মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে/তুমি যাচ্ছো পালকিতে মা চড়ে... আমার কাছে অজানা মায়ের এমন সুন্দর ছবি দ্বিতীয় আর কিছু নেই। অজানা বললাম কারণ, রবীন্দ্রনাথ মূলত তার মাকে জানার আগেই তিনি পরলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এই যে মা হারানোর বেদনা, নীলকণ্ঠ রবীন্দ্রনাথ সে বিষ হজম করে আমাদের অমৃত দান করে গেছেন আজীবন।
মা আমাদের কাছে ভীষণ স্পর্শকাতর একটি নাম। মাকে নিয়ে যত গল্প-কবিতা, এমনকি উপন্যাস বা নাটক, তার ছিটেফোঁটাও বাবাদের ভাগ্যে জোটে না। একসময় এ নিয়ে ঈর্ষা হলেও এখন আর হয় না। ম্যাক্সিম গোর্কির দুনিয়া কাঁপানো ‘মা’ আমাদের জানিয়ে গেছে মায়ের প্রকৃতি কী হতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় নির্মিত একটি চলচ্চিত্রের নাম ছিল টু উইম্যান। বিশ্বখ্যাত অভিনেত্রী সোফিয়া লরেনের অসাধারণ অভিনয় সমৃদ্ধ ছবি। ছবিতে তিনি ছিলেন এক নির্যাতিত মা। যিনি নাৎসিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিলেন। মুক্ত হওয়ার পর তার সঙ্গে মেয়ের দেখা হয়েছিল। খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকা মা-মেয়ে একে অন্যকে দেখার পর বুঝতে পারে কী হয়েছিল তাদের ওপর। সে অবিস্মরণীয় মায়ের মুখ আমি এখনো চোখে দেখতে পাই। যিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, তুমি এখন একজন নারী বা উইম্যান। ছবিটির নাম ই তাই টু উইম্যান।
মা যে কী, তার অনেক ধরনের উদাহরণ দেওয়ার কোনো দরকার পড়ে না। দুনিয়া কাঁপানো একটা ছবি আছে। যেটিতে মা সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মিলিটারির কাছে খুলে ধরেছেন নিজেকে। ঠিক যেমন আর একটি ছবিতে হিংস্র নেকড়ের মুখে সমর্পিত হরিণ আগলে রেখেছে তার শাবককে। আপনারা জানেন অস্ট্রেলিয়ার দাবানল খুব সাংঘাতিক। গ্রীষ্মকালে দাবানল থেকে দূরে সিডনি শহরেও আমরা স্বস্তি পাই না। পোড়া গন্ধ আর ভারি বাতাসে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। পালিয়ে ঘরে ঢুকতে পারলেই জীবন বাঁচে। এমন এক দাবানলে যখন দাউ দাউ করে সবকিছু জ্বলে ছাই হয়ে যাচ্ছিল তখন বাচ্চাটিকে পরম মমতায় আগলে রাখা ক্যাঙারু মা জীবনের পরোয়া করেনি। এই এক প্রাণী, যার কাছে আপনি অনায়াসে জানতে পারেন মা কাকে বলে। ক্যাঙারু তার সন্তানকে বুকে করে কোলে করে ঘুরে বেড়ায়। এতে তার কোনো ক্লান্তি নেই।
নিজের মায়ের কথা একটু বলি। মধ্যবিত্তের পরিবারে মা হচ্ছে এক আশ্চর্য প্রদীপের নাম। ঘষা দিলেই হাজির হয়ে যেত সব।
বাবা ব্যাংক চাকুরে। পরিশ্রম শেষে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে বানানো জলরুটি, চা, মুড়িমাখা খেয়ে ঘরে ঢুকে যেতেন। তার আর কিছু না জানলেও হতো। পাঁচ সন্তানের সংসার। বড়দি কখন ফিরবে, পড়ুয়া মেজদির টিচারের বেতন কোথা থেকে আসবে, বাকি দুই দিদির স্কুলের ফি, নতুন ফ্রক, একমাত্র ছেলের বায়না—সব তার নখদর্পণে। মাঝে মাঝে ভাবতাম, কী করে পারে? কোথায় পায় এত শক্তি?
বড় হতে হতে চোখে দেখলাম, সবার অজান্তে বেরিয়ে গিয়ে মুদি দোকানের ছেলেটিকে বলে এসেছে ডিম, কলা, চাল দিয়ে যেতে। হাতের বালা খুলে গোপনে দিয়ে এসেছে দিদির পরীক্ষার ফি দিতে হবে বলে। কেউ জানেই না শেষে মায়ের পাতে ভাত, ডাল, ডালের বড়া আর মাছের ঝোলের আলু ছাড়া কিছুই ছিল না। অথচ অসময়ে এসে পড়া অতিথিও জানতেন, সবাই ভরপেট খেয়ে তৃপ্ত।
মা ছিল স্কুল মাস্টারের মেয়ে। বুকে তার আদর্শ, মনে লেখাপড়ার সংকল্প। সুন্দরী ছিল বলে দিদিদের কারও কারও বাল্যবিয়ের সুপ্রস্তাব এসেছিল। অবলীলায় ফিরিয়ে দিয়ে বলত, আগে নিজের পায়ে খাড়াক। পড়ালেখা করুক। তারপর বিয়া। সবাইকে কমপক্ষে কলেজ পাস করিয়ে দিয়েছে মা।
বিয়ের পর মাঝে মাঝে ঝগড়া লেগে গেলে মাকে বিচার দিতাম। বলতাম, তুমি সবসময় ওর পক্ষ নাও কেন? শোনো কী বলছে?
মৃদু একটা হাসি ঝুলিয়ে বলত, তুই একটু বাইরে গিয়ে ঘুরে আয়। শেষে একদিন বলেছিল, মেয়েটি আমার সবচেয়ে ছোট মেয়ের বয়সের চেয়েও ছোট। ওকে বকা দিতে পারব না গৌতম।
একটা দৃশ্য আজীবনের মতো মনে গেঁথে আছে আমার। প্রাইমারি স্কুল পাস মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে ব্যাংকার বাবা। মা রামায়ণ, মহাভারত পড়ে শোনাচ্ছে। কোনো কোনো সময় তাদের দুজনের মুখে হাসি। আবার রাবণ ও ইন্দ্রজিতের মৃত্যুতে মন খারাপ করা চোখের পানি পড়তেও দেখেছি আমি। রাম তথা ভগবানবিরোধী হলেও তাদের জন্য এমন ভালোবাসা অবাক করত।
দুর্গাপূজার বিসর্জনের দিন মা আমাদের শিখিয়েছিলেন সবার সঙ্গে অসুরের পায়েও যেন প্রণাম করতে না ভুলি।
ন্যূনতম মানবিক বোধও যদি পেয়ে থাকি তো মায়ের কাছ থেকেই তা পাওয়া। মা কোথায়, কেমন আছেন, জানি না। চিঠি লেখার বা ফোন করারও সুযোগ নেই। শুধু বিশ্বাস করি, দেখা হবে ফের কোনো দিন।
মহাভারতের একটি গল্প আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে মা আসলে কেমন হয়। রাজা ভগস্মান দেবতাকে তুষ্ট করে শতপুত্রের বর চেয়েছিলেন। শতপুত্রের জনক হতে চাওয়া রাজার সে মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু রাজা সেখানে থামার মতো কেউ না। পুত্ররা বড় হতে হতে তিনি আবার কঠিন তপস্যা শুরু করে দিলেন। তার তপস্যায় সন্তুষ্ট দেবরাজ আবার এসে হাজির। খানিকটা কৌতূহল নিয়েই জানতে চাইলেন: আবার কী চাও বৎস? রাজা হাতজোড় করে মিনতি জানালেন, আমাকে নারী করে দিন।
নারী?
হ্যাঁ। নারী হয়ে আবারও শতপুত্রের জননী হতে চাই আমি। একটু বিরক্তই হলেন দেবতা। তবু বললেন, তথাস্তু। কিন্তু আমাকে একটা কথা দিতে হবে?
খুশি মনে রাজা বললেন, বলুন কী কথা? আমি অবশ্যই তা পালন করব।
আমি সময় হলে এসে চাইব।
আকাশে বিলীন হয়ে যাওয়া দেবতার ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেন রাজা। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। হঠাৎ একদিন দেবরাজ এসে হাজির। দুই হাত জোড় করে রাজা বললেন: আজ্ঞা করুন। আদেশ করুন।
দেবারজ বললেন: তোমার যে কোনো শতপুত্র আমায় দাও। আমি নিয়ে যাবো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাজার চোখ ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু কথা তো রাখতেই হবে। তিনি চোখ মুদে বললেন, পিতা হয়ে যামি যে শতপুত্রের জন্ম দিয়েছি তাদের আপনি নিয়ে যান প্রভু।
দেবরাজ বললেন: তাই হবে। কিন্তু আমাকে বলো তো—কেন তুমি তাদের দিতে চাইছ?
কান্নায় বিগলিত রাজা বলেছিলেন, প্রভু নারী না হওয়া পর্যন্ত আমি আসলে বুঝতেই পারিনি সন্তান স্নেহ কী! মায়া কাকে বলে। মা হওয়ার পর আমি যে ভালোবাসা আর স্নেহ দিতে পেরেছি, পিতা হয়ে তার সিকিভাগও দিতে পারিনি।
এই হচ্ছে মা। পিতা তার সন্তানকে দিতে পারলেও মা পারে না। পারে না বলেই রুমীর মা আমাদের জননী হয়ে উঠেছিলেন। সন্তান গেছে বটে জাহানারা ইমাম জাতির জননী হয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে গেছেন। জানিয়ে গেছেন মাতৃশক্তির কাছে কিছুই কিছু না।
আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য—এক হাতে সন্তান, আরেক হাতে নিজের ব্যাগ নিয়ে ছুটতে থাকা মা। বাচ্চাকে জুতার ফিতা লাগিয়ে দেওয়া মা। অসুস্থ সন্তানের মাথার কাছে জাগতে থাকা ঘুম ঢুলুঢুলু জননী। বাকিরা সবাই যখন ঘুমে, মায়ের চোখ তখন অতন্দ্র প্রহরী।
আমার বাবা যখন মারা যান, মনে হয়েছিল মাথার ওপর থেকে ছাদ সরে গেছে। মা চলে যাওয়ায় মনে হলো আকাশটাই চুরি হয়ে গেছে আমার।
কন্যা-জায়া-জননীদের আমি বলি দশভুজা। তাদের জন্য আলাদা কোনো দিন বা দিবসের দরকার পড়ে না। মা তো মা-ই। খুব সাধারণ গান, কিন্তু কী শক্তিশালী কথা। ‘মায়ের নাম মুখে নিলে শান্তি পাওয়া যায়... আমার আরও এক মা আমাদের দেশ। যিনি আগলে রাখেন। কোনো দেশ, কোনো মাটি আশ্রয় না দিলেও যিনি কাছে টানেন। অদৃশ্যের এক মা, যে আমাকে পরিচালিত করেন—সেটাও স্বীকার করি অকপটে।
জয়তু মা।
লেখক: ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক, সিডনি প্রবাসী