলোকে লিখেছেন; কিন্তু বাস্তবে তা ভিন্ন। বরং নিজেদের মেধা ব্যবহার না করে ‘পরের ধনে পোদ্দারি’ করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা কখনোই শোভনীয় নয়।

নাদিমের অভিযোগের তীর যেদিকে যাক না কেন, শিকারি তার শিকার পেয়ে গেছে। বহুদিন ধরেই তারুণ্যকে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা এবার যদি হালে পানি পায়। এই ভেবে সদলবলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে জাফর ইকবাল স্যারের ওপর। টিভি খুললেই দেখি বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষভাবে অজ্ঞ মানুষও বিশেষজ্ঞের মত দিচ্ছে। যেন তিনি এই দেখে এসেছেন মঙ্গল গ্রহ। তার চোখে দেখা এর রং ঠিক লাল নয়, অন্য কিছু। পারেও বটে।

যে দেশে শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, শিশু বলাৎকার চলে, সেই সমাজে একটি শিশুর ছবি ছাপার নৈতিকতা এত বড় হয়ে উঠতে পারে, জানা ছিল না। ঘটনাগুলো বারবার বলতে চাই না। দরকারও নেই। মূল কথা যেটি, এই যে জাফর ইকবাল স্যার দুঃখ প্রকাশ করলেন, মাফ চাইলেন—এমন ঘটনা কি সচরাচর দেখি আমরা? বাস, ট্রেন, লঞ্চ, জাহাজে কত কিছু ঘটে, মানুষ নাই হয়ে যায়, খুন, জখম, ডাকাতি, ব্যাংক লুটপাট রোজকার ঘটনা, কেউ কোনোদিন দোষ স্বীকার করে? মাফ চায়? শুনিনি তো। জাফর ইকবাল বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন। ক্ষমা চেয়েছেন। এরপর কথা থাকে না।

এটা সত্যি, অপরাধ বেশ জোরালো। শিশু পাঠ্যবইয়ে এমন জুয়াচুরি অনভিপ্রেত, যে বা যারা করেছে তাদের সাজা হওয়া উচিত। এমন চুরি বা কুম্ভিলকবৃত্তি যেন আর না হয়। এমনিতেই শিক্ষার বারোটা বাজতে দেরি নেই। সাম্প্রদায়িকতার শিকড় হয়ে উঠেছে পাঠ্যক্রম। যারা এখন এ ভুল নিয়ে সমাজ মাথায় তুললেন—তারা কি ভুলে গেছেন লেখক আনিসুল হককে কটাক্ষ করে সাধারণ মানের লেখক বলে শিশু-কিশোর মনে যে বিষ ঢোকানোর অপচেষ্টা, তখন তো নীরব ছিলেন আপনারা।

এখন এই হট্টগোলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের নামে যারা জাফর ইকবালের ইমেজ নষ্ট করতে নেমেছেন, তাদের মনে হয় চিনি। আপনাদের মূল রাগ তিনি জামায়াতবিরোধী। তার লেখায় তারুণ্য মুক্তিযুদ্ধ চেনে। দেশপ্রেম খুঁজে পায়। তার এ ভূমিকার জন্য তাকে খুন করারও অপচেষ্টা হয়েছিল। ভাগ্য জোরে বেঁচে যাওয়া মানুষটিকে অপমান করলে যদি মরে বা সরে যায়—এই হয়তো গোপন চাওয়া।

বইটির পরিবর্তন হবে। বিষয় ঠিকভাবে পরিবেশন করা হবে। লেখকও বাদ যাবেন; কিন্তু সমাজের এক পচে-গলে যাওয়া অংশের বিকৃতি যাবে না। আমি কোনোভাবেই জাফর ইকবালের দায় নেই বলছি না। বরং এমন অবহেলা বা উদাসীনতা কিংবা ব্যর্থতার উপযুক্ত উত্তর দিতে হবে তাকে। তাকে সতর্ক করার বিধান থাকলে সেটিও করা উচিত; কিন্তু এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে চামড়া খোলা সমর্থন করি না।

জাফর ইকবাল বহুজনের ভেতর এক ও অনন্য। তার সব কীর্তি বা অর্জন এ কারণে মুছে যাবে না। একজন জাফর ইকবাল একটি সমাজের গুণী ও কৃতকার্য মানুষের নাম। তার অসম্মান ও নিন্দায় লাভের বদলে ক্ষতিই বেশি।

ঘটনার তদন্ত ও প্রতিকার চাই। শিশুদের কাছে সবার নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার জোর আহ্বান রাখি। সঙ্গে জাফর ইকবালের ওপর অন্যায্য আক্রমণ ও গালাগাল বন্ধ হোক, এটাও আশা করি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। সিডনি প্রবাসী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নিমিষেই তাদের বিসিএসের স্বপ্নভঙ্গ

পঞ্চগড়ে হিটস্ট্রোকে প্রাইভেটকার চালকের মৃত্যু

ফিলিস্তিন ইস্যুর স্থায়ী সমাধান চায় চীন

প্রেমিকার শোক সইতে না পেরে প্রেমিকের আত্মহত্যা

বাজে আম্পায়ারিংয়ের শিকার মুশফিক বললেন মাশাআল্লাহ

মার্কিন চাপকে পাত্তাই দিল না ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা

সমাবর্তনের অজুহাতে শিক্ষার্থীদের সনদ আটকে না রাখার নির্দেশ

তেঁতুলিয়ায় নেমে গেছে পানির স্তর, চরম সংকটে কয়েক গ্রামবাসী

বিএনপি দিনের আলোতে রাতের অন্ধকার দেখে : ওবায়দুল কাদের

উষ্ণতম এপ্রিলে পুড়ছে দেশ, কবে আসবে স্বস্তির বৃষ্টি

১০

জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি

১১

দাঁড়িয়ে থাকা কাভার্ডভ্যানে অটোরিকশার ধাক্কা, নিহত ১

১২

কুয়াকাটায় কাঁদতে কাঁদতে ইসতিসকার নামাজ আদায়  

১৩

কোপায় বিশ্বজয়ী আর্জেন্টাইনকে নিয়ে শঙ্কা

১৪

চলতি বছরই থাইল্যান্ডের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি হবে : শেখ হাসিনা

১৫

গরমে স্মার্টফোন বিস্ফোরণ এড়াবেন যেভাবে

১৬

থাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক

১৭

ভোলায় দ্বিতীয়বার বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ আদায়

১৮

ইপিএলে সর্বোচ্চ গোলের নতুন রেকর্ড

১৯

তীব্র গরমে বেড়েছে রিচার্জেবল ফ্যানের চাহিদা 

২০
*/ ?>
X