দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আসার পরিমাণ কমে গেছে। রপ্তানির জন্য রেট বেঁধে দেওয়ায় অনেক ব্যাংকও বৈদেশিক মুদ্রা কিনতে পারছে না। অর্থাৎ ডলারের জোগান বা সরবরাহ বাড়ছে না, কিন্তু খরচ অব্যাহত রয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভে থাকা ডলার সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক জায়গায় আসছে না। কবে আসবে সেটাও বলা যাচ্ছে না। চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের কম। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ছিল ১ হাজার ৯২৬ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ আইএমএফের শর্তপূরণ করতে পারল না বাংলাদেশ।
তীব্র ডলার সংকটের মাঝে পড়ে আইএমএফের দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। সংস্থাটি ঋণের শর্ত হিসেবে নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রকৃত রিজার্ভ কী পরিমাণে থাকতে হবে, তা ঠিক করে দেয়। সে অনুযায়ী, প্রতি তিন মাস পরপর আইএমএফের শর্ত মেনে বাংলাদেশকে রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হচ্ছে।
বোঝা যাচ্ছে অর্থনীতি ভালো নেই। তবে ভিন্ন কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিন দিন আগে অর্থনৈতিক সংবাদদাতাদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি বলেছেন, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলারের স্বল্পতা কেটেছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সব দ্বিধা কেটে গেছে।
আসলেই কি তাই? দেশের পুঁজিবাজার পরিস্থিতি কিন্তু তা বলে না, বলে না মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি এবং অতি অবশ্যই ব্যাংক ও আর্থিক খাত। সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, টানা দরপতনে মাত্র ৪৮ কার্যদিবসে দেশের প্রধান শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদেরই ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার ছেড়ে দিচ্ছেন... বলা হচ্ছে গত ১০ কার্যদিবসে যেখানে প্রায় ৩৪ হাজার বিও হিসাব খালি হয়েছে, তার বিপরীতে নতুন হিসাব খোলা হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩০৬টি।
এ তো গেল পুঁজিবাজারের চিত্র। রেমিট্যান্স প্রবাহের চিত্রও সুবিধার নয়। ঈদের আগে প্রতি বছরই রমজান মাসে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বেড়ে যায়। তবে এবার আশানুরূপ রেমিট্যান্স আসেনি। চলতি মার্চ মাসের প্রথম ২৯ দিনে বৈধ বা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৮১ কোটি ৫১ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এর আগে চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১০ কোটি বা ২ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল এবং দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে এসেছিল ২১৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। প্রবাসী আয় কমে যাওয়া নতুন চিন্তার কারণ। কারণ ডলার সংকট নিয়ে এমনিতেই চাপে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রতিনিয়ত কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ রাখার শর্ত যেটা দিয়েছিল, বর্তমানে তার চেয়ে কম রিজার্ভ রয়েছে।
প্রায় পৌনে দুই বছর ধরে দেশে ডলার সংকট চলছে। ফলে ডলারের দাম অনেক বাড়তি। একদিকে চরম সংকট, অন্যদিকে বাড়তি দাম—এ দুইয়ের চাপে ব্যবসায়ী মহলে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের অবস্থা একেবারেই বেগতিক। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল করা ও ডলার সংকট কাটাতে নানা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলার জমা রেখে টাকা নিতে পারবে, চাইলে ৭ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে তা আবার তুলেও নিতে পারবে। এ সংক্রান্ত সার্কুলারে বলা হয়, মুদ্রা বিনিময়ের জন্য ব্যাংকগুলো ৫০ লাখের ওপরে যে কোনো পরিমাণ ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখতে পারবে।
২০২২ সালের শুরুর দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকায় দেশে ডলারের সংকট শুরু হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমদানি নিরুৎসাহিত করতে সে বছরের মে মাসে চার ধরনের পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়ায় সরকার। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে গত বছরের মাঝামাঝিতে প্রবাসী আয়ে বিদ্যমান আড়াই শতাংশ প্রণোদনার বাইরে ব্যাংকগুলোকে আরও আড়াই শতাংশ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে বিনা প্রশ্নে বিদেশ থেকে নগদ ডলার আনার সীমা দ্বিগুণ করা হয়। কিন্তু তাতেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট কাটেনি।
ডলার সংকটের কারণে আমদানির জন্য এলসি খুলতে প্রতি ডলারের বিপরীতে সরকার নির্ধারিত দরের বেশি মূল্য দিতে গিয়ে চরম সংকটে ব্যবসায়ীরা। সংকট মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন পর্যন্ত তাদের গৃহীত পদক্ষেপ হচ্ছে আমদানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনে, বিশেষ করে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ডলারের ব্যবহার সীমিত করা। ডলারের ব্যবহার সীমিত করে বৈশ্বিক কারণে সৃষ্ট সংকট কখনো সামাল দেওয়া যায় না। এর বাইরে হুন্ডি বন্ধ করার নামে ক্রমাগত টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত রাখা হয়েছে। এতে প্রকারান্তরে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। মূলত চলমান ডলার সংকট সামাল দিতে হলে ডলারের সরবরাহ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আর ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে আমাদের কাছে মনে হয়নি।
টাকার নিরিখে ডলারের দাম বাড়ছে। টাকার অবমূল্যায়নের ধাক্কাটা লেগেছে সবার ওপর। টাকার দাম ক্রমশ কমতে থাকার ফলে জ্বালানির দাম বড় আকারে বাড়ার পর সম্প্রতি সামান্য কমেছে। এতে ছাপোষা মানুষ, শ্রমিক-কেরানি-মাস্টার-ফেরিওয়ালা, কেউই টাকার অবমূল্যায়নের কুফল থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না।
বাজারের আর পাঁচটা জিনিসের মতো টাকা-ডলারের বিনিময় মূল্যও নির্ভর করে চাহিদা ও জোগানের ওপর। টাকার নিরিখে ডলারের দাম বাড়ছে, মানে টাকা-ডলার বিনিময়ের বাজারে চাহিদার তুলনায় ডলারের জোগান কমছে। টাকার সঙ্গে ডলার বিনিময়ের একটা বড় সূত্র আমদানি ও রপ্তানি। যিনি আমদানি করছেন, তিনি টাকা দিয়ে ডলার কিনতে চাইছেন; যিনি রপ্তানি করছেন, তিনি ডলার উপার্জন করে টাকার বিনিময়ে সেই ডলার বিক্রি করছেন। আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম হতে থাকলে ডলারের চাহিদা তার জোগানের থেকে বাড়তেই থাকবে, ফলে বাজারের নিয়মে টাকার দাম কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেবে। এ প্রবণতা ঠেকানো যেতে পারে, যদি অন্য কোনো সূত্রে ডলার পাওয়া যায়।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ঠিক না হলে বড় ধরনের সংকটের পথে এগোবে দেশের অর্থনীতি এবং এখন পর্যন্ত সেটি থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ প্রবাসীর পাঠানো কষ্টার্জিত অর্থে সচল থাকে দেশের অর্থনীতি। এমনকি ২০২৩ সালে রেকর্ড ১৩ লাখ কর্মী বিদেশে গেছেন। সে তুলনায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়েনি। কারণ ডলারের দাম বেশি পাওয়া এবং পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় হুন্ডিতে আকৃষ্ট হচ্ছেন প্রবাসীরা। চাহিদা আর জোগান সামলাতে হলে মুদ্রাবাজারকে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করে দিতে পারলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
উদ্বেগটা অনেক বেশি এ কারণে যে, আমদানির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রেখে কমিয়ে আনার পরও রিজার্ভ কমার প্রবণতা ঠেকানো যায়নি। ডলারের খরচ কমানোর পরও সেটা স্থিতিশীল হচ্ছে না। অনেক অর্থনীতিবিদ বলছেন, পরিস্থিতি যতটা খারাপ হয়েছে, তা অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে হয়েছে।
রিজার্ভকে ইতিবাচক দিকে ফেরানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। গত ১৭ জানুয়ারি মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন ডলার সংকট প্রসঙ্গে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে। এখন বিদেশি বিনিয়োগ, বিদেশি ঋণের প্রকল্পের অর্থছাড় ও বাণিজ্য অর্থায়নের ঋণ বাড়বে। এ ছাড়া বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপও কমে আসবে। তাতে সামনে ডলারের ওপর চাপ কমে যাবে। তবে ডলার সংকট কবে নাগাদ কাটবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু বলেননি গভর্নর। কিন্তু এখন দেখছি দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমছে।
আসল কারণ হলো দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আসার পরিমাণ কমে গেছে। রপ্তানির জন্য রেট বেঁধে দেওয়ায় অনেক ব্যাংকও বৈদেশিক মুদ্রা কিনতে পারছে না। অর্থাৎ ডলারের জোগান বা সরবরাহ বাড়ছে না, কিন্তু খরচ অব্যাহত রয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভে থাকা ডলার সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে তাদের হাতে থাকা রিজার্ভ প্রতি মাসেই কমছে। এ অবস্থায় বড় বড় প্রকল্পের জন্য যে বিভিন্ন সুদে অর্থ নেওয়া হয়েছে, তা পরিশোধের সময় ঘনিয়ে আসায় শঙ্কা আরও বাড়ছে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন