বর্তমান সরকার কি লালন ফকিরের গান নিষিদ্ধ করেছে? এরকম একটা চিন্তা হয়তো অনেকে করতে পারেন। যদিও বাস্তবে তা ঘটেনি। ফেসবুক স্টোরিতে মরমি সাধক লালন সাঁইয়ের গানের দুটি লাইন উদ্ধৃত করায় সঞ্জয় রক্ষিত (৪০) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে এ ঘটনা ঘটে গত রোববার। সঞ্জয় রক্ষিত নামের ওই যুবক ফেসবুকের স্টোরিতে লেখেন, ‘সুন্নতে খাতনা দিলে যদি হয় মুসলমান, তাহলে নারী জাতির কি হয় বিধান।’ এ দুটি লাইন লালনের ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’ গানের। সঞ্জয়ের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিষার ইউনিয়নে। তিনি পেশায় একজন স্বর্ণাকার।
পুলিশ জানিয়েছে, সঞ্জয় এ পোস্ট দেওয়ার ফলে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়। রোববার দুপুরে উপজেলার সাজানপুর এলাকার তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভেদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিন্টু মণ্ডল জানান, ফেসবুকে ইসলাম ধর্মের বিধান নিয়ে ‘কটূক্তি করায়’ এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারা অভিযোগ করেছেন, জানতে চাইলে ওসি তাদের নাম উল্লেখ না করে বলেন, স্থানীয় কয়েকজন এ অভিযোগ করেছেন।
এতে পরিষ্কার হলো, সমস্যা আসলে সেই ওসির মধ্যেই। তারই মনে হয়েছে যে, সঞ্জয় যিনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। যদি কেউ বলেও থাকেন তাতেই তিনি গ্রেপ্তার করে ফেলবেন এই মানুষটাকে। এই আমাদের পুলিশ বাহিনী?
ধরে নিলাম যে পুলিশ সঞ্জয় রক্ষিতকে ধরে নিয়ে গেছে তারা লালন সম্পর্কে জানে না বলে। কিন্তু পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তা কি দৃষ্টিগোচর হয়নি? তাদের এত সময় লাগল এর সমাধান করতে? তারা তো উচ্চশিক্ষিত এবং কত কত বয়ান দেন নিয়মিত! প্রসঙ্গত, এই গানটি অতি জনপ্রিয় এবং যুগ যুগ ধরে বাজছে দেশের আনাচে-কানাচে।
এ দুই লাইনে যার ধর্মে আঘাত লাগে তার মতো লোকের ধর্মচর্চাই অধর্ম। তবে কি হিন্দু বলেই সঞ্জয়কে টার্গেট করা হয়েছে? এসব প্রশ্ন আসতে পারে এবং আসছেও। যারা সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে এমন অসহিষ্ণু, তারা বুঝতে পারছেন না যে, আরেকটা দেশে তারা নিজেরাই সংখ্যালঘু।
ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান তৈরি হওয়ায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চাইত সবসময় এ বিষয়টা জিইয়ে রাখতে। কিন্তু তাদের তো আমরা পরাজিত করেছিলাম ১৯৭১-এ। এক বিশাল ভয় বা আতঙ্ক ধীরে ধীরে গ্রাস করছে মনে। এই রবীন্দ্র-নজরুল-লালনের বাংলায় সম্প্রীতির যে পরিবেশ এবং তা বজায় রাখার যে স্পৃহা মানুষের মধ্যে ছিল, তা কেমন যেন এখন ঠুনকো হয়ে ভেঙে পড়ছে। সমাজের এক অংশ যখন যুক্তিকে হারিয়ে, বিক্রিত বিকৃত আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন বলতেই হয়, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আমাদের সমাজের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে।
দুঃখজনক যে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এরকম গ্রেপ্তার অনেক দেখতে হচ্ছে আমাদের। লালনের গান, লালন উৎসব নিয়ে সরকারের ভেতরেই একটা অস্বস্তি আছে বলে মনে হয়। এ বছর মার্চ মাসে কুষ্টিয়ায় লালন স্মরণোৎসব একেবারে সংক্ষিপ্ত করতে বাধ্য করেছে সরকার। তিন দিনের জায়গায় উৎসব হয়েছে এক দিন, হতে দেয়নি গ্রামীণ মেলা। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ তার জীবদ্দশায় ছেঁউড়িয়ার এ আখড়াবাড়িতে প্রতি বছর চৈত্রের দৌলপূর্ণিমা রাতে বাউলদের নিয়ে সাধুসঙ্গ উৎসব করতেন। তার মৃত্যুর পরও এ উৎসব চালিয়ে আসছে তার অনুসারীরা। এবার সেটাও হতে পারেনি।
২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নিপীড়িত হয়েছেন বাউল, কবি, সাহিত্যিক এবং নাট্যকর্মী। সেই আইন নামে বদলেছে, কিন্তু বিধিগুলো রয়েই গেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল একটি উদার ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া। অথচ সেই সেক্যুলার স্পেসটাই কমে গেছে দেশে। সম্প্রীতির চারণভূমিতে কেন এত সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা?
শিক্ষিত সমাজের একটা অংশ আমরা দেখতে পাচ্ছি যুক্তিকে হারিয়ে বিকৃত আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়ে সহিংসতা ও উগ্রবাদ ছড়াচ্ছে। গোঁড়ামি আর অশিক্ষা আমাদের সমাজে অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। শিক্ষিত গোঁড়ারা সমাজ এবং সংস্কৃতিকে ধর্মীয় মোড়কে সবসময় ব্যাখ্যা করতে চায়। তার ফলে সমস্যার গতিপ্রকৃতি সবসময় হয়ে ওঠে একমুখী। বিস্তার লাভ করে মতের ভিন্নতা থেকে সরে আসায়, জন্ম নেয় বিদ্বেষ।
আমরা জানি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বা সামাজিক অগ্রগতি আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে কি মনমানসিকতার উন্নয়ন হচ্ছে? আমার মনে হয় তা ঘটছে না। একশ্রেণির জনগোষ্ঠী যেভাবে সংখ্যালঘু বিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ করে, নারী প্রগতি বিরোধী মনোভাব লালন করে, যেভাবে হিজরা এবং ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি বৈরিতা দেখায়, তাতে আসলে সব ভালো ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ে।
লালন, ফকির মজনু শাহ কিংবা রাধা রমনদের গানের কথায় যাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে লাগে তারা আসলে এ সমাজে পরিকল্পিত অস্থিরতা চায়। এ বহুচর্চিত বিষয়গুলো এখন আবার লিখতেই তো অবাক লাগছে। এর জন্য কারা দায়ী? দায় নিতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই। ভোটের কারণে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে রাজনীতি চলে, সেটা আমরা সবাই বুঝতে পারি। কিন্তু তাই বলে অন্ধকারের শক্তির সঙ্গে এত আপস? তার জন্য ভুগতে হচ্ছে সব মানুষকে। ভোটসর্বস্ব, ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনীতির শিকার আমাদের এ সম্প্রীতির বাংলাদেশ। এ রাজনীতি, এ আপসকামিতা অশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সম্প্রীতির শান্ত, স্নিগ্ধ বার্তা আজ ঘৃণা আর ভয়ের কালো থাবায় দিশেহারা। হতাশা প্রকাশ পাচ্ছে হানাহানির মধ্যে।
হিংস্রতা মনোজগতে কতটা জায়গা নিলে একটি বহুল প্রচলিত গানে ধর্মীয় অনুভূতির উপকরণ খুঁজে পায়? আজ চারদিকে উন্নয়ন সবচেয়ে উচ্চারিত শব্দ। অথচ এ সমাজেই ধর্মের জিগির তুলে, কাউকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে গা কাঁপছে না অনেকের। যেভাবে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে একের পর এক হিন্দু তরুণ যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, জনপদে জনপদে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো হয়েছে, যেভাবে মন্দিরে কোরআন রেখে দেশব্যাপী পূজামণ্ডপে আগুন দেওয়া হয়েছে, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তাতে ক্ষতিটা কার হলো বা হচ্ছে? অথচ রাজনৈতিক নেতৃত্ব সব মেনে নিচ্ছে। অর্থ, ক্ষমতা আর আধিপত্যের চর্চায় আসক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে সাধারণ মানুষ কি শুধুই দাবার ঘুঁটি?
এ সমাজে এখন উদার ও অসাম্প্রদায়িক মানুষের জায়গা নেই। চারদিকে শুধু ভয়ের দেয়াল ঘিরে ফেলছে মানুষকে। শিক্ষিত বিবেকের এখন বড়ই অভাব। যুক্তি দিয়ে সমস্যাকে বোঝা এবং তার সমাধানের চেষ্টা তাই এখন বিশেষভাবে জরুরি।
রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বলতে হবে তারা আসলে চান কী? সম্প্রীতি ও ঐক্যের মামুলি আহ্বানের মধ্যেই সীমায়িত বক্তব্য দিয়ে দিয়ে ওপরে ওপরে প্রলেপ দেবেন নাকি সত্যি ঘা সারাবার চেষ্টা করবেন? ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ তন্ত্রের চাপ সাংবিধানিক নৈতিকতার স্খলন করছে। সরকার এরই মধ্যে তাদের ফাঁদে পড়েছে। এই গোষ্ঠী যা বলছে সেটাই ঘুরে-ফিরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি এখন রাজনীতির হাতিয়ার। রাষ্ট্রশক্তি যখন মৌলবাদী শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে, তখন তা ভয়ের কারণ হয়। বিশেষত, আমাদের মতো দেশে, যেখানে ছো্ট একটি ভূমিতে বিশাল জনসংখ্যা এক বড় মাথাব্যথার কারণ। আইনশৃঙ্খলা দমননীতির দ্বারা পরিচালিত করে সব সমাধান করা যায় না। কোনো চিন্তাভাবনার অবকাশ নেই। শিক্ষিতরাই অশিক্ষা-কুশিক্ষা ছড়াচ্ছেন। মানুষের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে জাগানোর কাজ করছে রাজনীতি এবং সেটা তাদের নিজেদের স্বার্থেই।
আমরা বলে থাকি যে, আবার একটা নবজাগরণের খুব দরকার আমাদের, না হলে সম্প্রীতি তাই শুধুই খাতা-কলমে আর মহাপুরুষদের বাণীর মধ্যে থেকে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কোথাও কোনো উদ্যোগ নেই। দেশের নানা প্রান্তে শিক্ষিত উৎকর্ণ উৎকণ্ঠিত নাগরিক আজ হতাশ বোধ করছেন। নানা ভাবনা, চিন্তা, নীতি ও ন্যায়ের এপিঠ-ওপিঠ সেমিনারে, কর্মশালায় বা আলোচনায় উঠে আসবে। কিন্তু সুরাহা হবে না।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন