ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ২০৪১ সাল নাগাদ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যার উদ্দেশ্য হলো স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি ও স্মার্ট সমাজ। এ চার স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে টেকসই ডিজিটাল প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রসারের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করে বাংলাদেশ ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত, সমৃদ্ধিশালী ও দারিদ্র্যশূন্য রাষ্ট্রে পরিণত করা। এটাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার। তবে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন না হলে ২০৪১ সালের মধ্যে রাজস্ব ক্ষতি হবে ৫০ লাখ কোটি বা ৫০ ট্রিলিয়ন টাকা। এ ছাড়া সংস্কারের পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে কর ছাড় বাদ দিলে আগামী চার বছরে ৬০ হাজার কোটি বা ৬০০ বিলিয়ন টাকা আয় করা সম্ভব। এজন্য টেকসই উন্নয়ন করতে হলে কর ব্যবস্থা সংস্কারের বিকল্প নেই। পাশাপাশি বাংলাদেশ যেহেতু উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে চায়, সেহেতু এসব কার্যক্রম না করলে দেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে। তাই কর প্রশাসন, কর আদায় ব্যবস্থা সংস্কার, সুশাসন নিশ্চিত এবং অটোমেশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।
কর যা আদায় হয় তার ৪৩ শতাংশই চলে যায় বেতন, ভাতার টাকা পরিশোধে। এ ছাড়া সরকার যে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে, তা পূরণ করতে হলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ঋণ সংকুচিত হয়ে পড়ে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের রাজস্ব জিডিপির শতাংশ হিসাবে বিশ্বের সর্বনিম্ন। এত দুর্বল রাজস্ব আদায় স্বল্প মেয়াদে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এবং মধ্যমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ২০৪১-কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হলে দেশের রাজস্ব আহরণ ভারত ও কম্বোডিয়ার কাছাকাছি দাঁড়াবে। কিন্তু রাজস্ব সংস্কার পদক্ষেপ বাণিজ্য করের ওপর নির্ভর করলে হবে না। কারণ, বাণিজ্য কর রপ্তানি বৃদ্ধি ও রপ্তানি বহুমুখীকরণকে নিরুৎসাহিত করে। ফলে আগামীতে কর যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। যদি দেশীয় কর রাজস্ব জিডিপির ২ শতাংশ বাড়ানো যায়, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বর্তমান স্তরের ওপর শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়তে পারে।
বাণিজ্য করের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ভারত ৮ শতাংশ, মালয়েশিয়া ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, থাইল্যান্ড ৩ শতাংশ এবং ভিয়েতনাম ৩ দশমিক ১ শতাংশ শুল্ক রাজস্বের তুলনায় কম থাকে। এসব দেশ বাণিজ্য করের ওপর নির্ভর করে না। আমাদের দেশের রাজস্ব ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয় রয়েছে, যেমন শুল্কমাত্রা যৌক্তিকীকরণ করার প্রয়োজন। এ ছাড়া পোশাক খাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভালো অবদান রেখেছে। কিন্তু পোশাক খাতের বাইরে অধিকাংশ রপ্তানি শিল্পই এমন সুবিধা পাচ্ছে না। ফলে অসহযোগিতামূলক নীতি তৈরি হয়েছে। এদিকে অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম এবং মুনাফা বেশি হওয়ায় পোশাক খাতের বাইরে শিল্প রপ্তানিকারকরা রপ্তানি করতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। জাতীয় শুল্কনীতির আবদ্ধ সীমাবদ্ধতার কারণে রপ্তানি বহুমুখীকরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আগামী বাজেটে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবহারের বিষয়টিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। চলমান সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন হলে অনেক কিছুই সহজীকরণ হবে। যেমন আইবাস সিস্টেম চালু হওয়ায় এখন বাজেট প্রণয়ন সহজ হয়েছে। করছাড় যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। ২৫ বছর আগের প্রণোদনা এখনো কেন থাকবে? আমরা সন্তানদের কি ২৫ বছর পর্যন্ত পকেট মানি দিই? রাজস্ব আদায় বাড়াতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে কর সংগ্রহ করতে হবে। ট্যাক্স জিডিপি রেশিও বাড়ানো দরকার। অর্থনৈতিক কাঠামো এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়েছে, এতে কোনো কোনো জায়গায় কম্প্রোমাইজ করতে হয়। সুদহার ব্যাংক রেটের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। করনীতি এবং সংগ্রহ দুটিকে আলাদা করা দরকার। এক্ষেত্রে রাজস্ব প্রতিষ্ঠানে যারা আছেন তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে।
অভিযোগ আছে যে, যারা কর দিচ্ছেন শুধু তাদেরই চাপ দেওয়া হয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত ভয়ংকর, যারা অনেক বেশি ব্যবসা করছেন; কিন্তু কর দেন না। এখন শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। গ্রামগঞ্জে যেতে হবে। সেখানে মানুষ অনেক বেশি আয় করে। কর আদায় দুর্ভোগমুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংক সুদ এখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। ১৪ শতাংশের ওপরে সুদ দিতে হয়। এ দেশে সুশাসন জরুরি। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ডলার রেট বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে। ফলে ব্যবসায়ীরা প্রণোদনা চাচ্ছেন।
এদিকে রাজস্ব ঘাটতি লেগেই আছে। চলতি অর্থবছরের নয় মাসে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা, আগের অর্থবছরে ছিল প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। শুল্ক-কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি কমে এক অঙ্কের ঘরে নেমে গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত এক দশকের মধ্যে সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে আগের অর্থবছরের তুলনায় সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। প্রবৃদ্ধির হার মাত্র ৮ দশমিক ১২ শতাংশ, যা এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল। এনবিআরের প্রবৃদ্ধি এত কমল যখন রাজস্ব আদায় বাড়াতে সবচেয়ে চাপে আছে সংস্থাটি। একদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের চাপ, অন্যদিকে সরকারের বাজেটে খরচ বৃদ্ধির জোগান বাড়াতে ধারাবাহিক চাপ। প্রতি বছরই এনবিআরকে বাড়তি রাজস্ব জোগানের জন্য বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হয়। এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে পরের পাঁচ বছর শুল্ক-কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি পৌনে ১১ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে ছিল।
কভিডের সময় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর রাজস্ব আদায়ে বড় উল্লম্ফন হওয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এনবিআর এখন রেসের পুরোনো ঘোড়ার মতো হয়ে গেছে। এখন শক্তিশালী ঘোড়া দরকার। বড় ধরনের সংস্কার করেই এনবিআরকে শক্তিশালী ঘোড়ায় পরিণত করতে হবে। রাজস্ব খাতে সংস্কার করতে হবে। তা নাহলে ২০৪১ সালের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.