প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪, ০৩:৫০ এএম
আপডেট : ০১ মে ২০২৪, ০৮:৫৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিক দলও কি একীভূত হয়ে যাবে

রাজনৈতিক দলও কি একীভূত হয়ে যাবে

বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে নানা সুশাসনের অভাব, অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয় আলোচনায় আছে দীর্ঘদিন ধরেই। একটি দেশের অর্থনীতির জন্য সবল ব্যাংক খাত সবচেয়ে বড় সূচক। কিন্তু বাংলাদেশে এখানেই সবচেয়ে বড় ঘাটতি। ঋণ নিয়ে টাকা মেরে দেওয়ার সবচেয়ে বড় খাত ব্যাংক। খেলাপি ঋণ লাখো কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের এ টাকা মেরে দিয়ে আরাম-আয়েশে দিন কাটায় অল্প কিছু বড়লোক। বাংলাদেশে এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৬১টি ব্যাংক আছে। ছোট দেশে এত ব্যাংক দরকার কি না, আলোচনা আছে তা নিয়েও। বিভিন্ন সময়ে সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক ব্যাংকের অনুমতি দিয়েছে। যার অনেকগুলো শেষ পর্যন্ত উদ্যোক্তাদের টাকা বানানোর মেশিনে পরিণত হয়েছে। দেশ, অর্থনীতি বা সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসেনি। ব্যাংক খাতে সংস্কারের আলোচনাও দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের একীভূত করার উদ্যোগ নেয়। ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৪০টি ভালো করলেও বাকিগুলোর অবস্থা ভালো নয়। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, ব্যবস্থাপনা ও তারল্য—এ চারটি সূচকে প্রত্যাশিত মানদণ্ডের নিচে থাকা ব্যাংকগুলোই ‘দুর্বল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংক, সোনালী ও বিডিবিএল, কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, সিটি ও বেসিক ব্যাংক এবং ইউসিবি ব্যাংকের সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংকের সমঝোতা স্মারক সই হলেও বাকিদের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এরই মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ইউসিবির সঙ্গে একীভূত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেসিক ব্যাংকের কর্মীরাও সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চায় না।

সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের একীভূতকরণেই সমস্যার সমাধান কি না, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এতগুলো ব্যাংকের দরকার নেই। আর শেষ পর্যন্ত পারফরম্যান্সের ওপরই নির্ভর করবে ব্যাংকের টিকে থাকা না থাকার প্রশ্ন। অনেকের শঙ্কা, দুর্বল ব্যাংকগুলো সবল ব্যাংকগুলোকেই আরও দুর্বল করে দেয় কি না। তবে অনেকে বলছেন, দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত ব্যাংকগুলোর লুটপাট, অনিয়ম আড়াল করতেই সেগুলো একীভূত করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল ফারমার্স ব্যাংক। সীমাহীন অনিয়মে শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যাংকটি। শেষ পর্যন্ত নাম বদলে ফারমার্স ব্যাংককে পদ্মা ব্যাংক বানিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়। এখন সেটি এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। কিন্তু ফারমার্স ব্যাংক বা পদ্মা ব্যাংকে যে লুটপাট হয়েছে, তার কী হবে। শেখ আবদুল হাই বাচ্চু যে বেসিক ব্যাংককে ফোকলা করে দিয়েছেন, এটা সবাই জানে। মামলাও হয়েছে। এখন বাচ্চুর বিচার না করে বেসিক ব্যাংককে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করলেই কি সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। কার্পেটের নিচে ময়লা রাখলে খালি চোখে ঘর পরিষ্কারই লাগে। কিন্তু আসলে পরিষ্কার হয় না। সত্যিকারের সংস্কার করতে হলে, ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোর দুর্বলতার জন্য যারা দায়ী তাদের চিহ্নিত করতে হবে, বিচার করতে হবে। লুটে নেওয়া টাকা ফিরিয়ে আনা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই কেবল ব্যাংক খাত সত্যিকারের সবল হবে।

তবে আমার আজকের লেখার প্রসঙ্গ ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ নয়। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির (রওশন) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ব্যাংকের মতো বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলও একীভূত হবে। কাজী ফিরোজ রশীদ একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ধাপে ধাপে তিনি এমপি হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। তাই রাজনীতি নিয়ে তার এ শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে তার মূল্যায়ন হলো, ‘রাজনীতি নিয়ে অপরাজনীতি চলছে। হঠাৎ করে বড়লোক হওয়ার একমাত্র পথ এখন রাজনীতি। জীবনে যাদের টিন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর) ছিল না, তারা আজ প্রাডো জিপ চালায়। অনেকে রাতারাতি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন। এভাবে রাজনীতিশূন্য হলে দেশ ও রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘আগামীতে দুটি মার্কা ছাড়া অন্য কোনো মার্কা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননও নিজেদের মার্কা বাদ দিয়ে নৌকায় উঠেছেন। তারপরও অনেককে ডুবে যেতে হয়েছে। নির্বাচন এখন নির্বাচনে নেই, নেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এখন একটি দলের মধ্যেই হয় নির্বাচন।’

কাজী ফিরোজ রশীদ যা বলেছেন, তা আসলে শঙ্কার পর্যায়ে নেই। এখন বাংলাদেশের নিরেট বাস্তবতা এটি। বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা এখন রাজনীতি। সাকিব আল হাসানের মতো তারকারাও তাই খেলা ছাড়ার আগে এমপি বনে যান। একসময় জমিদাররা রাজনীতি করে নিঃস্ব বনে যেতেন। আর এখন নিঃস্ব লোকজন রাজনীতির আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়ায় রাতারাতি কোটিপতি বনে যান। চতুর ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা দেওয়ার বদলে নিজেরাই রাজনীতিবিদ বনে যান। রাজনীতিতে এখন রাজনীতিবিদের বড়ই অভাব। ছাত্ররাজনীতি এমনভাবে কলুষিত হয়েছে, সেখান থেকে জাতীয় নেতা বানানোর পাইপলাইনটাও এখন রুদ্ধপ্রায়। রাজনীতি এখন ব্যবসায়ী আর আমলাদের নিয়ন্ত্রণে।

তবে কাজী ফিরোজ রশীদ রাজনৈতিক দলগুলোর একীভূত হওয়ার যে শঙ্কার কথা বলেছেন, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশে এখন ৪৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। নিবন্ধনের বাইরেও সক্রিয়, নিষ্ক্রিয়, মৌসুমি সক্রিয় দল রয়েছে অগুনতি। কোনো নির্বাচন সামনে এলেই কিছু দল হালুয়া-রুটির লোভে মাঠে নামে। তবে বাংলাদেশে মূলত দ্বিদলীয় ধারা বিরাজমান। আওয়ামী লীগ-বিএনপি ছাড়া বাস্তবে আর কারও কোনো বলার মতো ভোট নেই, মাঠে প্রভাব নেই। নীতি-আদর্শেরও বালাই নেই। এ দুই দলের বাইরে জাতীয় পার্টির কিছু ভোট ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের ছায়ায় থাকতে থাকতে এর আর বিকাশ তো ঘটেইনি; বরং দুর্বল হতে হতে, ভাঙতে ভাঙতে জাতীয় পার্টি এখন বিলীন হওয়ার পথে। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীরও কিছু ভোট ছিল। কিন্তু নিবন্ধনহারা জামায়াত এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। বিএনপির সঙ্গে মান-অভিমান থাকলেও শেষ পর্যন্ত জামায়াতের ভোট বিএনপির বাক্সেই যাবে। ১৪ দল বলুন আর মহাজোট, সব শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগই। চারদলীয় জোট বলুন, ২০-দলীয় জোট বলুন, গণতন্ত্র মঞ্চ বলুন; সব শেষ পর্যন্ত বিএনপিই। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাই শেষ কথা।

কাজী ফিরোজ রশীদ যাদের নাম বলেছেন; সেই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন বাংলাদেশের প্রবীণ তিন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাদের তিনজনেরই নিজেদের নিবন্ধিত ও সুপরিচিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। কিন্তু এমপি হওয়ার লোভে তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও প্রতীক রেখে আওয়ামী লীগের নৌকায় উঠেছিলেন। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও হাসানুল হক ইনুর। প্রশ্ন হলো নৌকা মার্কা নিয়ে যদি নির্বাচন করবেন; তাহলে জাতীয় পার্টি (জেপি), জাসদ বা ওয়ার্কার্স পার্টির আলাদা অস্তিত্বের দরকার কী? তবে বাস্তবে না হলেও রাজনৈতিক দলের একীভূতকরণের ধারণাটাই কিন্তু এনেছে কাজী ফিরোজ রশীদদের জাতীয় পার্টিই। কাগজে-কলমে আলাদা হলেও জাতীয় পার্টি আসলে অনেক আগেই আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সুবিধামতো তারা কখনো একসঙ্গে, কখনো আলাদা নির্বাচন করে। গত তিনটি সংসদেই জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দল। কিন্তু জাতীয় পার্টিকে কেউ বিরোধী দল মনে করে না। সবাই আদর করে বলে গৃহপালিত পোষা বিরোধী দল। একই সঙ্গে প্রধান বিরোধী দল এবং মন্ত্রিসভায় থাকার বিরল রেকর্ড করেছে দলটি।

গণতন্ত্র মানে বহু দল, বহু মত। কিন্তু বাংলাদেশে বহু দল থাকলেও বহু মতের ধারণাটাই আর নেই। আলাদা দল হলেও ছোট দলগুলো বাংলাদেশে বড় দুই দলের ছায়ার নিচে থাকতেই পছন্দ করে। তবে আমার ধারণা বাস্তবে যাই হোক, কাগজে-কলমে রাজনৈতিক দল একীভূত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তাতে ছোট দলগুলো দরকষাকষি করার ক্ষমতা হারাবে। ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কেবলা বদলানোর সুযোগ হারাবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

টাইম জোনের ধারণা এসেছে যেভাবে

সরকারের চাপে বাধ্য হয়ে ওজন কমালেন ৫৪২ কেজি

উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশে নজর জিনপিংয়ের

‘উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে আ.লীগ সরকার’

২৩ নভেম্বর: ইতিহাসের আজকের এই দিনে

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

আজকের নামাজের সময়সূচি

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

১০

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

১১

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

১২

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

১৩

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

১৪

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

১৫

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

১৬

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১৭

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১৮

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১৯

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

২০
X