মেজর (অব.) ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৪, ০৩:০১ এএম
আপডেট : ২০ মে ২০২৪, ০৭:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

লু তুমি কার?

লু তুমি কার?

অপ্রিয় হলেও এ কথা সত্য যে, ৫৪ বছর আগে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হোক, সেদিনের যুক্তরাষ্ট্র সরকার তা চায়নি। একদিকে জাতিসংঘে চাপ প্রয়োগ, অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে সহায়তা, সর্বোপরি বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান।

তারপরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি সত্তরের দশকের মার্কিন প্রশাসন। সে সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলতেও দ্বিধা করেননি। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের নেপথ্যে ছিল খোঁড়া অজুহাতে শেষমুহূর্তে প্রতিশ্রুত গমভর্তি মার্কিন জাহাজ বাংলাদেশে আসতে না দেওয়া, যা বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছিল। একাধিক প্রামাণ্য দলিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার নেপথ্যে মার্কিন যোগসাজশ খুঁজে পেয়েছে। সুতরাং ঐতিহাসিক কারণে বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের কাছে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পরীক্ষিত বন্ধু নয় বলে অনেকের কাছে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তথাপি বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতির আদর্শ তথা ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’—এ চেতনাকে ধারণ করে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই পাড়ি দিয়েছে প্রায় অর্ধশতক।

এই অর্ধশতকে বাংলাদেশের উন্নতির নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান অবশ্যই উল্লেখ করার মতো। বিশেষত প্রযুক্তি এবং জ্বালানি খাতে মার্কিন বিনিয়োগ এবং মার্কিন সহায়তা বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আসতে অনেক সাহায্য করেছে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য ‘পোশাক শিল্প’ অনেকখানি মার্কিন বাজারমুখী। জাতিসংঘে বাংলাদেশের আজকের অবস্থান বিশেষত শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশিদের দাপট মার্কিন প্রশিক্ষণ এবং সমর্থনের কাছে ঋণী। সার্বিক বিচারে বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রযাত্রার নেপথ্যে মার্কিন অবদানকে কোনোক্রমেই খাটো করে দেখার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।

তবে একবিংশ শতকে এসে দৃশ্যপট যেন বদলাতে শুরু করল। এ শতকে বাংলাদেশে পাঁচটি সাধারণ নির্বাচন হয়, যার প্রথমটিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং পরবর্তী চারটিতে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা জয়লাভ করেন। নিকট অতীতের প্রায় দেড় দশকের পথ চলায় বাংলাদেশ চীন, ভারত এবং রাশিয়াকে ঋণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে কাছে পেয়েছে। অন্যদিকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, বিশেষত অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এবং সুনির্দিষ্টভাবে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ওয়াশিংটনের শীতল সম্পর্ক প্রায়ই আলোচনায় আসে।

যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশে ব্যক্তি, বাহিনী ও সংস্থার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে অবরোধ আরোপ করে, তখন বাংলাদেশও সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মার্কিন মুল্লুকে না গেলেও চলবে বলে পাল্টা জবাব দেয়। সেইসঙ্গে মার্কিন ডলারের বদলে রাশিয়া, চীন ও ভারতের মুদ্রায় বহুপক্ষীয় ব্যবসার পথ প্রশস্ত করে। ফলে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মার্কিনিদের নির্ধারণ করা মানদণ্ড অনুসারে না হলে বাংলাদেশের ওপর আকাশ ভেঙে পড়বে বলে অনেকেরই ধারণা জন্মায়। অনেক মার্কিনি কূটনীতিবিদের শারীরিক ভাষাও সেরকম ইঙ্গিত দিচ্ছিল। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ছিলেন তেমনি একজন মার্কিন কূটনীতিবিদ। তবে শেষ বিচারে বাংলাদেশ বাংলাদেশের মতোই নির্বাচন করেছে, যা মার্কিনিরা বলা যায় নীরবেই সয়ে গেছে।

এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের নেক নজর পেতে কোন দল কত টাকা লবিস্টের পেছনে ব্যয় করেছে, সে নিয়ে নানা পর্যায় আলোচনা হতো। লু কী বার্তা নিয়ে আসছেন, কী বলছেন, কার সঙ্গে বৈঠক করছেন—এ নিয়ে ব্যস্ত থাকত সব গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ২০২৩ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি ডোনাল্ড লু ঢাকায় এসেছিলেন। সে সময়কার পত্রপত্রিকার বিশ্লেষণে উত্তপ্ত করে তুলেছিল ঢাকার আকাশ বাতাস। মার্কিন ফর্মুলায় নির্বাচন না হলে শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ, এমনকি বাংলাদেশের কী হবে—তা ভেবেও চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল অনেকের কপালে।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল। কেমন হয়েছে এ নিয়ে বহু মত থাকতে পারে। তবে আমেরিকার ফর্মুলা মতো যে হয়নি, তা বলাই যায়। এ নির্বাচনের আগের ও পরের দৃশ্যপট দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না বাংলাদেশের সরকারবিরোধী শিবির। মার্কিন প্রশাসন বিশেষত ডোনাল্ড লুকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন ছিল তাদের। পাকিস্তানের ক্ষমতার পটপরিবর্তন, নেপালকে মিলিনিয়াম চ্যালেঞ্জ কো-অপারেশন (এমসিসি) চুক্তির মাধ্যমে আবদ্ধ করা, শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকট প্রভৃতির নেপথ্যে ডোনাল্ড লুকে খুঁজে পেয়েছিল নিউজ পোর্টাল মডার্ন ডিপ্লোম্যাসি (তারিখ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৩)। তাই এমন প্রত্যাশা করাটাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল।

এবারের বাস্তবতায় দেখা যায়, লু কারও আমন্ত্রণে ঢাকায় আসেননি, বরং নিজ আগ্রহে এবং মার্কিন স্বার্থে বাংলাদেশে এসেছেন। তার আগমন ঘিরে কোন দলের আগ্রহ বা উচ্ছ্বাস বেশি, তা নিয়ে চলছে বাগযুদ্ধ।

বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিচারে খারাপ সময় পার করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের বর্বরতার প্রশ্নে নিজ দেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে এখন তারাই বল প্রয়োগ করছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। ইসরায়েল ও ইউক্রেনে যুদ্ধ টিকিয়ে রাখার নেপথ্যে তথা নির্বিচারে নারী, শিশু ও হাসপাতালের রোগীদের হত্যার নেপথ্যে মার্কিন সমর্থনই মূল শক্তি। এরই মধ্যে সামনে এসেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের মধ্যে একটি অংশের আদিবাস বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহে। ঠিক এমনি এক সময়ে ডোনাল্ড লুর এমন সফর একটি প্রশ্নকেই সামনে এনেছে—‘লু তুমি কার’?

লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কিছু মানুষের ব্রেইন সিটিস্ক্যান করে দেখার ইচ্ছা, কীভাবে এত ক্রিমিনাল হতে পারে?

কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে তৃণমূলের আস্থা হুদাতে

১ হাজারে দৈনিক সুদ ১০০ টাকা!

বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন ব্রিটেনের রাজা

‘ড্রেসিংয়ে গেলে বলতেন আন্দোলনে গেছিলা ক্যান’

৩১ দফা বাস্তবায়নে বিএনপি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ : যুবদল সম্পাদক

শহীদ শাকিলের কবরে ছাত্র ফেডারেশনের শ্রদ্ধা নিবেদন

দুই দিনের ব্যবধানে সোনার দাম বৃদ্ধি, ভরি কত?

সাগরে লুঘচাপের মধ্যেই বৃষ্টি নিয়ে বড় দুঃসংবাদ   

আ.লীগের ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ : রাশেদ প্রধান

১০

সাতছড়ি উদ্যান দখল করে প্রভাবশালীদের লেবু চাষ

১১

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কমিটি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সংঘর্ষ

১২

এবার মারা গেলেন পরীমণির প্রথম সিনেমার পরিচালক

১৩

বিএনপিতে অনুপ্রবেশকারীর ঠাঁই হবে না : আমিনুল হক 

১৪

‘আ.লীগ ভিন্ন রাষ্ট্রের আদেশ বাস্তবায়নে ক্ষমতা দখলে রেখেছিল’

১৫

ঢাবির ইসলামের ইতিহাস বিভাগে মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ

১৬

কওমি সনদকে কার্যকরী করতে ছাত্রদল ভূমিকা রাখবে : নাছির উদ্দীন 

১৭

তিনবারের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আজাদ গ্রেপ্তার

১৮

শিল্পকলায় প্রদর্শিত হলো সার্কাস

১৯

৮ দফা অবিলম্বে বাস্তবায়ন দাবি ঐক্য পরিষদের

২০
X