সব ধর্মাবলম্বীদের নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব রয়েছে। যেসব ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয় সেগুলোর মধ্যে ঈদুল ফিতর হচ্ছে কনিষ্ঠতম। এ মহান পুণ্যময় দিবসের প্রচলন শুরু হয় আজ থেকে মাত্র ১৩৮০ সৌর বছর পূর্বে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর মদিনাতে হিজরতের অব্যবহিত পর থেকেই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ঈদুল ফিতরের প্রচলনের একটি যৌক্তিক কারণ ছিল। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব রয়েছে মুসলিমদের জন্যও অনন্দ উৎসব প্রয়োজন। এই চিন্তা থেকেই আসলে মুসলিমদের ঈদের উৎসবের সূচনা। হজরত আনাস (রা.) বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, নবী করিম (সা.) মদিনা আগমন করে দেখলেন মদিনাবাসী দুটি দিবসে আনন্দ-উল্লাস করে থাকেন। মহানবী (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, এ দিবসদ্বয় কি? ওরা বলল, জাহেলি যুগ থেকেই এ দুটি দিবসে আনন্দ-উল্লাস করে থাকি। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহ তোমাদের ওই দিবসদ্বয়ের পরিবর্তে উত্তম দুটি দিবস দান করেছেন। দিবসদ্বয় হলো ঈদুল আজহার দিবস ও ঈদুল ফিতরের দিবস। (সুনান আবূ দাউদ, কিতাবুল ঈদায়ন)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পারসিক প্রভাবে শরতের পূর্ণিমার নওরোয নামে এবং বসন্তের পূর্ণিমার মিহিরজান নামে উৎসব দুটি মদিনাবাসী বিভিন্ন ধরনের আনন্দ-আহ্লাদ, খেলাধুলা ও কুরুচিপূর্ণ রং-তামাশার মাধ্যমে উদযাপন করত। উৎসব দুটির রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণরূপে ইসলামের আদর্শ পরিপন্থি। এই দুটি উৎসবই ছয় দিনব্যাপী উদযাপিত হতো, যার মধ্যে শুধু একটি দিবস নওরোয-এ-আম্মা বাকুসাক ছিল সাধারণ, দরিদ্র মানুষের জন্য নির্দিষ্ট। অন্য দিনলো ছিল সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবিত্তের ব্যক্তিবর্গের জন্য সুনির্দিষ্ট। শ্রেণি বৈষম্য, ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে কৃত্রিম পার্থক্য, ঐশ্বর্য-অহমিকা ও অশালীনতার পূর্ণ প্রকাশে কলুষিত ছিল এ দুটি উৎসব। তাই সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ, শ্রেণি-বৈষম্য ঘুচিয়ে ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত আরববাসী রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর নির্দেশে শুরু করল ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উৎসব উদযাপন। জন্ম নিল শ্রেণি বৈষম্য বিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতা মুক্ত সুনির্মল আনন্দে ভরা সুস্নিগ্ধ, প্রীতি-সঘন মিলন উৎসব ঈদুল ফিতর।
উল্লেখ্য যে, ইসলাম ধর্মীয় উৎসব বলে ঈদুল ফিতর প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে, ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম এবং ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় প্রকারান্তরে ঈদ সব মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে; ঈদের আনন্দ সবার তরে।
ঈদ মানে আনন্দ এবং সে আনন্দ সবার সেটাই স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশিত। দীর্ঘদিন থেকে ঈদ সাড়া বিশ্বের মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালন হয়ে আসছে। রমজানের রোজার শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপনের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, এ উৎসব সব মুসলিমের আনন্দের উৎসব। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময় এবং নির্দিষ্ট ধর্মীয় প্রথা পালনের পরে নির্ধারিত দিন ঈদের দিন হিসেবে বিবেচিত হয়। চন্দ্রমাস হিসেবে নির্দিষ্ট মাস রমজানের দীর্ঘ এক মাস রোজা বা সিয়াম সাধনার পরে রোজা ভাঙার যে আনন্দ এ আনন্দই আসলে ঈদের আনন্দ। এই দিন যারা এক মাস সিয়াম সাধনা করলেন, তাদের জন্য মহান আল্লাহতায়ালা পুরস্কার ঘোষণা করেন। এই ধারণা থেকেই এক মাস যারা সিয়াম সাধনা করলেন, তাদের মনে স্বভাবতই একটি অকৃত্রিম আনন্দ অনুভূতির সৃষ্টি হয়। ঈদের দিন ধনী-গরিব সবার সঙ্গে ঈদের নামাজ, নামাজ শেষে সবার মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, জাকাত, ফিতরা ইত্যাদি বণ্টনের মাধ্যমে আনন্দ ঘন পরিবেশের মধ্যে সময় কাটানোর একটি প্রথা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আজকে ঈদ আমাদের এই আধুনিক জীবন ব্যবস্থায় বা গ্লোবাল ভিলেজ ব্যবস্থার মাধ্যমে শুধু আরব দেশ বা মধ্যপ্রাচ্যে নয়, শুধু বাংলাদেশ বা ভারতে নয়, এশিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপসহ দূরপ্রাচ্য সব স্থানে মানুষ ঈদ উদযাপন করছে। যদিও ঈদ ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, তবুও এটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃথিবীর ধর্ম-বর্ণ জাতি ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব মানুষকেই প্রভাবিত করছে। সেই প্রভাব ঈদের আভিধানিক অর্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে তাহাই প্রত্যাশিত। ঈদ অর্থ আনন্দ, অর্থাৎ এ আনন্দ যিনি ধনী তার জন্যও যেমন সত্য, যিনি গরিব তার জন্যও সত্য, যারা এরাবিয়ান তার জন্য সত্য, যিনি বাঙালি তার জন্যও সত্য, তেমনি আমেরিকান জাপানিজের জন্য সমভাবে সত্য। ঠিক তেমনিভাবে পৃথিবীর সব দেশে এখন সব ধর্মের মানুষ বসবাস করে। ধর্মীয় চেতনায় এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার বাইরেও মানুষ সামাজিক এবং মানবিক চেতনা বোধ থেকে সবাই একজনের আনন্দ আর একজন ভাগাভাগি করে নিতে চায় এবং মানুষ সামাজিক প্রাণী সুতরাং আনন্দ কখনো একা একা হয় না। আনন্দ সমাজের অন্যদের সঙ্গে নিয়েই উদযাপন করতে হয়।
যেখানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে কারও অর্থ থাকলেও তিনি যথাযথভাবে খাদ্য জোগাড় করতে পারবেন না, কারণ সেখানে অশান্তি যুদ্ধের এবং অস্থিতিশীলতার কারণে বাজার ব্যবস্থা বা আবাসিক ব্যবস্থাপনা থেকে আরম্ভ করে মানবিক বিষয়গুলোতে মানুষের জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে। সুতরাং সেখানকার মানুষের জন্য ঈদ শব্দটি যেন পৃথিবীর শান্তিপূর্ণ অন্যান্য জায়গার মানুষের জন্য যেমন আনন্দঘন হয় অন্যসব স্থানেও যেন হয়, সেটিও প্রত্যাশিত। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে যে, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে বাজার ব্যবস্থাপনায় কোনো বিশেষ দেশের পণ্য বর্জনের আহ্বান আসছে। পণ্য বর্জনের বিরুদ্ধেও কিছু কথা আসছে, অনেক কথা উচ্চারিত হচ্ছে। বিষয়টি হলো, কোনো অবস্থাতেই পণ্য বর্জনের ডাক দিয়ে দেশের বাজারে কোনো জিনিসের কৃত্রিম ঘাটতি তৈরি করে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেওয়া বা পণ্যের অপ্রাপ্তির কারণে দ্রব্যমূল্যে বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে মানুষের আনন্দের পরিবেশের ক্ষেত্রে কোনো সংকট তৈরি করা বা বিঘ্ন করা একেবারেই অমানবিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। মানুষের আধুনিক জীবন ব্যবস্থায় ধর্মীয় স্বাধীনতাও খুবই জরুরি। জীবনকে উপলব্ধি করার জন্য সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য মানুষকে মানবিক জীবনবোধের জায়গা থেকে জীবনযাপন করার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কিন্তু ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক এবং অসাম্প্রদায়িকতার জায়গায় থাকতে হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার লালন আজকে জরুরি। অনেকদিন আগে থেকে বলা হয়েছে, এটি শুধু ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্যই শুধু অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করতে হবে, এমন নয়। যে কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক আনন্দ বা অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কোনো সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা বা সংকট তৈরি করে বাধাগ্রস্ত করবে আনন্দ উপভোগ করার ক্ষেত্রে সেদিকে আমাদের অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে। ইসলাম ধর্মেও বাড়াবাড়ির বিষয়টি পরিহারের কথা বলা হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (স.) ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কথা নিষেধ করেছেন। যার যার ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছেন। ‘লা কুম দিনুকুম অলিয়া দ্বীন’ ইসলাম ধর্মের সূচনালগ্ন থেকে আমরা সেটি দেখে আসছি, শুনে আসছি। সুতরাং আজকে কোনো অবস্থাতেই রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের কারণে নতুন করে কোনো ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে সংকট তৈরি করা ভালো হবে না। এটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যেমন সত্য, তেমনি অন্য দেশের বেলায়ও সমভাবে সত্য বাংলাদেশে যদি ধর্মীয় উন্মাদনা করে অন্য ধর্মের সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের কোনো কারণে আমরা বঞ্চিত করি, তবে অন্য দেশে ঠিক একই কারণে সেই দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর একই প্রভাব পড়বে। মনে রাখতে হবে, দেশের নাগরিক হিসেবে সব মানুষের অধিকার সমান। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকার যেমন আছে, তেমনি আনন্দ উপভোগের অধিকারও আছে। সুতরাং এই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি উপভোগ করার একটি অবারিত দ্বার উন্মুক্ত রাখা জরুরি। ঈদ সবার, তার মানে হলো, ধনী-গরিবের ক্ষেত্রে যেমন, বর্ণ পরিচয়ে বা জাতীয়বাদের পরিচয়ে, ভৌগোলিক সীমারেখার পরিচয়েও বৈষম্য থাকবে না, একই ভাবে ধর্মীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রেও কোনো বৈষম্য থাকবে না, সেটিই প্রত্যাশিত। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আনন্দ উদযাপন করবে। আনন্দ একার নয়, আনন্দ সামাজিকভাবে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে উদযাপন করতে হবে, তাহলেই প্রকৃত পক্ষে আমরা সবাই ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারব। এই যে আনন্দ শব্দটি এটি তৈরি হয়েছিল যে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে, সংকীর্ণতা থেকে ঊর্ধ্বে উঠে পারস্পরিক সহমর্মিতার ঊর্ধ্বে উদার ভ্রাতৃত্ববোধ থেকে কল্যাণময় পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে সবাই মিলে আনন্দ উপভোগ; যেটি আজকের দিনে আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। আমরা বিশ্বাস করি সেটি নিশ্চিত হবে। ঈদ হবে সবার।
লেখক: সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়