গতকাল বুধবার উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্ব শেষ হলো। এবারের উপজেলা নির্বাচন চার পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম পর্বে ১৩৯টি উপজেলায় ভোট হলো। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কাউকে এবার দলীয় প্রতীক দেয়নি। ফলে প্রতিটি উপজেলায় দলের মধ্যে উন্মুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে।
দল থেকে যে কেউ দাঁড়াতে পারবে, তবে মন্ত্রী-এমপিদের নিকট স্বজনরা যেন না দাঁড়ায়—দলের এ নির্দেশনাকে পাত্তা দেননি অনেক মন্ত্রী-এমপি। দলীয়ভাবে নির্বাচন হচ্ছে না, কিন্তু দল এত তৎপর কেন? একটি স্থানীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে এত উত্তেজনাইবা কেন? কারণ হলো, ক্ষমতা ও অর্থ। এই প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে প্রায় ৭০ শতাংশ চেয়ারম্যান প্রার্থী ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে ৯৩ জনের এক কোটি টাকারও বেশি অস্থাবর ও তরল সম্পদ রয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানানো হয়।
বলা হচ্ছে, মানুষ ভোটের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে ফেলেছে, ভালো রাজনৈতিক চর্চা নেই, কিন্তু এরপরও রাজনীতির প্রতি একটা ভয়ংকর মোহ বা আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। কারণ রাজনীতিই এখন ‘ভালো’ জীবিকা। যদি কেউ বিত্তশালী হতে চান, সমাজের সর্বনাশ করে নির্লজ্জভাবে অর্থ উপার্জন করতে চান, তাহলে সেটা রাজনীতি করেই সম্ভব। যদি কোনোভাবে একবার ভোটে জেতা যায়, তাহলে তো অর্থ উপার্জনের অগাধ সুযোগ।
রাজনীতি, তাও যদি শাসক দলের রাজনীতি হয়, তাহলে সঙ্গে থাকবে রাজনৈতিক ক্ষমতা, অগাধ ‘মাতব্বরি’র লাইসেন্স, সব কুকর্ম ধুয়ে-মুছে সাফ করার ব্যবস্থা। আর কুকর্ম করলেইবা মনে রাখছে কে? এমনিতেই জনসাধারণের স্মৃতিশক্তি স্বল্পকালীন। দু-চার টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেই তারা খুশি। এ-হেন রাজনীতি থেকে কে দূরে থাকতে চায়?
আমরা কথায় কথায় বলি, ভালো ও শিক্ষিত মানুষের রাজনীতিতে আসা উচিত। তাতে রাজনৈতিক জগতের গুণগত উন্নতিসাধন হবে আর রাজনৈতিক দলগুলো দেশের স্বার্থে যথাযথ ও ঠিক পদক্ষেপ করতে পারবে। সমস্যা হলো, রাজনীতির উন্নতিসাধন তো দূরস্থান, বর্তমান রাজনীতির দুরবস্থা এমন যে, ভদ্রলোকের জন্য তা চারিত্রিক ও নৈতিক অবনমনের কারণ হতে পারে।
রাজনীতির মূল কথা একটি আদর্শকে লালন করে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় গিয়ে ওই আদর্শ বাস্তবায়ন। আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনকল্যাণ করা। মানুষের উপকার করা। কিন্তু এগুলো অনেক অনেক দিন আগের কথা। সেদিন এখন আর নেই। এখন যারা রাজনীতিতে আসেন তারা অধিকাংশই আখের গোছাতে আসেন। এজন্যই রাজনীতির মাঠে এখন ব্যবসায়ীদের রাজত্ব বা রাজনীতিকদের মধ্যে ব্যবসা দখলের অদম্য আগ্রহ।
যারা ব্যাপক সমালোচনা করছেন, যারা দুঃখবোধ করছেন যে রাজনীতি আর প্রকৃত রাজনৈতিক নেতাদের হাতে থাকছে না, তারা তা করতেই পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ব্যবসার মধ্যে রাজনীতি নিজেই বিলীন হয়ে গেছে। টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনা গেলে ব্যবসায়ীরা কেন রাজনীতি করবেন না? কিংবা রাজনীতি করে সব ব্যবসা হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব হলে কেন তারা দূরে থাকবেন? টাকা দিয়ে সবকিছু কেনাবেচা করা গেলে প্রার্থীদের কেন করা যাবে না? এ কারণেই মনোনয়নবাণিজ্য বাড়ছে, কারণ বেশি বেশি করে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে ঢুকছেন বা রাজনীতিবিদরা ব্যবসা দখলে নিচ্ছেন। বছরের পর বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, আমাদের রাজনীতিকদের পেছনে ফেলে শিল্পপতি ও বড় ব্যবসায়ীরা সংসদে আসছেন। এখন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোও বাদ যাচ্ছে না।
একটা প্রশ্ন হতে পারে যে, ব্যবসায়ীরা কেন ফুলটাইম রাজনীতির কাজে আসছেন? তাহলে ব্যবসা দেখে কে? সুবিধা আসলে অন্য জায়গায়। ক্ষমতার রাজনীতিতে ঢুকে পড়তে পারলেই শুধু সুবিধা আর সুবিধা। সংসদ সদস্য হলে বিনাশুল্কে গাড়ি আমদানিসহ নানা রকমের সরকারি সুবিধা। কিন্তু এটুকুর জন্য শুধু নয়, মর্যাদা বাড়ে কিন্তু তার চেয়ে বেশি বাড়ে ক্ষমতা। নিজেরাই আইনপ্রণেতা, তাই নিজেদের মতো করে আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করতে পারেন তারা। স্থানীয় সরকার কাঠামো দখলেও সেই মানসিকতাই কাজ করছে। উন্নয়নের সব কাজ তাদের দখলে থাকবে আর কারও নয়। ক্ষমতা পাওয়া গেল, বাণিজ্য সুবিধা আরও বাড়ল।
টিআইবি যে তথ্য উপস্থাপন করল দেখা যাচ্ছে, একজন প্রার্থীর আয় ১০ বছরে ১৮ হাজার গুণ বেড়েছে। এরকম করে অনেক জনপ্রতিনিধির আয়ই অস্বাভাবিক বেড়েছে। তবে হলফনামায় সঠিক তথ্য দেওয়া হয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে বলে মনে করে টিআইবি। কারণ অনেক প্রার্থী আয় খুবই কম দেখিয়েছেন। অনেক প্রার্থীর সম্পদ বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলেও মনে করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এত এত ধনী ব্যক্তির আগমন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। উন্নয়নকাজ আছে। রাস্তা নির্মাণ, ব্রিজ নির্মাণ, হাসপাতাল নির্মাণ, সরকারি কেনাকাটা আছে। ঠিকাদার চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে যাবেন। আগে এরকম গণ্যমান্যদের বাসায় মানুষ যেত ফল-মিষ্টি নিয়ে। অনেকে মাছ, মুরগি, কিছু সবজি। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশে টাকাই সবচেয়ে বড় উপহার। টাকার বিনিময়ে টেন্ডার নিয়ে আলোচনা হয়, ভাগবাটোয়ারা চূড়ান্ত হয়।
দেশে যে কেউই রাজনীতিতে আসতে পারেন। তবে রাজনীতিতে কোন পেশার লোকজনের দাপট বাড়ছে বা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে চলে যাচ্ছে সেটা অবশ্যই আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণার বিষয়। দেশের গণতন্ত্রের মান, অবস্থা ও এর ভবিষ্যতের সঙ্গে এর সম্পর্ক। সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ অনেক দিন আগে এমন একটা মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে। এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের সংসদের ৮০ ভাগই ব্যবসায়ী।’
সংসদ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। সংসদ সদস্যদের প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু এখন সংসদ সদস্যদের প্রধান কাজ ঠিকাদারের মতো যার যার এলাকায় ব্রিজ, রাস্তাঘাট করা আর নিজস্ব ব্যবসা সম্প্রসারণ করা। পিছিয়ে থাকতে চান না স্থানীয় পর্যায়ের ধনীরাও এবং তাদের বড় অংশটাই নব্য ধনিক শ্রেণির।
আগেই বলেছি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতি করার অধিকার যে কারোরই আছে। ব্যবসায়ীদেরও আছে। সমস্যা হয় তখন, যখন পুরো রাজনীতিই ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যায়। দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য এটি ভালো লক্ষণ নয়। রাজনৈতিক দলগুলো এর পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে দেশে প্রকৃত রাজনীতিকের সংখ্যা কমিয়ে ফেলছে। রাজনীতিতে যোগ দিয়েই ব্যবসায়ীরা সহজে পদ ও মনোনয়ন পেয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের শক্তি তাদের টাকা-পয়সা। নির্বাচনের খরচ দিনে দিনে যত বেড়েছে, নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে ব্যবসায়ীদের দামও তত বেড়েছে। দলগুলোতে মনোনয়নবাণিজ্যের সংস্কৃতিও শুরু হয়েছে এসব কারণেই।
ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করতে এসে দেখেছেন, রাজনীতি করলে ব্যবসায় সুবিধা মেলে। সবকিছুই হাতের মুঠোয় চলে আসে। এমন পরিস্থিতি ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আসতে উৎসাহিত করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এমন অবস্থা যখন স্বাভাবিক তখন কী করে ঠেকিয়ে রাখা যাবে তাদের স্রোত?
এক দলের ব্যবসায়ীর সঙ্গে আরেক দলের ব্যবসায়ী সাংসদের দারুণ যোগাযোগ। সাধারণ মানুষ নিজেদের মতো করে দল আর পছন্দের নেতানেত্রীকে নিয়ে নিরন্তর মেতে থাকেন রাজনৈতিক বচসায়। আর মানুষের আড়ালে ক্ষমতার অলিন্দে চলে এক অন্তহীন সম্পর্কের আদানপ্রদান। এর পুরোটাই আসলে শুধু পাওয়ার জন্য, দেশকে, দেশের মানুষকে কিছু দেওয়ার জন্য নয়।
অনেক দিন ধরে আমরা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন কথাটা শুনে আসছি। এখন পুরোটাই হলো রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ। একটা শ্রেণি খুব সফলভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিকে ব্যয়বহুল করে ফেলেছেন। ফলে সাধারণ মানুষের, সৎ মানুষের রাজনীতি কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশে যেখানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য কোটি কোটি টাকা লাগে, সেখানে কোন সৎ মানুষটা রাজনীতি করতে আসবেন বা পারবেন? এ পরিস্থিতি থেকে বের না হলে পুঁজিবাদের কাছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা আরও দুর্বল হবে। দেশ রাজনৈতিক ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হওয়া আটকাতে না পারলে ব্যবসায়ীরাই নেতা হবেন বা রাজনীতিকরা ব্যবসাটাই করবেন, জনসেবা ভুলে যাবেন।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও সমাজ বিশ্লেষক