শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
আলম রায়হান
প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৪, ০২:০৮ এএম
আপডেট : ০৫ মে ২০২৪, ০৭:৫০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রম এবং ব্যক্তির সেতু

মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রম এবং ব্যক্তির সেতু

মানবিক কাজের জন্য এখন পর্যন্ত তিনটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন মিল্টন সমাদ্দার। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত পিলে চমকানো খবর, মানবিক মুখোশের আড়ালে নানা অপকর্ম চালিয়েছেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার। এ অভিযোগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ১ মে রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তার করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর অন্যতম হলো—অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার নামে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করা। এর কদিন আগে বরিশাল থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক এবং কয়েকটি নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবর হচ্ছে ‘সরকারি খালে পারিবারিক সেতু’। এ খবরে বলা হয়েছে, ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার চল্লিশ কাহরিয়ায় দেড়শ বছরের পুরোনো সরকারি মৃধা খালে পারিবারিক সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। একটিমাত্র পরিবারের জন্য এই সেতুটির ফলে খালের পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিস্তীর্ণ এলাকা। ফলে জেলে সম্প্রদায় ও শত শত কৃষক বিপাকে পড়েছেন।

গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার আগে আশ্রম ও সেতু নির্মাণ মহান উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। দেশের মানুষ ভেবেছে, আহা মিল্টন সমাদ্দার কী মহান। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো শিশু এবং বৃদ্ধদের নিয়ে পড়ে আছেন। অসহায় মানুষকে আশ্রয় দিচ্ছেন, খাবার দিচ্ছেন, চিকিৎসা দিচ্ছেন, মৃত্যুর পর দাফন-কাফন পর্যন্ত করেন। শুধু তাই নয়, পথেঘাটে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে তাদের এনে আশ্রয় ও চিকিৎসা দিচ্ছেন। এমনকি করোনার সময়ও তার এই মহান কর্মে কোনো ছেদ পড়েনি। আহা কী মহান ব্যক্তি! এত বড় মহান না হলেও কাছাকাছি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে মৃধা খালের ওপর নিজের টাকায় সেতু নির্মাণকারী ব্যক্তিও। সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, আহা কী মহান কর্ম! নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে সেতু বানিয়ে দিচ্ছেন; কিন্তু বাস্তবতা মোটেই তা নয়। অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার নামে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করার ধান্ধা করেছেন মিল্টন সমাদ্দার। তার এই ব্যবসার জন্য অনেককে আগাম মেরে ফেলা হতো বলে অভিযোগ আছে। একই ধারায় হেঁটে একটি এলাকার লাইফ লাইন দেড়শ বছরের পুরোনো খালটিকে আগাম মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে ব্যক্তি স্বার্থে।

এ দুই ঘটনার মধ্যে আরও মিল আছে। আশ্রমের নামে অপকর্ম বহু বছর ধরে চলেছে নানান নামের বহু সংস্থার নাকের ডগায় রাজধানীতে। আর বছর ধরে সেতুর নামে খাল হত্যার তাণ্ডব চলেছে ঝালকাঠিতে। এ বিষয়টি দেখার দায়িত্বও ছিল অনেক সংস্থার। এমনকি ছাড়পত্র নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতাও ছিল। কিন্তু এর কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করা হয়নি খাল হত্যার আয়োজনে। কোনো সংস্থাই নিজ দায়িত্ব পালন করেনি। অবশ্য, গোপনে কোনো কিছু গ্রহণ করেছে কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে এ নিয়ে অনেক রটনা আছে। আর ঘটনা হচ্ছে, এলাকার জীবন প্রবাহ হিসেবে প্রাচীন মৃধা খালটি হত্যার আয়োজন করা হয়েছে একটি মাত্র পরিবারের স্বার্থে। এর বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন জেলা প্রশাসনের কাছে অনেক ধরনা দিয়েছেন এলাকাবাসী। কিন্তু কোনো পর্যায়ের কোতোয়ালদের টনক নড়েনি। তবে মানবিক মুখোশের আড়ালে মিল্টন সমাদ্দারের অপকর্মের বিষয়ে টনক নড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। আর মজার বিষয় হচ্ছে, খোদ রাজধানীতে বহু বছর চলমান এত বড় ভয়ংকর একটি অপকর্মের বিষয়ে টনক নড়ল মিডিয়ায় খবর প্রকাশের সূত্র ধরে। এ ঘটনার সঙ্গে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিষয়টি মেলানো যায়। যেমন মিলে যায় ব্যক্তি উদ্যোগে সেতুর নামে খাল হত্যার ঘটনার সঙ্গে। জানা গেছে, পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ার পর প্রশাসন খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে, তবে শম্ভুক গতিতে!

এবারের গরমে রাজধানী মোটামুটি পুরান ঢাকার বাকরখানি তৈরির উনুনে পরিণত হয়েছিল। কারণ প্রধানত দুটি। এক. কথিত উন্নয়নের নামে বৃক্ষকে দানব বিবেচনা করে নিধন। দুই. জলাধারকে প্রতিপক্ষ ভেবে ভরাট করা। এ ধারায় গত তিন দশকে রাজধানী থেকে হারিয়ে গেছে কয়েকশ পুকুর। এসব পুকুর ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে আবাসিক ভবন, মার্কেটসহ নানান স্থাপনা। আর হাতেগোনা যেসব পুকুর টিকে রয়েছে, সেগুলোও ধুঁকছে। রাজধানী ঢাকার সীমানা ১৯২৪ সালের টপোগ্রাফি মানচিত্রে ছিল অনেক ছোট। উত্তরে শাহবাগ, দক্ষিণে চর ইউসুফ ও চর কামরাঙ্গী, পশ্চিমে ধানমন্ডি এবং পূর্বে ছিল মতিঝিল ও ইংলিশ রোড। এসব এলাকার মধ্যবর্তী অংশকে দেখানো হয় ওই মানচিত্রে। আর এ ছোট সীমানার মধ্যেও অন্তত ১২০টি পুকুর ছিল। ১৯৮৫ সালে এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় পুকুরের সংখ্যা ছিল দুই হাজারেরও বেশি। অথচ এর পরের তিন দশকে এসব পুকুরের ৯০ শতাংশই হারিয়ে গেছে। জানা গেছে, ১ হাজার ৯০০ সরকারি-বেসরকারি মালিকানার পুকুর ও জলাধার ভরাট হয়েছে তাতে জমির পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার হেক্টর। সর্বশেষ ২০২১ সালে রাজধানীর পুকুর নিয়ে জরিপ ও গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় এখন সাকল্যে ২৪১টি পুকুর কোনোমতে টিকে আছে। প্রায় সবগুলোরই মরণদশা! পুকুর নিয়ে এই তাণ্ডব কেবল রাজধানীর নয়, পুরো বাংলাদেশেরই চিত্র। এ ধারায় বিলীন হচ্ছে নদী-খালও। আবার নদী-খালে নেই পানি। এই নদী-খালের অস্তিত্ব কতদিন থাকতে পারবে, সেটাই বড় উদ্বেগের বিষয়। একদিকে নদী ও খাল দূষণ, অন্যদিকে নদী খনন কাজে দক্ষতা ও সততার অভাবে নদনদীগুলোর পলি অপসারণ করার পরপরই আবার ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে সারা দেশের জলাধারের কী অবস্থা এবং কী পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে, তা কল্পনাতীত। জলাধার কমে যাওয়ায় পরিবেশ রক্ষা করা এখন চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে তাণ্ডব চলছে, তাতে অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, দেশে কি খাল-বিল ও পুকুর থাকবে না?

জানা কথা, জলাধারের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বেড়েছে নলকূপের ব্যবহার। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে দ্রুত। দাঁড়াচ্ছে এই, মুখোশের আড়ালে ভয়ংকর অপরাধী কেবল রাজধানীর মিল্টন সমাদ্দার নয়। আর পানির সর্বনাশকারী কেবল ঝালকাঠির সাইদুল নয়, এ রকমের ঘাতক আছে অগণিত। পুরো দেশেই খাল দখল করে দোকানপাট-বাড়িঘর নির্মাণের সর্বনাশা ধারার সঙ্গে সমান তালে যুক্ত সেতু নির্মাণের তাণ্ডব। আর এসব কেবল ব্যক্তি উদ্যোগে নয়, চলে সরকারি ব্যবস্থাপনায়ও। পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিডি, বিএডিসি থেকে শুরু করে ত্রাণ মন্ত্রণালয়—সবাই যেন উন্নয়নের নামে পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সবার চেতনায় যেন সেই সংলাপ, ‘কাপ্তান বদ করো!’ আর পানির বিরুদ্ধে চলমান তাণ্ডব ঠেকানোর যেন কেউ নেই। অথবা হয়তো এমনও ভাবা হতে পারে, যেখানে নদীই দখল হয়ে যাচ্ছে, সেখানে খাল দখল নিয়ে ভেবে গোলমাল বাধানোর কোনো মানে হয় না। অথচ পুকুর-নদী-খাল-বিল দখল ভরাটের প্রভাবে যে কি দশা হয়েছে; তার খানিকটা কিন্তু এবার আগুন গরম জানান দিয়েছে। কিন্তু আমাদের হুঁশ হয়েছে বলে মনে হয় না। ফলে জাতির কপালে মহাদুর্দশা আছে বলেই মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্র-সরকার-জনগণ এবং পরিবেশকর্মীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই হয়তো পারবে আমাদের এই বাংলার এক সময়ের ভরপুর জলাধারের অবশিষ্টটুকু রক্ষা করা। অন্যথায় আমাদের অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হতে হবে। যার খানিকটা প্রমো দেখা গেল এবার।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১০

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১১

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১২

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৩

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৪

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৫

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

১৬

জুলাই বিপ্লবে আহত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বাবুকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড

১৭

মাদকাসক্ত ছেলেকে কারাগারে দিলেন মা

১৮

কপ২৯-এর এনসিকিউজি টেক্সট হতাশাজনক : পরিবেশ উপদেষ্টা

১৯

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নিরাপদ থাকবে যেসব দেশ

২০
X