মানুষ পৃথিবীতে ভালো-খারাপ যা-ই করবে, পরকালে সব দৃশ্যমান হবে এবং প্রতিটি কাজের প্রতিদান দেওয়া হবে। হাশরের মাঠে ভালো কাজগুলো সুদর্শন হয়ে আসবে এবং ভালো প্রতিদান দেওয়া হবে। আর মন্দ কাজগুলো কুৎসিত হয়ে আসবে এবং মন্দ পরিণাম দেওয়া হবে। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর পছন্দনীয় কাজ করে আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন আর যে ব্যক্তি আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ করে আল্লাহ তার ওপর ক্ষুব্ধ হন। একইভাবে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি মুসলমানের প্রতি সহজ আচরণ করবে, আল্লাহ তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাত সহজ করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়ার একটি কষ্ট দূর করে দেয়, আল্লাহ তার কেয়ামতের কষ্ট দূর করে দেবেন। কাজেই পৃথিবীতে একজন মানুষের পরম লক্ষ হবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন। মানুষ আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছলেই বলা হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি বা নৈকট্য লাভ হয়েছে। এজন্য একমাত্র উপায় সাধনা, মুজাহাদা ও আল্লাহর ইবাদতে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনকাবুত : ৬৯)
মহান আল্লাহর ইবাদত, দাসত্ব এবং সংযম, সাধনা কিংবা আল্লাহর ইবাদত অর্জনের জন্য ভালো-মন্দ, কল্যাণ ও অকল্যাণের ব্যবধান এবং বোধ সৃষ্টি করতে হবে। যে বোধ ভালোকে অর্জন ও মন্দকে বর্জন করতে সাহায্য করবে। আমরা নদীর মোহনায় দেখি, পাশাপাশি দুটি নদীর পানি। একটি নোনা, অন্যটি মিষ্ট। একটি পরিচ্ছন্ন, অন্যটি ঘোলাটে। একটি আরেকটির সঙ্গে মেশে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা এর দৃষ্টান্ত দিয়ে বান্দাকে শিখিয়েছেন—‘তিনি দুই সমুদ্রকে মুখোমুখি করে প্রবাহিত করেছেন, যারা পরস্পরে মিলিত হয়। তবে উভয়ের মধ্যে রয়েছে এক অন্তরাল, যার কারণে তারা অতিক্রম করতে পারে না।’ (সুরা আর-রহমান: ১৯-২০)। আল্লাহ বলতে চান—দেখো আমার বান্দা, ভালো-মন্দ একসঙ্গে থাকবে। কখনো একইরকম মনে হবে। তাই বলে মন্দকে গ্রহণ করা যাবে না।
আল্লাহতায়ালা দোষ ও গুণ দুটিই সৃষ্টি করেছেন। ক্ষেত্রবিশেষ দুটিকে একইরকম দেখা যায়। যেমন বদান্যতা ও অপব্যয়, নম্রতা ও হীনতা, অহংকার ও আত্মমর্যাদাবোধ, আল্লাহর জন্য সম্পর্ক নষ্ট করা এবং রাগের বশবর্তী হয়ে সম্পর্ক নষ্ট করা। এসব বিপরীতমুখী দোষ ও গুণ দেখতে একরকম মনে হলেও এর প্রভাব, প্রতিক্রিয়া, উদ্দেশ্য এবং ভিত্তির মধ্যে রয়েছে বিরাট ব্যবধান। যেমন—দানশীলতার উদ্দেশ্য হয় অন্যের সেবা ও উপকার আর অপব্যয়ের উদ্দেশ্য হয় নিজের ভোগ-বিলাস ও বাবুগিরি। নম্রতার ভিত্তি হয় শিষ্টাচার ও ভদ্রস্বভাব আর হীনতার ভিত্তি হয় লোভ-লালসা বা লজ্জাশূন্যতা। অহংকারের ভিত্তি হয় অন্যকে হেয় মনে করা, এর প্রতিক্রিয়া হয় ন্যায় ও সত্যকে উপেক্ষা করা আর আত্মমর্যাদাবোধের ভিত্তি হয় অপমানজনক বিষয়কে এড়িয়ে চলা। যার প্রতিক্রিয়া হয় হীনস্বভাব পরিহার করা। আল্লাহর জন্য রাগান্বিত হওয়া, যার প্রতিক্রিয়া হয় নিজের পছন্দনীয় হলেও আল্লাহবিরোধী বিষয় পরিহার করা আর ব্যক্তিগত রাগের কারণে সম্পর্ক নষ্ট হলে তা হীনস্বার্থবিরোধী ভেবে সম্পর্ক নষ্ট হয়, যদিও সে ব্যক্তিটি দোষী না হয়।
ভালো-মন্দ দুটিই মানুষের সামনে আসবে। মুমিনের কাজ হবে মন্দ স্বভাব পরিহার করে ভালো গুণ অর্জন করা। ভালো গুণ চেনার জন্য কোথাও যাওয়া লাগে না। মানুষের রুচিবোধ এবং কলবই (হৃদয়) বলে দেয় কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ। কোনটি গ্রহণীয়, কোনটি বর্জনীয়। এ সম্পর্কে পবিত্র হাদিসের বর্ণনা রয়েছে। সাহাবি ওয়াবেছা (রা.) নবীজির দরবারে হাজির হলেন। নবীজি বললেন, হে ওয়াবেছা! তুমি নেক-বদ ও ভালো-মন্দের ব্যবধান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে এসেছ? সাহাবি বললেন, জি, ইয়া রাসুলাল্লাহ। নবীজি তার বুকে আলতো থাপ্পড় দিয়ে বললেন, ইসতাফতি কল্বিকা। অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের বিচার তোমার বিবেকের কাছে জিজ্ঞাসা করো। এ কথাটি তিনবার বলে নবীজি (সা.) বললেন, নেক, সওয়াব ও ভালো হচ্ছে—যার ওপর বিবেক আশ্বস্ত হয়। অন্তর শান্তি পায়। খারাপ ও গুনাহ হচ্ছে, যে ব্যাপারে বিবেকে খটকা লাগে, অন্তরে দ্বিধা ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়। (মুসনাদে আহমদ : ৪/২২৮)
ভালো স্বভাব অর্জনের জন্য। সুবোধ হওয়া এবং এর ওপর অবিচল থাকার জন্য নবীজি (সা.) দোয়া করতেন—‘আল্লাহুম্মা আরিনাল হাক্কা হাক্কাও, ওয়ারজুকনা ইত্তিবাআ। ওয়া আরিনিল বাতিলা বাতিলাও ওয়ারজুকনা ইজতিনাবা।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, আমাকে ভালোকে ভালো করে দেখাও, এর ওপর আমল করার তওফিক দাও এবং মন্দ ও খারাপকে খারাপ করে দেখাও, এর থেকে বেঁচে থাকার তওফিক দাও।
এভাবে প্রতিদিন মুমিন বান্দা তার রবের কাছে দোয়া করবে আর নিজের ভেতরকার মন্দ স্বভাবগুলো পরিহার করবে। তাহলেই তো ইবাদত ভালো লাগবে। এর সুফল পাওয়া যাবে। আল্লাহ আমাদের ভালো গুণ এবং বেশি বেশি আমলের মাধ্যমে অধিক সওয়াব অর্জনের তওফিক দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতিব