স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ উপজেলা। গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের ঠিক চার মাসের মাথায় শুরু হতে যাচ্ছে উপজেলা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। চার ধাপে দেশের ৪৮১টি উপজেলায় নির্বাচন হবে। আগামী ৮ মে প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলায় ভোট গ্রহণ হবে। তবে এ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠে অন্যরকম উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ঘরেই অশান্তির আগুন জ্বালিয়েছে উপজেলা নির্বাচন। তবে দুই দলের সমস্যা দুই রকম। উপজেলা নির্বাচন এখন দিল্লিকা লাড্ডুর মতো। বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে পস্তাচ্ছে। আর আওয়ামী লীগ পস্তাচ্ছে গিয়ে। দুদলই নির্বাচন নিয়ে অস্বস্তিতে আছে। সেই অস্বস্তির প্রমাণ মিলছে বারবার সিদ্ধান্ত বদলে।
২০০৯ সালের পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে বিএনপি। সুবিধামতো তারা নির্বাচনে যায়, সুবিধামতো বর্জন করে। দারুণ অনুকূল পরিবেশ থাকার পরও ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। তাদের সেই বর্জন বাংলাদেশের রাজনীতির আজকের একতরফা পরিস্থিতির জন্য অনেকটাই দায়ী। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়েছিলেন বিএনপি প্রার্থীরা। সেবার বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে গেলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত। অন্তত রাজনীতিতে ভারসাম্যটা বজায় থাকত। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়—এ দাবিতে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করলেও দাবি পূরণ ছাড়াই ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। কিন্তু ততদিনে পাল্টে গেছে পরিস্থিতি। আওয়ামী লীগ আরও দৃঢ় ও কঠোর হয়েছে। নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে নামকাওয়াস্তে অংশগ্রহণ করা সেই নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি ঘটে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মাত্র সাত আসন পাওয়ায় সে ফল বর্জন করে বিএনপি, সিদ্ধান্ত নেয় সংসদ বর্জনের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারা আবার সংসদে যোগ দেয়। কেন বর্জনের সিদ্ধান্ত, কেন আবার যোগদান—তার পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। অন্য সাংসদরা যোগ দিলেও দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল আবার যোগ দেননি। এক যাত্রায় দুই ফল কেন, তারও কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। আবার মাঝপথে সাংসদরা পদত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন সংসদ থেকে। কেনে গেলেন, কেন বেরোলেন—তারও কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়েও বিএনপির দোদুল্যমানতা ছিল স্পষ্ট। কখনো যাচ্ছে, কখনো যাচ্ছে না। যেমন এবারের উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিএনপির দোদুল্যমানতা দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিপাকে ফেলেছে। প্রথম ধাপের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন পার হওয়ার পর বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে তার আগেই অনেকে মনোনয়নপত্র দাখিল করে ফেলেছিলেন। শেষ মুহূর্তে দলের নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তও তাই অনেকে মানতে পারেননি। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপেই অন্তত ৩৮ জন বিএনপি নেতা নির্বাচনের মাঠে আছেন। এর মধ্যে ১৮ জন পদধারী নেতা। এ ছাড়া সমর্থক-স্বজন ধরলে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। বিএনপি কি নির্বাচনে যাওয়ার অপরাধে এ নেতাদের বহিষ্কার করবে? বিএনপি কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবী দল নয়। তারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। যারা নির্বাচনী রাজনীতিতে চলে। কিন্তু বছরের পর বছর নির্বাচন বর্জন করায় বিএনপির তৃণমূল জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তৃণমূল নেতারা তাই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই বিচ্ছিন্নভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তাতে অবশ্য ভালো ফল আসছে না। এভাবে যদি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অপরাধে একের পর এক নেতাদের বহিষ্কার করা হয়, তাহলে বিএনপির তৃণমূল একসময় নেতৃত্ব সংকটে পড়বে।
তবে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের সংকট আরও তীব্র। বিএনপি বর্জন করায় গত জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি করতে নির্বাচন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয় আওয়ামী লীগ। তাতে ভরাডুবি ঘটে অনেক বাঘা বাঘা এমপি, মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতার। ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর জয় আওয়ামী লীগের জন্য বড় একটি বার্তা ছিল। কিন্তু সেই বার্তাটি ঠিকমতো আত্মস্থ করতে পারেনি দলটি। বরং স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও দলটি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের অবস্থান থেকে সরে এসে মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এ সুযোগ স্থানীয় সাংসদরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার সুযোগ পেয়ে যান। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র হয়েছেন স্থানীয় সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে। তবে উপজেলা নির্বাচন সামনে রেখে এ সংকট আরও প্রকট হয়েছে। সাংসদরা আইন প্রণেতা হলেও তারা স্থানীয় সরকার ও রাজনীতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। বিশেষ করে উপজেলা চেয়ারম্যান পদটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখাটা তাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। নির্বাচন উন্মুক্ত থাকার সুবাদে এমপি-মন্ত্রীরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই কৌশলে, গায়ের জোরে, ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে নিজেদের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে মরিয়া। নাটোরের সিংড়া উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবিব রুবেল। তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতানোর সব নীলনকশা চূড়ান্তও ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন মনোনয়নপত্র দাখিল করতে গেলে নির্বাচন অফিসের সামনে থেকেই তাকে তুলে নিয়ে যায় রুবেলের লোকজন। তাকে পিটিয়ে আহত করে ফেলে রেখে যায়। এ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলে দেশের বাইরে থাকা প্রতিমন্ত্রী দেশে ফিরেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান আহত দেলোয়ারকে দেখতে। সেখানে তিনি এ ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেন এবং নিজের শ্যালককে নির্বাচন থেকে সরিয়ে নেন। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের ভেতরেও তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সিদ্ধান্ত হয় মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু বারবার হুমকি দিয়েও মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের নির্বাচনে বিরত রাখা যায়নি। পলক তার শ্যালককে নির্বাচন থেকে সরিয়ে আনতে পারলেও প্রথম দফার নির্বাচনে অন্তত ২০ জন মন্ত্রী-এমপির স্বজন নির্বাচনের মাঠে রয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পথে। প্রথম দফায় বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরের ধাপগুলোতে এ প্রবণতা আরও বাড়বে। তাতে দেশজুড়ে এমপিতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্র আরও বাড়বে।
বিএনপির মতো আওয়ামী লীগেও নির্বাচন নিয়ে দোদুল্যমানতা রয়েছে। একবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন, একবার প্রতীক ছাড়া; কোথাও স্বজনরা নির্বাচন করতে পারেন, কোথাও পারেন না—এ পরিস্থিতি দলের মধ্যে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। আর যারা দলের সিদ্ধান্ত উপক্ষো করে নির্বাচন করছেন, তারা জানেন, জিতে আসতে পারলে দল তাদের ফেলবে না। অতীতে অনেকবার দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে অনেক হম্বিতম্বি করা হলেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম দুবার দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দুবারই সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন। ঢালাও সাধারণ ক্ষমার অতীত জানেন বলেই এখন আর কেউ দলের সিদ্ধান্তকে পাত্তা দিচ্ছেন না। পাত্তা না দেওয়ার এ প্রবণতা দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। মন্ত্রী-এমপিদের দাপটে কোণঠাসা তৃণমূল। এখন হয়তো ক্ষমতার দাপটে ক্ষতিটা বুঝছে না আওয়ামী লীগ বা বুঝলেও পাত্তা দিচ্ছে না। কিন্তু দলের মূল শক্তি তৃণমূলের এই বেহালদশার মূল্য দিতে হবে আওয়ামী লীগকে।
তবে নির্বাচন তো আর শুধু আওয়ামী লীগ-বিএনপির নয়। জনগণ যাতে তাদের প্রতিনিধি বেছে নিতে পারে, সেটাই হলো নির্বাচনের মূল চেতনা। কিন্তু জনগণের এ ক্ষমতাটাই হারিয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে। এখন আর কেউ নির্বাচনকে পাত্তা দেয় না। ভোটাররাও ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। সবার ধারণা নির্বাচন মানেই পাতানো খেলা, আগে থেকেই ফল নির্ধারণ করে রাখা। সবার আগে জরুরি নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ