আকমল হোসেন
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:১৪ এএম
আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে

বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে

বুয়েট বাংলাদেশের প্রকৌশল শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিদ্যাপীঠ, যেখানে দেশের মানুষের সর্বোচ্চ আর্থিক কন্ট্রিবিউশন রয়েছে। শিক্ষার্থীপ্রতি যেখানে সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রীয় তথা জনগণের অর্থ বিনিয়োগ হয়। বিনিয়োগের আউটপুট দ্বারা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সবাই উপকৃত হবে—এ প্রত্যাশাই বিবেকবান মানুষের। অনেক ইতর প্রাণীরও তার মনিব বা উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকে, সেখানে মানুষের এ বিষয়টা থাকবে না তা কখনো হতে পারে না। বুয়েটে শিক্ষার্থীদের জন্য এ বিষয়টা আরও বেশি প্রযোজ্য। শুধুই মেধার মাধ্যমে ব্যক্তি ও পরিবারের জন্য সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হলেও জাতির প্রতি দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের টাকা হ্যাক করে লুট করা, দেশের নানান এজেন্সিকে অন্ধকারে রেখে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে বেগমপাড়া গড়ে তোলা, সামান্য তৃতীয় শ্রেণির চাকরি করে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, নিশ্চয়ই তারা কম মেধাবী নয়? এ মেধাবীরা দুঃসাধ্য কাজ করেছে, এর মাধ্যমে তাদের পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছে। তবে জনগণের খাজনা আর করের টাকায় বড় হওয়া এ মেধাবীদের কাজ আর ইতর প্রাণীর কাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মেধাবীদের হওয়া দরকার দেশপ্রেমিক, যাদের জাতির প্রতি থাকবে দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধ, মানুষের সুখে হবে সুখী আর দুখে হবে দুখী। দেশ ও জাতির উন্নয়নে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ইতিবাচক ভূমিকা যেমন দরকার, সেইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় ভূমিকারও দরকার। তবে ব্যক্তি ও এনজিওভিত্তিক উন্নয়নের দ্বারা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হয়েছে এমন নজির নেই। রাজনৈতিক কমিটমেন্ট এবং রাষ্ট্রীয় নীতি পারে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে। সেখানে আত্মকেন্দ্রিক মেধাবীর চেয়ে দেশপ্রেমিক মেধাবীর দরকার বেশি। জ্ঞানীদের জ্ঞানী বলেখ্যাত সক্রেটিসের একটি উক্তি আছে—রাজনীতি বিবর্জিত মানুষের আত্মা নেই। যাদের আত্মা নেই তারা তো জড়। জড় বস্তুর কোনো চাহিদা নেই, সেই কারণে তাদের রাজনীতিও নেই। কিন্তু মানুষ সরাসরি রাজনৈতিক দল না করলেও রাজনীতির বাইরে থাকতে পারে না, মেধাবীরা তো পারেই না। রাজনীতি মানে শুধু নাগরিক ও রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিই নয়, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা, ভোটাধিকার প্রয়োগ নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতাবোধও রাজনীতি। এই রাজনীতি কখনো সেবা এবং মানবকল্যাণের মন্ত্র, কখনো আবার শোষণ, নির্যাতন, লুটপাট এবং ভোগের রাজনীতি। নানান দোষত্রুটির পরও রাজনীতিই মানুষের দেশের উন্নয়নের শক্তিশালী চাবিকাঠি। আমেরিকার দাস প্রথার বিলুপ্তি, রাশিয়ার জার বা রাজতন্ত্রের অবসান, চীনের জমিদার ভূস্বামীর অবসান, ভিয়েতনামে মার্কিন দখলদারিত্বের অবসান, পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ও সামরিক শাসন থেকে মুক্ত করাসহ দেশে দেশে মানব মুক্তির আজকের চিত্র তার সবই রাজনৈতিক কারণে সংঘটিত হয়েছে। এই ভূখণ্ডে তেভাগা আন্দোলন, টংক আন্দোলন, নানকার আন্দোলন, হাতি খেদাও আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ’৭১ সালের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন, সর্বশেষ ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনে রাজনীতি নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে, রাজনীতির কারণেই এগুলো সম্ভব হয়েছিল। তবে সেবার রাজনীতির মূল স্রোতে বিপদগামী হওয়ায় এবং হোন্ডা-গুন্ডা মাস্তান, সামরিক প্রশাসনিক আমলা ও লুটেরা বণিকনির্ভর হওয়ায় রাজনীতির ওপর মানুষের আস্থা কমতে শুরু করেছে। বিগত বেশ কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিই সেটা প্রমাণ করে। স্বাধীনতা পূর্বকালে ছাত্ররাজনীতির যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ছিল, স্বাধীনতার পর ছাত্ররাজনীতিকে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত করে ছাত্ররাজনীতির যে বিপদগামিতার জন্ম দেওয়া হয়েছিল, তার নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রুলিং পার্টির ছাত্র সংগঠনের নেতাদের খবরদারি, চাঁদাবাজি, হত্যা, শিক্ষকের ওপর হামলার ঘটনা এখন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ছাত্রনেতাদের ভোগবাদিতা, অছাত্রও আদু ভাই ছাত্রনেতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না থাকার মধ্য দিয়ে ছাত্ররাজনীতির যে বিপথগামী ধারার সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষমতা আর নিয়ন্ত্রণকারীদের হাতে নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন, মেডিকেল কলেজের জামিল আক্তার রতন, চট্টগ্রাম কলেজের সাহাদত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঈন হোসেন রাজু, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সামনের পথচারী এবং বুয়েটের আবরার হত্যার ঘটনা ছাত্ররাজনীতিকে আসামির কাঠগড়ায় শুধু দাঁড় করেনি, ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দিয়েছে, সেইসঙ্গে সংবিধানকে উপেক্ষা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সুযোগ পায় আর সেই সুযোগে ক্যাম্পাসে মৌলবাদের চাষ হয় আর শাসকদের আজ্ঞাবাহী ছাত্রনেতা ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ জনগণের কর খাজনার টাকায় বরাদ্দ করা নির্মাণকাজের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়, প্রতিবাদের সুযোগ থাকে না। মৌলবাদী ছাত্রসংগঠন ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ছাত্রলীগ-ছাত্রদল তাদের দলকে ক্ষমতায় নেওয়া, কখনো আবার ক্ষমতায় থাকার কাজে যুক্ত থাকে। অধিকার আদায়ে বাম ছাত্রসংগঠনগুলো ক্রিয়াশীল থাকলেও নিজেদের মধ্যে ভেঙে ছোট হওয়ায় শক্তিহীন হয়ে পড়ায় রুলিং পার্টিও তাদের ছাত্রসংগঠনের জন্য পোয়াবারো হয়েছে। এ অবস্থায় ছাত্ররাজনীতির বন্ধ রাখা লুটেরা শাসকদের অবৈধ কালাকানুনের স্থায়িত্বই বাড়াবে। মাথাব্যথা সারানোর জন্য মাথা বডি থেকে কেটে ফেলা কোনো সমাধান নয়, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হত্যা নৈরাজ্য দূরীকরণে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা সমাধান নয়। বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির নামে নৈরাজ্য, হত্যা, চাঁদাবাজি, শিক্ষক প্রহারের সঙ্গে জড়িত ছাত্রসংগঠনকে বয়কট করলেই সমাধান পাওয়া যায়।

লেখক: অধ্যক্ষ, সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস)

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তৃতীয় দিনের প্রথম সেশনের খেলাও হচ্ছে না

আ.লীগের দোসরদের চারপাশে বসিয়ে সংস্কার সম্ভব নয় : কাদের গনি

জবির নতুন পরিবহন প্রশাসক অধ্যাপক ওমর ফারুক

চবিতে হলে আটকে রেখে ছাত্রলীগ কর্মীকে মারধর

কোরআন পড়ে বাড়ি ফেরা হলো না চার শিশুর

আদালতে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান

শাবিপ্রবি ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রেপ্তার

নোয়াখালীতে গণপিটুনিতে যুবলীগ নেতা নিহত

সুসংবাদ পেতে পারে কন্যা

‘রাসুল (সা.) এর দেখানো পথে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে কাজ করতে হবে’

১০

চার জেলায় তীব্র বজ্রপাত ও ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস

১১

ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কমিশন হচ্ছে : হাসনাত আবদুল্লাহ

১২

বিপৎসীমার ওপরে তিস্তার পানি

১৩

ঢাকা সিএমএইচে নেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থী কাউসারকে

১৪

তাপমাত্রা নিয়ে নতুন তথ্য দিল আবহাওয়া অফিস

১৫

দেশে ফিরলেন ড. ইউনূস

১৬

২৯ সেপ্টেম্বর : নামাজের সময়সূচি

১৭

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৮

নীলফামারীতে শেয়ালের কামড়ে শিশুসহ আহত ৫০

১৯

রাণীশংকৈলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে জামায়াতের সম্প্রীতি সমাবেশ

২০
X