মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ : ১১ মে ২০২৪, ০৩:১৭ এএম
আপডেট : ১১ মে ২০২৪, ০৮:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শব্দদূষণ কমাতে পারে জনসচেতনতা

শব্দদূষণ কমাতে পারে জনসচেতনতা

ঘরে-বাইরে সুরবর্জিত নানা শব্দ মানুষের কানে ঢুকে দেহমনের যে ক্ষতি করে চলেছে, তা বেশিরভাগ মানুষ টেরই পায় না। তারা জানে না, শব্দ যদি উচ্চমাত্রার হয় তাহলে তার ক্ষতি হয় অপূরণীয়। গ্লোবাল সিটিস ইনস্টিটিউশনের এমন সমীক্ষায় দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় প্রতিনিয়ত যে ধরনের শব্দদূষণ ঘটছে, তাতে বসবাসকারী মানুষের এক-চতুর্থাংশ কানে কম শোনে এবং এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৩৫ সাল নাগাদ ৪৫ ভাগ মানুষ কানে কম শুনবে। এ হিসাবে ২০৪৫ সালে প্রায় দেড় কোটির বেশি মানুষ শব্দদূষণে আক্রান্ত হয়ে শ্রবণশক্তি হারাবে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনএপি) ‘বার্ষিক ফ্রন্টিয়ার্স রিপোর্ট-২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শব্দদূষণের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর নির্বাচিত করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রতিনিয়ত যে শব্দ উত্থিত হয়, তা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমোদনযোগ্য শব্দসীমার মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। এ ছাড়া বাণিজ্যিক এলাকা ও যেখানে যানজট রয়েছে সেখানে এই মাত্রা ৭০ ডেসিবেল। ঘনবসতিপূর্ণ ও ব্যাপক যানজটের শহর ঢাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ১১৯ ডেসিবেল। পরিবেশগত শব্দের উৎস হিসেবে রাস্তার যানজট, বিমান চলাচল, রেল চলাচল, যন্ত্রপাতি, শিল্প ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ধরনের শব্দ শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলেও উল্লেখ করা হয়। অন্য এক গবেষণামতে, ঢাকার অনেক জায়গায় শব্দমাত্রা ১০৭ ডেসিবেল পর্যন্ত ওঠে। ৬০ ডেসিবেলের ঊর্ধ্বে শব্দ মানুষকে সাময়িক এবং ১০০ ডেসিবেলে ঊর্ধ্বে শব্দে মানুষ চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে।

বাতাসের মাধ্যমে সহনক্ষমতার অধিক তীব্র বা তীক্ষ্ণ, বিশেষ করে সুরবর্জিত শব্দের উপস্থিতিতে মানুষ তথা জীবজগতের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়, তাকেই শব্দদূষণ বলা হয়। মানবসভ্যতার বিকাশমান ধারায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পের দ্রুত প্রসার, পরিবহনের অবাধ প্রবাহ প্রতিনিয়ত সুরবর্জিত শব্দের বিস্তার ঘটাচ্ছে। ফলে শব্দদূষণও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্কুল-কলেজ, হাসপাতালের মতো স্পর্শকাতর স্থানেও এসব তীব্র শব্দের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি নেই। এ ছাড়া রেলওয়ে ট্রেনের হুইসেলের শব্দ ৯০ ডেসিবেলের ঊর্ধ্বে, যা মানুষের শ্রবণক্ষমতার বাইরে। অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক সময় জেনারেটর ব্যবহারের ফলে শব্দদূষণের সৃষ্টি হয়। প্রচারের কাজে, সভায় বক্তৃতাকালে এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহারেও শব্দদূষণ ঘটে। আতশবাজির শব্দে তীক্ষ্ণ শব্দদূষণ হয়। বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি চালানোর শব্দ এলাকায় দূষণের সৃষ্টি করে। এ ধরনের শব্দের মাত্রা সাধারণত ৮০ থেকে ১০০ ডেসিবেল হয়ে থাকে। শিল্পকারখানার ব্যবহৃত সাইরেন থেকে ১৪০ ডেসিবেল মাত্রার তীব্র শব্দ উত্থিত হয়। বিমানবন্দর এলাকায় বসবাসকারীদের কাছে বিমান উড্ডয়ন এবং অবতরণের সময় প্রায় ১১০ ডেসিবেলের শব্দদূষণ হয়ে থাকে। সুরবর্জিত উচ্চ তীব্রতাসম্পন্ন শব্দ মানবদেহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। শব্দদূষণের প্রত্যক্ষ প্রভাবে মানুষের শ্রবণশক্তির ওপর অস্থায়ী বা স্থায়ী যে কোনো ধরনের ক্ষতি হতে পারে, যা কালক্রমে শ্রবণশক্তিহীনতা থেকে বধিরত্বে রূপ নিতে পারে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়, সুরবর্জিত তীব্র শব্দ পরোক্ষভাবে মানুষের দেহে স্নায়ুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্নায়ুতন্ত্রের ওপর এ ধরনের সুরবর্জিত উচ্চমাত্রার শব্দের প্রভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া, রক্তচাপ, শ্বাসক্রিয়া, দৃষ্টিশক্তি এমনকি মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপে অস্থায়ী বা স্থায়ী প্রভাব ফেলে। উচ্চমাত্রার শব্দদূষণে হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পায়। হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্নায়ুতন্ত্রের সক্রিয়তা বেড়ে দেহের চলাচলে গতি-প্রকৃতির ক্রিয়া বিঘ্নিত হতে পারে। হৃৎপিণ্ডের ও মস্তিষ্কের কোষের ওপর অক্সিজেনের অভাবজনিত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। একাগ্রতা হ্রাস পেয়ে হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া এবং মাথাধরার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কখনো উচ্চমাত্রার সুরবর্জিত শব্দের কারণে কানের পর্দা ছিঁড়ে গিয়ে আংশিক বা পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি হতে পারে। শব্দদূষণে মানবদেহের রক্তের শর্করার ওপর প্রভাব ফেলে। শব্দদূষণে রাত্রিকালীন দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। এমনকি সুরবর্জিত উচ্চমাত্রার শব্দে মানসিক অবসাদ সৃষ্টি ও স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০০৬ সালে ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা’ জারি করা হয়। এতে রাজধানীতে শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা সময় ও এলাকাভেদে আলাদা করে দেওয়া হয়। আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের চারপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় স্পষ্ট বলা আছে কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কী ধরনের শব্দদূষণ করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। শব্দদূষণের জন্য দোষী হিসেবে কেউ প্রমাণিত হলে প্রথম অপরাধের জন্য এক মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা দুই ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়ার কথা বলা রয়েছে। অন্যদিকে, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন- ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ মোতাবেক শহরকে নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা—এ পাঁচ ভাগে ভাগ করে এলাকার দিন ও রাত ভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে বলা আছে, সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণকাজে ব্যবহারের কোনো যন্ত্র চালানো যাবে না। ভয়াবহ শব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে নির্দেশনা চেয়ে ২০১৭ সালে রিট করা হলে হাইকোর্টের এক আদেশে হাইড্রোলিক হর্ন আমদানিও নিষিদ্ধ করা হয়।

শব্দদূষণ রোধে প্রয়োজন ব্যক্তিগত, প্রযুক্তিগত এবং আইনগত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ। বাড়িঘরে বিনোদনের কাজে ব্যবহৃত রেডিও, টেলিভিশনের শব্দ যথাসম্ভব কমিয়ে শুনতে হবে। পেশাগত কাজে শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতিতে শব্দ প্রতিরোধক যন্ত্র লাগিয়ে নিতে হবে। আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত লাউড স্পিকারের শব্দ সীমিত রাখতে হবে। মূলত যানবাহন, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, কলকারখানা থেকে যে অনাকাঙ্ক্ষিত উচ্চশব্দ উত্থিত হয়, তা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে রোধ করা সম্ভব। উচ্চমাত্রার শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রে শব্দ প্রতিরোধক আচ্ছাদন ব্যবহার করলে তা থেকে শব্দদূষণ হবে না। শব্দদূষণ স্থানে শব্দ প্রতিরোধক ডিভাইস ব্যবহার শব্দদূষণ প্রতিরোধে ইতিবাচক ফল দেবে। স্থলপথের পরিবহন এবং বায়ুযানের চলাচলজনিত সামাজিক শব্দদূষণও প্রযুক্তিগত উপায়ে রোধ করা সম্ভব। আকাশপথে চলাচলকারী বাহনে কম শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী ইঞ্জিন এরই মধ্যে বের হয়েছে। উৎসব, আয়োজনে মাইক বা লাউড স্পিকার বাজানোর জন্য শব্দসীমা নির্ধারণ করা অত্যাবশ্যক। আতশবাজির মতো উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী সব ধরনের আয়োজন বন্ধ করা জরুরি। বাড়িঘরে, স্কুল-কলেজে, হাটবাজারের মতো জায়গায় নিচুস্বরে কথা বলার অভ্যেস করতে হবে। শব্দদূষণ রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং ব্যক্তিগত গাড়িচালক, বাসচালক, ট্রাকচালকদের সচেতনতা বৃদ্ধি শব্দদূষণ রোধে সহায়ক হতে পারে। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে কম শব্দের লাউড স্পিকার ব্যবহার করে শব্দদূষণ কমিয়ে আনা যায়। শব্দদূষণকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে গাড়ির হর্ন এবং মাইকের উচ্চশব্দ নীতিনির্ধারকরা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। শব্দদূষণ স্থায়ীভাবে রোধ করতে আইনের কঠোরসহ ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ব্রাজিলে বাস খাদে পড়ে নিহত ২৩

ঢাকায় ট্রেনের ৩ বগি লাইনচ্যুত

মেঘে ঢেকেছে ঢাকার আকাশ, বৃষ্টি হবে কবে?

উত্তরে হঠাৎ তীব্র শীত

আজ ঢাকার বাতাস ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’

অকেজো হওয়ার পথে শিক্ষার্থী তামিমের হাত

ফিলিস্তিনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭ শতাংশ ইহুদি

শসা খেলে কি আসলেই ওজন কমে? 

পাবনায় চরমপন্থি দলের সাবেক নেতাকে কুপিয়ে হত্যা

লেবানন থেকে ইসরায়েলে শত শত রকেট হামলা

১০

জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থায় চাকরি, আবেদন শেষ তারিখ ১ ডিসেম্বর

১১

টিভিতে আজ যেসব খেলা দেখা যাবে

১২

২৫ নভেম্বর: আজকের নামাজের সময়সূচি

১৩

সোমবার ঢাকার যেসব এলাকায় মার্কেট বন্ধ

১৪

২৫ নভেম্বর : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৫

মেঘনা গ্রুপে আকর্ষণীয় বেতনে চাকরির সুযোগ

১৬

ইবিতে বিভাগের নাম পরিবর্তনের দাবিতে প্রধান ফটক অবরোধ

১৭

যবিপ্রবিতে বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে রিসার্চ সেলের সেমিনার

১৮

ইবিতে চুরির অভিযোগে আটক ২

১৯

ঢাকা পলিটেকনিক-বুটেক্সের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ, আহত ২৮ জন ঢামেকে

২০
X