গ্রীষ্মের ঝলকানিময় আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশে দিন দিন গরম হচ্ছে। এ গরম তাপমাত্রা (অসহনীয় আর্দ্রতাসহ ৪০ ডিগ্রির বেশি) এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলায় গাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাছ শুধু প্রকৃতি বা দৃষ্টিনন্দন নয়, গাছ পরিবেশকে শীতল করা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, বন্যা প্রতিরোধ এবং ভূমিকম্প ও ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার মতো মৌলিক সেবাসমূহ দিয়ে থাকে, যা মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য।
গাছ স্বাভাবিক ধারায় মূলত প্রাকৃতিক শীতাতপের কাজ করে। গাছ ছায়া প্রদান করে এবং বায়ুমণ্ডলকে ‘ইভাপোট্রান্সপিরেশন’ নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শীতল করে, যার মূলত অর্থ তারা বাতাসে জলীয় বাষ্প ছেড়ে দেয় এবং চারপাশকে শীতল করে। যখন শহরগুলোতে প্রচুর ভবন গড়ে ওঠে এবং গাছ কমে যায় (যেমন ঢাকা) এবং ক্রমাগত কাটা হয় (যেমন চট্টগ্রাম) তখন ‘শহুরে তাপ দ্বীপ’-এর কারণে ভূমণ্ডল অসহনীয় গরম হয়ে ওঠে। অনেক দিন ধরে কোনো বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকে। গাছ প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতেও সাহায্য করে। তারা বায়ু থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে। গাছ মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং ভূমিধস প্রতিরোধ করে, বিশেষ করে অনেক পাহাড়ি এলাকায়। গাছ অতিরিক্ত পানি প্রাকৃতিক উপায়ে জমিয়ে রাখতে পারে এবং নদীসমূহের নিকটবর্তী ও ঘন ঘন প্লাবিত অঞ্চলে মাটি ধুয়ে যাওয়া বন্ধ করতে পারে। তারা এমনকি কিছু জায়গায় বজ্রপাতের সম্ভাবনা কমাতে পারে। সেজন্য শুধু সবুজ নয়, প্রাকৃতিকভাবে পরিবেশবান্ধব গাছের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
সবচেয়ে বড় কথা, গাছ শুধু পরিবেশের জন্য সহায়ক নয়। গাছ আমাদের ফল, ঘর ও আসবাবপত্র নির্মাণের জন্য কাঠ, এমনকি ওষুধও সরবরাহ করে থাকে। তারা প্রাণী এবং গাছপালাসমৃদ্ধ প্রকৃতিকে আরও বৈচিত্র্যময় এবং স্থিতিস্থাপক করে তোলে। গাছের অপরিসীম গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও, বিশেষ করে শহর-নগর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমরা নতুন গাছ লাগানোর চেয়ে দ্রুত কেটে ফেলছি। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের প্রচুর গাছ লাগাতে এবং গাছ রক্ষা করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকারের উচিত অবৈধ কাঠ কাটা বন্ধ করার জন্য নিয়ম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা এবং মানুষকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করা। গাছ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা কীভাবে সাহায্য করতে পারে সে সম্পর্কেও আমরা মানুষকে সচেতন করতে পারি। বৃক্ষরোপণ প্রকল্পে সহায়তা করে এবং পরিবেশগত গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করে বেসরকারি সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ত হওয়া খুব প্রয়োজন। একসঙ্গে কাজ করে, বাংলাদেশকে বর্তমান ও ভবিষ্যতে সবার জন্য আরও সবুজ এবং নিরাপদ করার কোনো বিকল্প নেই।
গত বছরের মতো এই এপ্রিলেও বাংলাদেশে প্রচণ্ড গরম পড়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই তাপ আরও তীব্র হচ্ছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে কিছুদিনের জন্য। এর মধ্যে কয়েকজন তাপপ্রবাহে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং অসুস্থ হয়েছেন অনেকে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো শহরে, যেখানে অনেক বেশি ভবন এবং পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক গাছ নেই সেখানে ভবন এবং কংক্রিটের ঘনত্ব তাপ শোষণ করে এবং আটকে রাখে, যা শহরকে তার চারপাশের তুলনায় উষ্ণ করে তোলে। এ ক্ষেত্রে তাপ কমাতে গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ গাছ ছায়া প্রদান
করে এবং মাটি ও ভবনসমূহে সূর্যালোকের পরিমাণ হ্রাস করে। উপরন্তু, গাছ একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাতাসকে শীতল করে। এ প্রক্রিয়ায় গাছ বাতাসে জলীয় বাষ্প ছেড়ে দেয়, যা আশপাশের পরিবেশকে শীতল করে।
তা ছাড়া ভারসাম্যপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখার জন্য গাছের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। গাছ বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমিত করতে সাহায্য করে। তারা মাটির স্থিতিশীলতা, ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ এবং ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতেও অবদান রাখে, বিশেষ করে পার্বত্য ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়।
যেহেতু বাংলাদেশ বন্যাপ্রবণ, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে, বন্যার প্রভাব কমাতে গাছের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নদীর তীরবর্তী এবং বন্যাপ্রবণ এলাকায়, গাছ অতিরিক্ত পানি শোষণ করে, মাটির ক্ষয় কমায় এবং বন্যার সম্ভাবনা কমায়। গাছের শিকড় মাটিকে একত্রে আবদ্ধ করতেও সাহায্য করে, যার ফলে এটি বন্যার জলে ধুয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তা ছাড়া গাছ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। ভূমিধস রোধ করার পাশাপাশি, তারা মাটি স্থিতিশীল করে এবং অতিরিক্ত জল শোষণ করে ভূমিকম্প থেকে ক্ষতির ঝুঁকি কমাতেও সাহায্য করতে পারে। উপরন্তু, কৌশলগতভাবে রোপণ করা গাছ বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে পারে, যার ফলে জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা যায়।
গাছের শিকড় মাটিকে একত্রে ধরে রাখতে সাহায্য করে, ক্ষয় রোধ করে। পাহাড়ি এলাকায়, মাটি স্থিতিশীল করে এবং ঢাল ব্যর্থতার ঝুঁকি কমিয়ে ভূমিধস প্রতিরোধে গাছ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বন্যাপ্রবণ এলাকায় পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাছের শিকড় মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি শোষণ করে, ভূপৃষ্ঠের প্রবাহ কমায় এবং ভারি বৃষ্টির সময় পানির গতি কমিয়ে দেয়। এটি মাটির ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে এবং বন্যার সম্ভাবনা কমায়। উপরন্তু, গাছের ছাউনি একটি প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে, বৃষ্টিপাতকে বাধা দেয় এবং প্রবাহের শক্তি হ্রাস করে।
বন উজাড় ও নগরায়ণের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলার জন্য আরও গাছ লাগানো এবং বিদ্যমান বন রক্ষা করা অপরিহার্য। বৃক্ষরোপণের উদ্যোগগুলো হারানো সবুজ আবরণ পুনরুদ্ধার করতে, অবক্ষয়িত ল্যান্ডস্কেপ পুনরুদ্ধার করতে এবং বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। গাছের আচ্ছাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমিত করতে পারি, মাটির ক্ষয় কমাতে পারি এবং বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল দিতে পারি।
সরকার নীতিগত হস্তক্ষেপ এবং প্রয়োগমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বন উজাড় মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আইন প্রণয়ন করতে হবে বেআইনিভাবে কাটা ও বন উজাড় ঠেকাতে, অপরাধীদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। উপরন্তু, সরকার বৃক্ষরোপণ এবং পুনঃবনায়ন প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনা ও ভর্তুকি প্রয়োগ করতে পারে। জনসচেতনতামূলক প্রচারণা নাগরিকদের গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করতে পারে এবং সংরক্ষণ কার্যক্রমে সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে পারে।
বিভিন্ন সংস্থা সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি এবং পরিবেশ সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগে অবদান রাখতে পারে। বৃক্ষরোপণ প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে, সংস্থাগুলো পরিবেশবান্ধব কর্মকাণ্ডে সম্প্রসারিত করতে পারে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে অবদান রাখতে পারে। বৃক্ষরোপণের প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করতে ও তাদের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নিশ্চিত করতে বেসরকারি খাত, সরকারি সংস্থা এবং সুশীল সমাজের মধ্যে সহযোগিতা অপরিহার্য।
বৃক্ষরোপণ উদ্যোগের সাফল্যের জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম, ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং পর্যবেক্ষণ প্রচেষ্টায় জড়িত থাকতে হবে। সম্প্রদায়ভিত্তিক পন্থা ব্যক্তিদের সংরক্ষণ প্রকল্পের মালিকানা নিতে এবং পরিবেশগত স্টুয়ার্ডশিপের অনুভূতি বিকাশ করতে সক্ষম করে।
বিভিন্ন সেক্টর জুড়ে একত্রে কাজ করে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশকে আরও সবুজ ও নিরাপদ করতে পারি। মনে রাখতে হবে, বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ শুধু পরিবেশেরই উপকার করে না, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক কল্যাণেও অবদান রাখে। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্যকে সমর্থন, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন এবং বিস্তৃত ইকোসিস্টেম পরিষেবা প্রদানের জন্য গাছ অপরিহার্য। তাদের বহুমুখী অবদান পরিবেশ এবং মানব মঙ্গল উভয়ের জন্য অমূল্য সম্পদ করে তোলে। সবার জন্য একটি টেকসই এবং স্থিতিস্থাপক ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণ প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দেওয়া অপরিহার্য।
লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]