বহু বছর ধরেই দেশে সিন্ডিকেটবাজি চলছে বলে ধারণা সাধারণের। এক-এগারোর সরকারের সময় প্রথম সিন্ডিকেটবাজি শব্দটি বেশি করে আলোচনায় আসে। বিগত কয়েক বছরে পেঁয়াজ, আলু, কাঁচামরিচ, ডিম, সয়াবিন তেল, চিনিসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম বেশ কয়েকবার হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছিল। সর্বশেষ ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি করার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাজারে তার দাম এক লাফে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। সরকারের হস্তক্ষেপে এবং বিশেষ অগ্রাধিকারে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি আশ্বাসে তা কিছু কমেছে। বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসার পর দাম কমেছে। সার্বিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এভাবে দ্রব্যমূল্য হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কথা নয়। এর পেছনে সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করে বলে জনমনে ধারণা রয়েছে। বেশ কয়েকটি ছোট-বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে সরকার বিভিন্ন সময়ে আর্থিক শাস্তিও দিয়েছে। এসব শাস্তি নির্দেশ করে যে বাজারে সিন্ডিকেটবাজি সক্রিয়।
রমজান, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি, কোনো পণ্যের কম উৎপাদন কিংবা যেসব দেশ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা হয়, সেসব দেশে উৎপাদন কম হওয়া অথবা রপ্তানি বন্ধ বা বাড়তি কর বা কোটা আরোপ ইত্যাদি অজুহাত দেখিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে হঠাৎ করে কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। সিন্ডিকেটবাজি সম্পর্কে জনমনে এমনই ধারণা। এ ধারণা সঠিক নয়, এমন কথা বলার মতো কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। সিন্ডিকেটবাজির সঙ্গে সরকারের ভেতরে থাকা কর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলেও ধারণা আছে সাধারণের। এ কাজ এমন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করা হয় যে, সরকারের ওপরমহল চাইলেও তাৎক্ষণিকভাবে এর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
সিন্ডিকেটবাজি বন্ধ করতে হলে বাজারকে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রথম এবং প্রধান শর্তই হচ্ছে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার। তা না হলে মুক্তবাজার অর্থনীতি জনকল্যাণে নয়, গুটিকয়েক পুঁজির মালিকের পকেট ভারী করে, সাধারণ মানুষ বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হয়, সমাজের সম্পদের পুনর্বণ্টন সঠিকভাবে হয় না। বাজারকে কোনো দেশ কোনোকালে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ রাষ্ট্রগুলোকে দেশীয় পণ্যের সুরক্ষা দিতে হয়। নইলে দেশ বিদেশনির্ভর হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এখনো এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এতটা যৌক্তিক এবং মানবিক হয়নি যে, কোনো দেশ ডেভিড রিকার্ডোর ‘তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্ব’ পুরোপুরি মেনে চলতে পারে। তা ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ—এসব লেগেই আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেহেতু পুরোপুরি বিদেশনির্ভর হওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু একটা ভারসাম্যমূলক নীতি নিয়ে একূল-ওকূল দুই-ই রক্ষা করতে হয়। আমাদের জাতীয় সংবিধানেও রয়েছে মিশ্র অর্থনীতির নির্দেশ। মুখে মুখে শুধু মুক্তবাজার অর্থনীতির বাগাড়ম্বর।
মিশ্র অর্থনীতি অনুসরণ করে উৎপাদন, আমদানি এবং রপ্তানি নীতি এমনভাবে গ্রহণ করতে হয় যে, কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য কোনোভাবেই সম্পূর্ণরূপে বিদেশনির্ভর হওয়া যাবে না। পুরোপুরি বিদেশনির্ভর হলে কী হয় তার বাস্তব রূপ আমরা করোনাকালে দেখেছি। করোনাকালের আগে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশ বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্যের জন্য আমদানিনির্ভর ছিল, করোনাকালে সেসব দেশ অনেক পণ্য বাজারে পায়নি। আমরা প্রধান খাদ্যদ্রব্যগুলো উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় করোনা আমাদের বড় রকমের কোনো সমস্যা করতে পারেনি। তবে এখনো আমরা জ্বালানি তেলের জন্য পুরোপুরি, চিনি ও ভোজ্যতেলের জন্য অনেকখানি এবং পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ আরও কিছু পণ্যের জন্য খানিকটা আমদানিনির্ভর। এ নির্ভরতার জায়গাটা কতটা লম্বা, চওড়া এবং গভীর তা বেশ ভালো করে বুঝে নিয়ে উৎপাদন, আমদানি ও রপ্তানিনীতি নির্ধারণ করতে হয়। আমরা প্রায়ই দেখতে পাই যে, আমাদের নীতিনির্ধারণী কাজগুলোতে ঠিকমতো মাপজোখ করে করা হয় না। করা হয় তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে। ট্রাবল শুটিং নয়, দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা। কৃষিজাত পণ্যগুলোর উৎপাদনের তথ্য নিয়েও বিভ্রাট দেখা যায়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় একরকম তথ্য দেয়। পরিসংখ্যান ব্যুরো দেয় আরেকরকম। কোনটা সঠিক? সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী এবং বিশ্লেষকরা কার দেওয়া তথ্য নেবে? এ সমস্যা দূরীকরণে আমাদের উৎপাদন পরিমাপ করার পদ্ধতিগুলো আধুনিক করে তুলতে হবে। এতে সরকারের জনবল এবং আর্থিক বিনিয়োগ করার প্রয়োজন আছে। আমরা যদি কোনো কৃষি পণ্যের মৌসুমের সময়ে সঠিকভাবে জেনে যাই যে উৎপাদন কতটুকু হয়েছে, সারা বছর ধরে এ পণ্যের চাহিদা কত হবে এবং ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত কী দাঁড়াবে, তাহলে আমদানি ও রপ্তানিনীতি গ্রহণ সহজ হয়। কোনো পণ্যের ওপর কতটুকু কর বসাতে বা তুলে নিতে হবে, কোন পণ্য কতটুকু আমদানি বা রপ্তানি করতে হবে ইত্যাদি পরিমাপ করে আগেভাগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকা যায়। এতে হঠাৎ করে সংকট তৈরি হবে না। অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটবাজি করার সুযোগ পাবে না।
দেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি এবং পণ্যের হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকগুণ দাম বেড়ে যাওয়া দ্রব্যমূল্য বেশি হওয়ার আরেক বড় কারণ। ছোট, বড় সবরকমের পাইকারদের ওপর সরকারের নজরদারি অত্যন্ত প্রয়োজন। পণ্য সংগ্রহ খরচের সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ যোগ করে দিলে, তা নিয়মিত অনলাইনে মনিটরিং করলে এবং পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারলে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য।
নিত্যপণ্যের সরবরাহ সিন্ডিকেটমুক্ত করতে হলে আমদানি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনোরকম লাইসেন্স, পারমিট, কোঠা ইত্যাদি রাখা যাবে না। যেসব পণ্য আমদানি বা রপ্তানি করতে হবে তার জন্য ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীকে অবাধ সুযোগ দিতে হবে। যারা নিত্যপণ্য গুদামজাত করতে চাইবে তাদের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি গুদামজাত করতে হলে ব্যবসায়ীদের সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। এমন নিয়ম করা যেতে পারে—অনুমতির বিনিময়ে তাদের সরকার স্বীকৃত সফটওয়্যারে গুদামজাত পণ্যের তথ্যাবলি সংরক্ষণ করতে হবে, কেনাবেচার তথ্যাবলি প্রতিদিন হালনাগাদ করতে হবে এবং সে তথ্য সরকার যেন যে কোনো সময় দেখতে পায় তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সরকারি গুদামসহ সব পণ্যের ডাটাবেজে অভিগমনের সুযোগ থাকলে সরকার সব পণ্যের বর্তমান মজুত সম্পর্কে হালনাগাদ থাকবে, মজুতদাররা নিয়ন্ত্রণে আসবে, সিন্ডিকেটবাজি দূর হবে।
আমাদের অনেক পণ্য সংরক্ষণের অভাবে পচে যায় মৌসুমের সময় সঠিক দাম পাওয়া না যাওয়ায়। পেঁয়াজের ২৫ শতাংশই পচে যায় বলে আমদানি করতে হয়। তা না হলে আলু-পেঁয়াজসহ অনেক পণ্য আমদানি নয়, রপ্তানি করা যেত। এর জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আধুনিক গুদাম তৈরি করা দরকার। এ কাজে ব্যাংকগুলো এবং সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
সিন্ডিকেটবাজি দূর করার জন্য ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের কাজকর্ম জনগণের কাছে দৃশ্যমান নয়। ওপরে যেসব কাজের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করার কাজ প্রতিযোগিতা কমিশন করতে পারে। আইনগতভাবে তারাই এ কাজের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রস্তাবিত কাজগুলো করতে হলে তাদের লোকবল এবং তথ্যপ্রযুক্তি দরকার হবে। সরকার তাদের পর্যাপ্ত বাজেট দিয়ে শক্তিশালী করে তুললে চিরতরে দূর হবে সিন্ডিকেটবাজি, জনগণ ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাবে, কৃষক তার শ্রমের ন্যায্য দাম পাবে, সুষম বণ্টন হবে সামাজিক সম্পদের, কমে যাবে অর্থনৈতিক বৈষম্য।
লেখক: চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট