আমাদের জাতীয় জীবনে এ মাসটির মতো এমন ঘটনাবহুল, এমন রক্তরঞ্জিত, এমন গৌরবময় মাস আর দ্বিতীয়টি নেই। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার কবিতায় মার্চ মাসকে অভিহিত করেছেন ‘মার্চ গাছ’ হিসেবে। মার্চ এমনই এক মাস, যা ইতিহাসের উজ্জ্বল রশ্মি বিকিরণ করে। মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্যতম গৌরবান্বিত বা আন্দোলন-সংগ্রামের মাস। মার্চ হলো উত্তাল মার্চ, অগ্নিঝরা মার্চ। স্বাধীনতার মাস, সংগ্রামের মাস। অগ্নিঝরা ৭ মার্চের মাস বলতে পারেন। ইতিহাসে অসংখ্য ঘটনার বিবরণী লেখা আছে মার্চের দিনগুলোতে। বড় ঘটনাগুলোর পাশাপাশি মার্চের যে দিনগুলো আমাদের নজরে আসা দরকার, সে রকম কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক—
(এক) ১৭ মার্চ ১৯২০। ‘ওই মহামানব আসে দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে মর্তভূমির ঘাসে ঘাসে। সুরালোকে বেজে ওঠে শঙ্খ-নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক, এলো মহাজন্মের লগ্ন’ রবীন্দ্রনাথের মতো করেই বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর জন্ম মহাজন্মের লগ্ন। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক আহমদ ছফা লিখেছিলেন: ‘আজ থেকে অনেকদিন পরে হয়তো কোনো পিতা তাঁর শিশুপুত্রকে বলবেন—জানো খোকা, আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন, যাঁর দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে, তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্না রাতে রুপালি কিরণধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি ও নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে, তা হলো তাঁর ভালোবাসা। জানো খোকা তাঁর নাম? শেখ মুজিবুর রহমান।’ একাত্তরের মার্চ যদি হয় উত্তাল, সংগ্রাম আর অগ্নিঝরার প্রতীক, সেই উত্তাপের বা সেই আগুনের ফুলকির আবির্ভাব হয়েছিল ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাংলা কিংবা বঙ্গের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। হাজার বছরের এই পুরোনো ইতিহাসে রয়েছে কয়েকশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যেখানে বাঙালিরা হেরেছে আবার জিতেছে। যদি প্রশ্ন করা হয় এই উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গৌরবান্বিত বা উজ্জ্বলতম ঘটনা কোনটি? বাঙালি নির্দ্বিধায় উত্তর দেবে—আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। প্রশ্নটা আরেকটু বড় করে যদি করা হয়, বাঙালির এই সহস্র বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ সন্তানের নাম কী? উচ্চৈঃস্বরে উত্তর আসবে—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই বলা হয়ে থাকে—মহাবিজয়ের মহানায়কের নাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবি মোহাম্মদ রফিকের ভাষায় ‘বাঙালির শুদ্ধনাম শেখ মুজিবুর রহমান’।
(দুই) ১১ মার্চ ১৯৪৮। বঙ্গবন্ধু তার জেলখানার ভেতরে বসে লেখা খাতায় (অসমাপ্ত আত্মজীবনী) ভাষা আন্দোলনের সময় কারাবরণের কথা উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের জন্য প্রথম কারাবরণ করেছিলেন ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এদিনই প্রথম রাষ্ট্রভাষার জন্য দেশব্যাপী সবাই গর্জে উঠেছিল একসঙ্গে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার লেখায় উল্লেখ করেছিলেন: “মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কিছু শাখা জেলায় ও মহকুমায় করা হয়েছে। তমদ্দুন মজলিস একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, যার নেতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম সাহেব। এদিকে পুরানা লীগ কর্মীদের পক্ষ থেকে জনাব কামরুদ্দিন সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও অনেকে সংগ্রাম পরিষদে যোগদান করলেন। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হল।” এদিনই প্রথম রাষ্ট্রভাষার জন্য রাজপথে রক্ত দিয়েছিল বাংলার ছাত্র-জনতা। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলের এক সভায় বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে ২৮ সদস্যের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। নবগঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ থেকে অধ্যক্ষ আবুল কাশেম ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করে এবং ধর্মঘট আহ্বান করেন। সেদিন সকাল ৯টার দিকে বঙ্গবন্ধু ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে ছাত্রদের সঙ্গে সচিবালয়ের সামনে উপস্থিত হন। পরিকল্পনা ছিল তিন-পাঁচজন করে সচিবালয়ের গেটগুলোতে পিকেটিং করবে এবং এক গ্রুপ ধরা পড়লে পরবর্তী গ্রুপ পিকেটিং চালিয়ে যাবে। সকাল ৯.৩০-১০টার মধ্যে সচিবালয়ের কর্মচারীরা তাদের আন্দোলনে বাধা দিতে শুরু করল। সিটি এসপি আবদুল গফুরের হুকুমে পুলিশ তৎপর হয়ে উঠল এবং ইংরেজ ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ মি. চ্যাথাম লাঠি চালানোর আদেশ দিলেন। কিছুক্ষণ পরই বঙ্গবন্ধুসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলো। সেদিন সন্ধ্যা নাগাদ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করে সরকার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভাষা আন্দোলনে প্রথম গ্রেপ্তার হওয়া কারাবন্দিদের অন্যতম একজন। ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান এবং ওইদিন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আট দফা চুক্তি হয়। ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশের আহ্বান করা হয়। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮-১৯৫২ সাল পর্যন্ত ১১ মার্চ ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হতো।
(তিন) ২৩ মার্চ ১৯৬৬। ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার প্রথম সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের অবসান হয়। তাই তাসখন্দ চুক্তি পর্যালোচনার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরা ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে একটি জাতীয় সম্মেলন ডাকেন। বঙ্গবন্ধু প্রথমে প্রতিনিধিদল পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর সম্পাদক মানিক মিয়া বললেন, ‘যদি যেতেই হয়, আপনিই যান। আর আপনার মনে এতকাল যে কথাগুলো আছে, সেগুলো লিখে নিয়ে যান। ওরা শুনুক, না শুনুক, এতে কাজ হবে।’ বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন যাবেন এবং লাহোরে কী কী বিষয় আলোচনা করবেন সে বিষয়ে একটা খসড়া করে ৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ও নূরুল ইসলামকে নিয়ে লাহোরে যান। কিন্তু সেদিন সেই সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ‘ছয় দফা’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জানালে বঙ্গবন্ধু ১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরেন। ২০ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ‘ছয় দফা’কে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ছয় দফা’ কর্মসূচি নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের জনসভায় ‘ছয় দফা’কে বঙ্গবন্ধু ‘নূতন দিগন্তের নূতন মুক্তিসনদ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা প্রচারের জন্য তার নেতৃত্বে ছয় সদস্য বিশিষ্ট ‘উপকমিটি’ গঠন এবং ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা মুদ্রিত ও প্রকাশ করেন। একই বছরের ১৮-২০ মার্চ ছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এদিন কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিলি করা হয়। সেদিনের কাউন্সিল সভায় আগত ১ হাজার ৪৪৩ কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে এবং ‘ছয় দফা’র ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের একটি খসড়াও অনুমোদন করে। এবং অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার প্রথম সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেছিল। ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত এই পাঁচ বছর ধরে চলতে থাকা ছয় দফা আন্দোলন অবশেষে এক দফায় রূপান্তরিত হয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে। এই ছয় দফার জন্য বঙ্গবন্ধু মোট আটবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর কোটে যে ৬টি বোতাম ছিল, তা এই ছয় দফার প্রতীক। অতএব, ২৩ মার্চের ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ৭ মার্চের চার দফা এবং আমাদের স্বাধীনতা একই সুতায় গাঁথা।
(চার) ৭ মার্চ ১৯৭১। উত্তাল মার্চ। যে কারণে উত্তাল বলা হয় তার সবচেয়ে বড় কারণ ৭ মার্চের ভাষণ। শিখা চিরন্তনের এই ঐতিহাসিক স্থানে সেদিনের সেই সভায় কোনো সভাপতি ছিল না। কোনো প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি ছিল না। ছিল কেবল একজন বক্তা, একজন স্বাধীনতার ঘোষক। ১ হাজার ১০৮টি শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো মানুষ শুনেছেন আর উপলব্ধি করেছেন, আমাদের স্বাধীনতার ডাক এসে গেছে। ৪টি দফা দিয়েছেন, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব বলেছেন। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। শুধু বলতে পারেনি আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, যেটা তিনি বলেছিলেন ২৫ মার্চ, অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে— ‘From today Bangladesh is independent.’ কিন্তু সেদিনের সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটা প্রত্যক্ষভাবে বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। তারা পশ্চিম পাকিস্তানে রাওয়ালপিন্ডিতে রিপোর্ট দিয়েছিল— চতুর শেখ মুজিব কার্যত অর্থে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণা করে দিয়েছে; কিন্তু আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। আর এই অমর ভাষণের জন্য ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘Newsweek’-এর সাংবাদিক লোরেন জেঙ্কিন্স তার প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজনীতির কবি’ (Poet of Politics) বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
(পাঁচ) ২৬ মার্চ ১৯৭১। এদিন ‘OPERATION BIG BIRD’ নামে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার পর ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর ওয়্যারলেস মেসেজ পাঠিয়ে বলেছিলেন, ‘BIG BIRD IN CAGE, SMALL BIRDS HAVE FLOWN.’ বাঙালি হাজার বছর ধরে যেদিনটার জন্য অপেক্ষারত ছিল, সেটা অবশেষে এলো ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। সেই প্রাচীন আমল থেকে এই বঙ্গের মুক্তিকামী মানুষ কখনো স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। বাংলার আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই স্বাধীনতা এনে দিলেন ২৫ মার্চ রাতে, অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম লগ্নে। সেদিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান মেজর খাদিমকে সরাসরি বলেছিলেন, ‘খাদিম, আজই করতে হবে কাজটা।’ পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে টিক্কা খান আরও বলেন, ‘এদেশের মানুষ চাই না, মাটি চাই।’ সেই সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার বই ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’-এ লিখেছেন: মুজিবের গোয়েন্দারা গোটা খেলাটা বুঝে গিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানের নিরাপত্তা টিমে কর্মরত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ আর চৌধুরী দেখে ফেলেছিলেন যে, একটা ডজ গাড়িতে ইয়াহিয়া খানের মালপত্র বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। তিনি সেটা শেখ মুজিবের কাছে জানিয়ে দিয়েছিলেন। অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে বঙ্গবন্ধু ১২টা ৩০ মিনিটে ওয়ারীর বলধা গার্ডেন থেকে ইপিআর-এর সিগন্যাল কোরের সুবেদার মেজর শওকত আলী ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর টেপকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন। ঘোষণাটির একটি কপি চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে পৌঁছে যায়। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর বড় করে ছাপানো ‘LEADER OF REBELS IN EAST PAKISTAN REPORTED SEIZED’ প্রতিবেদনটি। এ প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা আছে: ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানের রেডিও বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তারের খবর জানাতে গিয়ে তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে অভিহিত করেছে। বলা হয়েছে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করা হয়েছে।’ ২৬ মার্চ রাতে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান রেডিও এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেন। শেখ মুজিবকে পুরোপুরি দোষারোপ করে তিনি বলেছিলেন, ‘Sheikh Mujib has declared independence of East Pakistan. He is a traitor. This time he will not go unpunished.’ উদাহরণস্বরূপ সে সময়ের দু-একটি সংবাদ শিরোনাম উল্লেখ করছি— ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপিয়ে পাশেই লেখা হয়: ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক’, ‘ব্যাংকক পোস্ট’-এর খবরে বলা হয়: ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছ’, ‘ভয়েস অব আমেরিকার’ খবরে বলা হয়: ‘... ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।’ ‘৭১-এর ২৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র সময় সকাল সাড়ে ৭ ঘটিকার ‘এবিসি টেলিভিশন’-এর সংবাদে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা প্রচার করা হয়। অতএব, মার্চ বঙ্গবন্ধুর, মার্চ বাংলাদেশের, মার্চ মুক্তিকামী মানুষের গৌরবান্বিত বা বিজয়গাথার এক অধ্যায়ের নাম। আজ থেকে ২০ বছর আগে ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ ১৪১০) ‘বিবিসি’র জনমত জরিপে বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ঘোষণা করা হয়। সেদিন পহেলা বৈশাখ আওয়ামী লীগের শোভাযাত্রা শেষে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী ও একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা গত ২৯ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা এবং তার মর্যাদা খাটো করার ষড়যন্ত্র করেছে। সঠিক ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাস সব সময় সত্যকেই স্বীকৃতি দেয়। তাই সমগ্র বিশ্বের সব বাঙালির রায়ে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ প্রমাণিত হয়েছে ইতিহাস সত্য কথা কয়। আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে এদেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাব। দুঃশাসনের কবল থেকে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করবই।’
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা লন্ডন থেকে বার্তা সংস্থা ‘ইউএনবি’কে দেওয়া তার প্রতিক্রিয়ায় ‘বিবিসি’ ও তার শ্রোতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘আজ এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে সঠিক স্থান দিয়েছে। এ ঘটনায় সীমাহীন আনন্দ প্রকাশ করে শেখ রেহানা বলেন, ‘বাঙালির হৃদয় থেকে কেউ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলতে পারবে না। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন বঙ্গবন্ধু।’
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক