পবিত্র রমজানে কোনো কারণে কেউ রোজা রাখতে না পারলে বা রোজা পালন করতে গিয়ে কোনো ত্রুটি হলে অথবা রোজা রাখার পর তা ভেঙে গেলে তার প্রতিকারস্বরূপ ইসলাম যে বিধান দিয়েছে তাকে রোজার কাজা-কাফফারা-ফিদিয়া বলা হয়। কাজা মানে হলো বকেয়া। কাফফারা মানে জরিমানা। রমজানের রোজা অতি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় তা ভঙ্গ করলে কখনো শুধু কাজা বা শুধু কাফফারা এবং কখনো কখনো কাজা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করতে হয়।
কাজা হলো একটি রোজার পরিবর্তে একটি রোজা রাখা। আর কাফফারা হলো একটির পরিবর্তে ৬০টি রোজা রাখা। এই ৬০টি বিরামহীনভাবে রাখতে হবে। তবে রোজার কাফফারার আরেকটি বিকল্প আছে। তা হলো, ৬০টি রোজার পরিবর্তে ৬০ জন গরিব মানুষকে
দুবেলা খাওয়ানো। এ ছাড়া দাসমুক্তিও একটি মাধ্যম। ফকিহরা বলেন, বর্তমানে যেহেতু দাসদাসী বা গোলামের প্রচলন নেই, সুতরাং এ মাধ্যমটির সুযোগ আর বাকি নেই। কাফফারা তিন প্রকারে আদায় করা যায়—১. একটি গোলাম আজাদ করা বা দাসমুক্ত করা। ২. ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোজা পালন করা। কাফফারার রোজার মাঝে বিরতি হলে বা ভাঙলে আরেকটি কাফফারা ওয়াজিব হয়ে যাবে। ৩. ৬০ মিসকিনকে দুবেলা ভালোভাবে আহার করানো বা আপ্যায়ন করা।
আর বার্ধক্য বা জটিল কোনো রোগের কারণে যার রোজা রাখার একেবারেই সমর্থ নেই এবং পরে কাজা করার সমর্থ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই—এমন ব্যক্তি রোজার পরিবর্তে ফিদিয়া প্রদান করবে। ফিদিয়া হলো প্রত্যেক রোজার পরিবর্তে একজন মিসকিন ব্যক্তিকে দুবেলা তৃপ্তিসহ খাবার খাওয়ানো বা এর মূল্য দেওয়া। একটি রোজার পরিবর্তে একটি ফিদিয়া ওয়াজিব হয় (আদদুররুল মুখতার: ২/৪২৬)। বোখারি ও মুসলিমে সহিহ রিওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘একদা রমজানে এক লোক রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি নিজেকে ধ্বংস করে ফেলেছি, আমি রোজা পালন অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে ফেলেছি।’ রাসুল (সা.) তাকে বললেন, ‘তুমি একজন দাসকে মুক্ত করে দাও।’ সে বলল, ‘এমন সক্ষমতা আমার নেই।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তবে এর বদলে দুই মাস (বা ৬০ দিন) রোজা রাখো।’ লোকটি বলল, ‘এমন শারীরিক সক্ষমতা আমার নেই।’ তখন তিনি বললেন, ‘তবে তুমি ৬০ মিসকিনকে খাওয়াবে।’ লোকটি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! এরকম আর্থিক সক্ষমতাও তো আমার নেই।’ তখন রাসুল (সা.) তাকে অপেক্ষা করতে বললেন। এর কিছুক্ষণ পর কোনো একজন সাহাবি রাসুল (সা.)-কে এক ঝুড়ি খেজুর হাদিয়া দিলেন। তখন রাসুল (সা.) ওই লোকটিকে ডেকে বললেন, ‘এগুলো নিয়ে গরিবদের মধ্যে সদকা করে দাও।’ লোকটি বলল, ‘ইয়া রাসুল (সা.), এই এলাকায় আমার মতো গরিব আর কে আছে?’ এ কথা শুনে রাসুল (সা.) স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি হাসলেন। রাসুল (সা.) বললেন, ‘আচ্ছা, তবে খেজুরগুলো তুমিই তোমার পরিবার নিয়ে খাও।’ (বোখারি : ১৩৩৭; মুসলিম : ১১১১)
এখন জানার বিষয় হলো—কী কী কারণে বা কী কী ধরনের ত্রুটি হলে কাজা আদায় করতে হয়? তা হলো—১. স্ত্রীকে চুম্বন বা স্পর্শ করার কারণে যদি বীর্যপাত হয়। ২. ইচ্ছাকৃত মুখ ভরে বমি করলে। ৩. পাথরের কণা, লোহার টুকরা, ফলের বিচি গিলে ফেললে। ৪. ডুশ গ্রহণ করলে। ৫. নাকে বা কানে ওষুধ দিলে (যদি তা পেটে পৌঁছে)। ৬. মাথার ক্ষতস্থানে ওষুধ দেওয়ার পর তা যদি মস্তিষ্কে বা পেটে পৌঁছে। ৭. যোনিপথ ব্যতীত অন্য কোনোভাবে সহবাস করার ফলে বীর্য নির্গত হলে। ৮. স্ত্রী লোকের যোনিপথে ওষুধ দিলে। উল্লেখ্য, রমজান মাস ছাড়া অন্য সময় রোজা ভঙ্গের কোনো কাফফারা নেই, শুধু কাজা আছে।
আর এসব ক্ষেত্রে রোজা ভাঙার অনুমতি আছে; এসব রোজা পরে কাজা করতে হবে—১. মুসাফির অবস্থায়। ২. রোগব্যাধি বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকলে। ৩. মাতৃগর্ভে সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে। ৪. এমন ক্ষুধা বা তৃষ্ণা হয়, যাতে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকতে পারে। ৫. শক্তিহীন বৃদ্ধ হলে। ৬. কোনো রোজাদারকে সাপে দংশন করলে। উল্লিখিত কারণে রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ করা যাবে। কিন্তু পরে তা কাজা করতে হবে। মহিলাদের হায়েজ-নেফাজকালেও রোজা নেই। এসবও পরে শুধু কাজা করতে হয়।
এ ছাড়া যেসব কারণে কাজা ও কাফফারা উভয়ই আদায় করতে হয় (অর্থাৎ একটি রোজার পরিবর্তে ৬০টি রোজা রাখতে হবে, তা হলো—১. রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃত পানাহার করলে। ২. রোজা অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে সহবাস করলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, সে অন্য সময় রোজা পূরণ করে নেবে। আর এটা যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাবার খাওয়াবে। যে ব্যক্তি সন্তুষ্টির সঙ্গে সৎকর্ম করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়।’ (সুরা বাকারা: ১৮৪)
জাকাত-ফিতরা যাদের দেওয়া যায়, ফিদিয়া তাদের দিতে হয়। ফিদিয়া এককালীন বা একসঙ্গেও আদায় করা যায়। একজনের ফিদিয়া অনেককে দেওয়া যায় আবার অনেকের ফিদিয়া একজনকেও দেওয়া যায়। অনুরূপ এক দিনের ফিদিয়া একাধিকজনকে দেওয়া যায়, একাধিক দিনের ফিদিয়া একজনকে দেওয়া যায়। যাকে ফিদিয়া দেওয়া হবে, তার রোজাদার হওয়া জরুরি নয়। যেমন নাবালেগ মিসকিন, অসহায় অসুস্থ বা অতিবৃদ্ধ, যারা নিজেরাই রোজা পালনে অক্ষম, তাদেরও জাকাত, ফিতরা ও সদকার মতো ফিদিয়া প্রদান করা যাবে।
ফিদিয়া প্রদানের পর সুস্থ হলে এবং রোজা রাখতে সক্ষম হলে পুনরায় রোজা কাজা আদায় করতে হবে (ফাতাওয়া রশিদিয়া)। নাবালেগ শিশুরা নিজেদের আগ্রহে ও বড়দের উৎসাহে রোজা রাখে। যদিও তাদের জন্য রোজা রাখা ফরজ নয়। এমতাবস্থায় তারা যদি রোজা রেখে কখনো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যে কোনোভাবে রোজা ভেঙে ফেলে, তাহলে তাদের এই রোজার কাজা বা কাফফারা কোনোটিই লাগবে না। তারপরও যদি তারা বড়দের সঙ্গে কাজা রোজা রাখতে শুরু করে এবং তা আবার ভেঙে ফেলে তারও কাজা লাগবে না।
লেখক: ইমাম ও খতিব