যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে কি বিএনপির মোহভঙ্গ ঘটেছে? বিষয়টা অনেকটা এমনই। গত কয়েক বছরে এবং এ বছর ৭ জানুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে রাজপথের বিরোধী দল হিসেবে বিশাল বিশাল সমাবেশ, নানা প্রকার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলেও বিএনপির মনোজগৎ জুড়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে দলীয় সাংবাদিককে দিয়ে প্রশ্ন করানো, সেটা নিউজ আকারে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা, ভাইরাল করা, ঘন ঘন ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় যাওয়া, রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ডেকে ডেকে ঘন ঘন বৈঠক করা সবই করেছে বিএনপি।
দেশের ভেতরের কিছু বুদ্ধিজীবী এবং দেশের বাইরে অবস্থানকারী বিএনপি সমর্থক ইউটিউবার আর ফেসবুকাররা তারিখ দিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার ফেলে দিয়েছেন। বিএনপি এদের ওপর নির্ভর করেছে এবং বলতে গেলে এদের বক্তব্যের লাইন অনুসরণ করে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। বিএনপি নেতারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভেবেছেন নির্বাচন হবে না এবং নির্বাচন না হওয়ার জন্য আমেরিকা একটা কিছু করবেই। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। বিএনপি ছাড়াই নির্বাচন করে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ। বিএনপি এখন আবার রাজপথে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে, তবে এখনো সেভাবে জনপরিসরে তার কোনো প্রভাব নেই।
তবে এ কথা বলতেই হবে যে, সরকারের জন্য একটা চাপ যুক্তরাষ্ট্র ঠিকই তৈরি করেছিল। প্যারামিলিটারি এলিট বাহিনী র্যাবের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে, বাংলাদেশের জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করে, হঠাৎ করে শ্রম আইনের ডিক্রি জারির মাধ্যমে সরকারের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নানা কথা বলছিল পশ্চিমা দেশগুলোও। কিন্তু কোনো কিছুই শেখ হাসিনাকে টলাতে পারেনি। নির্বাচন হয়েছে, সরকার পুরোদমে দেশ পরিচালনা করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করা, সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলে চিঠি দিয়েছেন।
যে ফেসবুকাররা গলা ফাটিয়ে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এ সরকারকে টিকতে দেবে না, তারা এখন হতাশ শুধু নন, ক্ষুব্ধ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের পক্ষে ওকালতির অভিযোগে অভিযুক্ত করছেন এবং তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিএনপিও এখন সেই গান গাইছে। এ সময়ে যখন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফর করছেন, তখন বিএনপি তাকে উপেক্ষা করছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, তাদের কাছে এ সফর গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিএনপি তাদের রাজনীতির পক্ষে, তাহলে আমেরিকাকে প্রাসঙ্গিকই মনে করছে না যতটা ছিল নির্বাচনের আগে। বলতে গেলে পুরো পশ্চিমা শক্তির ওপরই আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বিএনপি।
গত বছর ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর বিএনপি যখন সরকারি দমন নীতিতে পুরো কোণঠাসা, তখনো আস্থা ছিল যে, আমেরিকা একটা কিছু করছে। দীর্ঘ সময় ধরে বিএনপি ঘোরের মধ্যে ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চাপ দেবে, সেই চাপে সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেবে আর সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। এমন একটি সহজ-সরল অঙ্ক বিএনপির মাথায় ঢুকিয়েছিলেন সেসব বুদ্ধিজীবী আর ইউটিউবার।
বিএনপি নেতারা তখন প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং দেশটির কাছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নালিশ জানিয়েছেন। গত বছর ২৪ মে যখন যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে, সেই ভিসা নীতির ঘোষণা হওয়ার পরপরই বিএনপি নেতাদের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস এবং আনন্দ লক্ষ করা গিয়েছিল। তারা এ ভিসা নীতি নিয়ে আবেগপ্রবণও হয়ে পড়েন। এর ফলে তারা অর্ধেকটা ক্ষমতায় প্রায় এসেই গেছেন এমন একটা ধারণাও দিতে শুরু করেন।
বিএনপির অনেক নেতা প্রকাশ্যেই বলছেন, বাংলাদেশে ২০১৪ বা ২০১৮-এর মতো নির্বাচন হবে না। বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায় তাহলে সেই নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেবে না; কিংবা সেই নির্বাচন বিএনপি হতে দেবে না। কিন্তু নির্বাচন হয়েছে। বিএনপি তার দাবি আদায় করতে পারেনি, নির্বাচনও ঠেকাতে সক্ষম হয়নি।
বিএনপির কাছে যুক্তরাষ্ট্র এখন অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু একটা দল কেন এমন করে চিন্তা করল? যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কোনো কিছুতে বাধ্য করতে পারবে বলে কেন মনে করেছিল বিএনপি?
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বলেছেন, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যা চেয়েছিল তা পায়নি। কিন্তু কী আসলে চেয়েছিল? চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র দলটিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিক। বিপুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও বিদেশ নির্ভরতার কারণে দলটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। দলের নেতাকর্মীর চেয়ে বিদেশিদের দিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট হওয়ার কারণে আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা তৈরি হয়নি। একসময় অতিমাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রাজনীতির গতিপথ দলটিকে মারাত্মক সংকটে ফেলে দিয়েছে। আবার এখন অতিমাত্রায় উপেক্ষা করার মনোভাব দলটিকে অপরিপক্ব হিসেবে জনপরিসরে উপস্থিত করে।
নির্বাচনের আগে খবর বেরিয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী লবিস্ট ফার্ম ব্লু স্টারকে নিয়োগ করেছে বিএনপি। দলটির যুক্তরাষ্ট্রের নেতা আবদুস সাত্তার গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক হয়, সেজন্য যেন যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা রাখে এটি নিশ্চিত করার জন্যই ব্লু স্টারকে লবিস্ট ফার্ম হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নেতৃত্বের একগুঁয়েমি, অপরিপক্ব আচরণ এবং সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিদের পরামর্শ দলকে নিরুদ্দেশের পথে নিয়ে গেছে। এখন নানাভাবে খবর আসছে যে, যুক্তরাষ্ট্র আসলে বিএনপিকে নির্বাচনে যাওয়ার পরামর্শই দিয়েছিল। একটি পত্রিকা খবর দিয়েছে, দলটির শীর্ষ পর্যায়ের তিনজন নেতার সঙ্গে দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকরা পৃথকভাবে এ বিষয়ে কথা বলেছেন। এর মধ্যে দুজন নেতার সঙ্গে আলোচনা হয় কারাগারে। গত বছর ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সহিংস ঘটনার পর ওই দুই নেতা কারাগারে ছিলেন। স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী ওই দুই নেতা কারাগারে বসেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের মনোভাবের কথা তাকে জানান। কিন্তু তারেক রহমান সাফ জানিয়ে দেন, তিনি নির্বাচনে যাবেন না।
বিএনপি কেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব গ্রহণ করল না? এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত তারা মনে করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব একটি ফাঁদ। দ্বিতীয়ত বিএনপি ভেবেছিল, সরকার নরম হবেই। দুটির কোনোটিই হয়নি। বিএনপি সমর্থক ইউটিউবাররা এখন বলছেন, ভিসা নীতি, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ সবই ছিল একটি ফাঁদ এবং ভারতের হয়ে যুক্তরাষ্ট্র এ খেলা খেলেছে শেখ হাসিনার পক্ষে।
নির্বাচনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রও সেভাবে বিএনপিকে কাছে টানছে না। বিএনপিকে সংলাপে যাওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র পরামর্শ দিয়েছিল। বিশেষ করে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগে ডোনাল্ড লুর বার্তা মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি সেখানে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র এটিকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। আরেকটি কারণ হতে পারে যে, ২৮ অক্টোবরে ঘটনা এবং তার পর থেকে নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত ট্রেনে হামলা, বাসে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ঘটনায় বিএনপির কিছু না কিছু যোগসাজশ থাকাকে সহজভাবে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র আগামী নভেম্বরে একটি নতুন নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে। ঠিক এ সময়ে বিরোধিতার নামে বাংলাদেশের মতো একটি দেশকে চীনা বলয়ে ঠেলে দিতেও আগ্রহী নয় দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপে সরকার শেষ পর্যন্ত নমনীয় হবে, এ আশা ছিল বিএনপির একেবারে শীর্ষ পর্যায়ে। সেটা না হওয়ায় এখন দল বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। নির্বাচনে যায়নি, সরকার হটাতে পারেনি। দলের রাজনীতি এখন এমন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অভিমান আর ভারতকে বর্জন।
লেখক: সাংবাদিক ও সমাজ বিশ্লেষক