ভারতের ১৮তম সাধারণ লোকসভা নির্বাচন শুরু হচ্ছে কাল। চলবে ১ জুন পর্যন্ত, যা মোট ৫৪৩ জন সংসদীয় প্রতিনিধিকে নির্বাচন করবে। নির্বাচন সাত ধাপে অনুষ্ঠিত হবে এবং ৪ জুন ফল ঘোষণা করা হবে। ভারতের এ লোকসভা নির্বাচনকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বাচন, কারণ প্রায় ১০০ কোটি ভোটার এ নির্বাচনে ভোট দেবেন। বর্তমান শাসক দল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপির মোকাবিলা করছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ১২টি দলের জোট। পুরো নির্বাচনের বড় আকর্ষণ নরেন্দ্র মোদি, যিনি কট্টর হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডা উড়িয়ে ২০১৪ সালে বিপুল বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় বসে নিজেকে আর দলকে আরও সংহত করেছেন এ সময়ে। যদি এবারও তিনি জয়লাভ করেন, তাহলে ভারতের ইতিহাসে জওহরলাল নেহরুর মতো তিনিও টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার রেকর্ড গড়বেন।
ভারতের এ নির্বাচন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আগামীকাল শুরু হয়ে জুনের ৪ তারিখে গিয়ে ফল হবে। এ নির্বাচন বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্বাচনও। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে খরচ হয়েছিল ৮.৫ বিলিয়ন ডলার। এবার স্বাভাবিক কারণেই আরও বেশি হবে। লাখ লাখ ভোটকেন্দ্রে ভোটের আয়োজন করে রেখেছে নির্বাচন কমিশন।
ভারতের শাসনব্যবস্থা ব্রিটিশ ও মার্কিন শাসন পদ্ধতির সংমিশ্রণ। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ২৮টি অঙ্গরাজ্য ও ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের একটি ইউনিয়ন হলো ভারতের সরকার। ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি, যিনি সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেন ও শপথবাক্য পাঠ করান। ভারতের সংসদের দুটি কক্ষ। উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা। এ কক্ষের সদস্যরা অঙ্গরাজ্যগুলোর বিধানসভা ও লোকসভার সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। তাদের মেয়াদ ছয় বছর। নিম্নকক্ষের নাম লোকসভা। এর সদস্যরা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। হিসাব-নিকাশ বলছে, আবারও নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসতে চলেছেন। ভোটের বছরে রাম মন্দিরের উদ্বোধন করে মোদি সরকার ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোটারদের মন জয় করে নিয়েছেন বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী এবং বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজজীবনে ভারতীয় প্রভাবের কথা বিবেচনায় রেখে বলা যায় ভারতের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। গত ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় এবং বিএনপিসহ তার মিত্রদের আন্দোলনকে উড়িয়ে নিজ দল ও নিজের পছন্দমতো অন্য দলের মধ্যে আয়োজন করে নির্বাচন সম্পন্ন করে আবার ক্ষমতায় শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ।
বিরোধী দল মনেই করে যে, আন্তর্জাতিক মহলের সব চাপ নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় বসাতে বড় ভূমিকা রেখেছে ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকার। বিরোধী দলের এমন ভাবনার সমর্থন পাওয়া যায় সরকারি দলের কোনো কোনো নেতার কথায়ও। গত ১৬ মার্চ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভারত পাশে ছিল বলেই বাংলাদেশের নির্বাচনে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্র অশুভ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।
ভারতের প্রতি অভিমান বা ক্রোধ থেকে সামাজিকমাধ্যমে বিএনপিপন্থি সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেয়, যার কিছু কিছু প্রভাবও লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে এর রাজনৈতিক প্রভাবটাই বেশি চোখে পড়ছে। বিএনপি দলীয়ভাবে এ প্রচারে যোগ না দিলেও ফেসবুকে বিএনপির যত পেজ আছে সেগুলোতে ভারতীয় পণ্য বয়কট ও ভারতবিরোধী প্রচুর প্রচারণা চালাও হচ্ছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতাই রুহুল কবির রিজভী আহমেদ নিজের গায়ের চাদর ফেলে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রচারে যোগ দিয়েছেন।
ওবায়দুল কাদের তো বলেছেনই যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচালিত ‘ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন’ সমীচীন নয়। আরও অনেক নেতা মন্তব্য করেছেন। মন্তব্য করতে ছাড়েননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। ২৭ মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, যে বিএনপি নেতারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন, তাদের স্ত্রীদের কয়খানা ভারতীয় শাড়ি আছে এবং সেগুলো কেন পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সাড়ে তিন মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ভারতের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাজে আগ্রহ অনেক। যদিও নির্বাচনে মোদির জয়লাভ নিশ্চিত জেনে সাধারণ মানুষের আগ্রহে কিছুটা হলে ভাটা পড়েছে, বাস্তবতা হলো—এরপরও মানুষ সেদিকে নজর রাখছে।
ভারতে সংখ্যালঘু নিপীড়নের খবরে বাংলাদেশে উদ্বেগ বাড়ে এবং তার কিছু প্রতিফলনও দেখা যায় এ দেশে। ভারতের নির্বাচনের ঠিক আগে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদি সরকার বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কার্যকর করার জন্য সক্রিয় হয়েছে। এ পদক্ষেপের ফলে সেখানকার মুসলমানরা যে অবস্থায় নিপতিত হবেন তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা কীরকম পরিস্থিতিতে পড়বেন সেটাও বিবেচনার মধ্যে আসছে। উভয় দেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজে বিষয়টি আলোচনায় থাকছে। সিএএ বাস্তবায়নের পর ‘এনআরসি’ বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বাস্তবায়নেরও পরিকল্পনা রয়েছে বিজেপির। এই এনআরসি কার্যকর হলে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে বহু মুসলিম ভারতের নাগরিকত্ব হারাতে পারেন, যার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশ সীমান্তে।
ভারতের এ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টটি (সিএএ) অতি সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে করা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ওই তিন দেশের যেসব হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ও পারসিদের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণে ভারতে চলে এসেছিলেন, তাদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ফলে স্বাভাবিক কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, ২০১৪ সালের পর থেকে যারা গত প্রায় সাড়ে ৯ বছরে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের ফেরত আসতে হবে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন ভারতের ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। ঐতিহ্যগতভাবে মূলত কংগ্রেসের সঙ্গেই আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক। কিন্তু ২০১৪ সালে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় আসার পর সেই সরকারেরও জোরালো সমর্থন পেয়েছে আওয়ামী লীগ। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসায় তখন বিএনপি ও জামায়াত সেই বিজয়কে উদযাপন করেছিল এটা ভেবে যে, আওয়ামী লীগের প্রতি বিজেপির সমর্থন এতটা নিরঙ্কুশ হবে না। কিন্তু গত দশ বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অনেক অমীমাংসিত ইস্যু রয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন। দুই দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তিস্তাসহ আলোচনায় থাকা আটটি নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। বেশি জলঘোলা হয়েছে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে। চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় তা আর বাস্তবায়ন করা যায়নি।
একটি বড় ইস্যু সীমান্ত হত্যা। বারবার আশ্বাস দিয়েও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বন্ধ করছে না। এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসেও দুজনকে হত্যা করেছে বিএসএফ। বিএসএফ বাহিনী কেন এত হত্যা প্রিয় সেটা ভারত সরকারেরই বলা দরকার। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে শান্তিতে রেখেও বাংলাদেশের নাগরিকরা ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারছে না।
বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক সুবিধা নিচ্ছে ভারত। ভারতকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে আমাদের সরকার। ভারতকে সেই সুযোগ দেওয়া হলেও স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে নেপাল কিংবা ভুটানে পণ্য রপ্তানি করার জন্য এখনো অনুমতি পায়নি বাংলাদেশ। এ দেশের মানুষ মনেই করে যে, ‘একতরফাভাবে’ অনেক কিছু দেওয়া হলেও তার বিনিময়ে বাংলাদেশ ‘তেমন কিছু’ পায়নি ভারত থেকে।
তাই এসব নানা সমীকরণে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারতীয় লোকসভা নির্বাচন ব্যাপক আগ্রহের একটা বিষয়। নরেন্দ্র মোদি আবার আসেন বা অন্য কেউ যদি প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে কি বাংলাদেশের বিষয়গুলো ভিন্নভাবে দেখা হবে?
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন