প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৪, ০২:১৫ এএম
আপডেট : ১৫ মে ২০২৪, ০৯:০২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঋণখেলাপির অডি বিলাস!

ঋণখেলাপির অডি বিলাস!

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়েছে আগেই। এখন লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা। ডিজিটালের হাত ধরে বাংলাদেশে এসেছে নতুন নতুন কিছু পেশা। আউটসোর্সিং তো অনেক আগে থেকেই লাভজনক পেশা। একটি ল্যাপটপ আর হাইস্পিড ইন্টারনেট পুঁজি করে দুর্গম গ্রামে বসেও লাখ টাকা আয়ের গল্প এখন পুরোনো। ইদানীং শুনছি, ইউটিউবার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ব্লগার, ইনফ্লুয়েন্সার—অর্থ উপার্জনের অঙ্কে আকর্ষণীয় সব পেশা। ইনফ্লুয়েন্সাররা নাকি ফেসবুকে কোনো পণ্যের পক্ষে প্রচার চালান। বিনিময়ে তারা মোটা অঙ্কের অর্থ নেন। মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েও তাদের শিডিউল পাওয়া যায় না। ইউটিউবিং করে মাসে লাখ লাখ টাকা আয়ের গল্প শুনি। ইউটিউবাররা আবার নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দেন। তারা অবশ্য সব জায়গায় যান না। হিরো আলম, ব্যারিস্টার সুমন, মাশরাফী, সাকিব, শাকিব খান, অপু, বুবলি, পরিমণীরা হলো তাদের টার্গেট। শিল্পী সমিতির নির্বাচনে হাজার হাজার ইউটিউবার হাজির হয়ে যান। বগুড়ার ডিশ ব্যবসায়ী হিরো আলম ইন্টারনেট জগতে তুমুল জনপ্রিয়। এ জনপ্রিয়তার হাত ধরে এসেছে প্রচুর অর্থও। সেই জনপ্রিয়তা তিনি রাজনীতিতে টেনে আনতে চেয়েছিলেন। হিরো আলম না পারলেও ব্যারিস্টার সুমন ফেসবুকের জনপ্রিয়তা সংসদ পর্যন্ত টেনে নিতে পেরেছেন।

রাজনীতিতে আসার কারণে হিরো আলম বা ব্যারিস্টার সুমনকে চিনলেও, এ জগতের সঙ্গে আমার যোগাযোগ-পরিচয় সামান্যই। আমি কোনো ইউটিউবার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর বা ইনফ্লুয়েন্সারকে চিনি না। এই না চেনাটা অবশ্যই আমার ব্যর্থতা। একজন সার্বক্ষণিক সাংবাদিক হিসেবে সমাজের সব ধরনের পরিবর্তনের ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত। নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করেই বলছি, ভার্চুয়াল জগতে আমার বিচরণ নেই বললেই চলে। কোনো আলোচনা ভার্চুয়াল জগৎ ছাপিয়ে অ্যাকচুয়াল জগতে এলেই আমি টের পাই, তার আগে নয়। সম্প্রতি ‘রাফসান দ্য ছোট ভাই’ এক ইউটিউবার ঝড় তুলেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই তরুণ কনটেন্ট ক্রিয়েটর তার বাবা-মাকে ২ কোটি টাকা দামের একটি অডি গাড়ি উপহার দিয়েছেন। মা দিবসে তিনি তার মাকে ৫ লাখ টাকা দামের গহনা উপহার দিয়েছেন। কোনোটাই কিন্তু গোপন খবর নয়। রাফসান দ্য ছোট ভাই নিজে ইউটিউবে ফলাও করে তা প্রচার করেছেন। ইনকাম ট্যাক্সের ভয়ে বাংলাদেশের অনেক সম্পদশালী নিজেদের সম্পদ গোপন রাখেন। আমার এক পরিচিত সরকারি চাকুরে, যার শতকোটি টাকার সম্পদের খবর শুনি। কিন্তু তিনি চলাফেরা করেন সিএনজিতে। ইনকাম ট্যাক্সের ভয়ে গাড়ি কিনতে পারেন না। সেখানে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা নিজের আয়ের কথা ইন্টারভিউ দিয়ে প্রচার করেন। মানতেই হবে তাদের সাহস অনেক বেশি। অবশ্য তাদের আয় আয়করের আওতায় পড়ে কি না বা তারা আয়কর দেন কি না, জানি না। আমি সহজ বাংলায় বুঝি, আপনার বার্ষিক আয় সাড়ে ৩ লাখ টাকার বেশি হলেই আপনাকে কর দিতে হবে।

রাফসানকে না চিনলেও ২ কোটি টাকার গাড়ি কিনে বাবা-মাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার বিষয়টি আমার কাছে ভালো লেগেছে। এ নাটকীয়তার মধ্যেই বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। অল্প বয়সে অনেক টাকা আয় করেও পরিবারকে ভুলে যায়নি, এটা ধন্যবাদ পাওয়ার মতোই। তবে রাফসানের গিফট নিয়ে ফেসবুকে রীতিমতো ঝড় ওঠে। অনেকের মন্তব্যেই বাঙালিসুলভ ঈর্ষার প্রকাশ দেখেছি। অনেকের মধ্যে একটা অন্যায্য তুলনার প্রবণতাও দেখেছি। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা পড়াশোনা শেষ করে ১৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরির পেছনে ছোটেন। আর লেখাপড়া ছাড়াই ইউটিউবিং করে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করার বিষয়টি নিয়েই চলে তুলনার চেষ্টা। কে, কীভাবে অর্থ উপার্জন করবেন—এটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। বিষয়টি আইনি এবং সৎ পথে হলেই হলো। আপনি আপনার সন্তানকে ডাক্তার বানাবেন না কনটেন্ট ক্রিয়েটর বানাবেন, সেটা আপনার পছন্দ। এটা নিয়ে রাফসানকে গালমন্দ করার কিছু নেই। তাই আমি এই তুলনা বিতর্কে অংশ নিইনি। মানে রাফসানের গিফট ইস্যু নিয়ে কিছুই লিখিনি।

তবে শেষ পর্যন্ত রাফসান ইস্যুতে লিখতে বসলাম অন্য কারণে। পত্রিকায় দেখলাম রাফসানের বাবা-মা ঋণখেলাপি। জ্যাক অ্যান্ড স্পেন্সার অ্যাক্সেসরিজ লিমিটেড নামে একটি গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ কোম্পানি ট্রাস্ট ব্যাংকের মিলেনিয়াম করপোরেট শাখা থেকে আড়াই কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল ২০১৬ সালে। রাফসানের বাবা মো. জাকারিয়া ওই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং তার মা কাজী নুরুন্নেছা সেহেলি পরিচালক। ঋণ নেওয়ার পর থেকে তারা এক টাকাও পরিশোধ করেননি। সুদসহ এখন যা দাঁড়িয়েছে সোয়া ৩ কোটি টাকা। ব্যাংক ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়। পরে তারা জামিন নিলেও সম্পত্তি নিলামের আদেশ হয়। কিন্তু সেই আদেশ হাইকোর্টে রিট করে আটকে রেখেছেন তারা।

আইনি বিবেচনার কথা যদি বলেন, ঋণখেলাপি রাফসানের বাবা-মা, রাফসান নিজে নন। তাই তিনি চাইলেই সোয়া ৩ কোটি টাকার ঋণখেলাপি বাবা-মাকে ২ কোটি টাকার গাড়ি গিফট করতেই পারেন। কিন্তু আইনের পাশে কিছু নৈতিকতার ব্যাপারও আছে। যে পরিবার সোয়া ৩ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না, সে পরিবারের ২ কোটি টাকার গাড়িতে চড়ার নৈতিক অধিকার নেই। আইনে হয়তো আটকাবে না। কিন্তু বাবা-মায়ের ভালোমন্দের দায় সচ্ছল সন্তানকে নিতেই হবে। বাবা-মা মারা গেলে জানাজার আগে সন্তান দাঁড়িয়ে বলেন, ‘কারও কোনো দেনা-পাওনা থাকলে যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’ সন্তান যেমন পিতামাতার সম্পদের উত্তরাধিকার হন, তেমনি দেনার দায়ও নিতে হবে। রাফসান যদি বাবা-মাকে অডি গাড়ি উপহার না দিয়ে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে দিতেন, তাহলে সেটা একটা ভালো দৃষ্টান্ত হতো। কিন্তু তেমনটি হলে হয়তো তিনি এভাবে ভাইরাল হতে পারতেন না। কনটেন্ট ক্রিয়েটর রাফসানের মাথায় ভাইরাল হওয়ার বিষয়টিও হয়তো ছিল, ঋণের বিষয়টি হয়তো ছিল না। বাবা-মাকে অডি গাড়ি গিফট দেওয়ার যে ভিডিও, তা থেকেও রাফসান ভালো অর্থই আয় করতে পারবেন।

আসলে আমার ধারণা, রাফসান বা তার বাবা-মায়ের ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার কোনো ইচ্ছাই নেই। থাকলে ২০১৬ সালে ঋণ নেওয়ার পর গত ৮ বছরে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করতেন। আরও অনেকের মতো তারা ঋণ নিয়ে সেটা মেরে দেওয়ার কৌশল নিয়েছেন। বাংলাদেশে এখন প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আছে। এর মধ্যে কিছু নিশ্চয়ই অনিচ্ছাকৃত খেলাপি আছে। ঋণ নিয়ে যে ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন, সেটা হয়তো করতে পারেননি বা ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে অধিকাংশ খেলাপি ঋণই ইচ্ছাকৃত। ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি কেনা, দামি গাড়িতে চড়া, টাকা পাচার করার ঘটনাই বেশি। রাফসানের বাবা-মা একটা ছোট্ট উদাহরণ মাত্র। খেলাপি ঋণের সাগরে সোয়া ৩ কোটি টাকা বিন্দুমাত্র। কিন্তু প্রবণতাটা একই। ব্যাংক থেকে টাকা নাও, ফুর্তি করো এবং ভুলে যাও। রাজনীতিবিদরা তবু নির্বাচনের আগে অল্পকিছু অর্থ দিয়ে তপশিল করেন। ব্যবসায়ীদের সে বালাই নেই। তারা ঋণ নেন এবং ভুলে যান। ব্যাংক মনে করিয়ে দিলে তারা আদালতে যান, স্থগিতাদেশ নেন, আপিল করেন। নানাভাবে কালক্ষেপণ করেন। কিন্তু ঋণ আর শোধ করেন না।

বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঋণ করে ঘি খাওয়ার একটা সংস্কৃতি আছে। বাংলাদেশের আইন সেই সংস্কৃতিকে আরও উসকে দিয়েছে। সবাই বুঝে গেছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ না করলে আপনার কিছুই হবে না। দুঃখটা এখানেই। আমার খালি কৌতূহল, ব্যাংকের কাছে সোয়া ৩ কোটি টাকা ঋণ রেখে ছেলের দেওয়া ২ কোটি টাকা দামের গাড়িতে চড়তে রাফসানের বাবা-মায়ের কেমন লাগছে?

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১০

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১১

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১২

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৩

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

১৪

আশুলিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক সমাবেশ

১৫

কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

১৬

পাকিস্তানের জলসীমায় বিপুল তেল-গ্যাস মজুতের সন্ধান

১৭

বিসিবির দুর্নীতির তদন্ত দাবি সাবেকদের

১৮

পাবিপ্রবি ছাত্রলীগ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ

১৯

জেল খেটেছি তবু শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যাইনি : সাবেক এমপি হাবিব

২০
X