আলম রায়হান
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৪, ০৩:২৯ এএম
আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৪, ০৮:১১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

লেজে কুকুর নাড়ে!

লেজে কুকুর নাড়ে!

সাধারণভাবে বলা হয়, আমলাতন্ত্রের মাধ্যমেই দেশ শাসিত হচ্ছে। কিন্তু চলমান ধারার ফলাফল এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী? জরুরি প্রশ্ন, সুশাসন কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? স্বীকৃত বিষয় হচ্ছে, সুশাসন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং দক্ষ ও মেধাবী সরকারি কাঠামো এবং এ দুইয়ের সুষ্ঠু ভারসাম্যে নিশ্চিত করা। কিন্তু অনেকের বিবেচনায়, আমাদের দেশে এ ভারসাম্যের বিষয়টি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত লাগাতরভাবে। যে ধারার সূচনা করে গেছেন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান। এদিকে যাত্রাগানের বিবেকের মতো হলেও সত্য কথা, শক্তভাবে বলার বাম ধারার রাজনীতিক ও মুক্ত চেতনার বুদ্ধিজীবী শ্রেণি প্রায় বিলুপ্ত। বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, রাজনীতিবিদরা যতই পথভ্রষ্ট হোন না কেন, জনগণের কাছে তাদের কিছুটা হলেও দায়বদ্ধতা থাকে। জনগণের মুখোমুখি হতে হয় স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের সময়ে। অনেক বছর পর হলেও গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে বিষয়টি বেশ উপভোগ্য হয়েছে। জনগণের কাছে রাজনীতিকদের জবাবদিহি করার বিষয়টি থেকেই যায়। এদিকে আমলাদের জবাবদিহি করার বিধান রয়েছে শুধু তাদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাছে, যা কালের আবর্তে কোথায় পৌঁছেছে তা বিবেচনা করা প্রয়োজন। অনেকের বিবেচনায়, বিষয়টি কাজির গোয়ালের বাস্তবতার পর্যায়ে পৌঁছেছে অথবা নেমেছে। আর আমলাতন্ত্রে ক্রমাগত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণ করা হলে যে চিত্র মিলবে সেটা কিন্তু স্বস্তিকর নয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন একটি সংস্থার প্রধানের অবসরে যাওয়ার মাসখানেক আগে ‘জ্ঞান অর্জনে’ বিদেশ সফরের চেষ্টা এবং বিদায়ী বদলি বাণিজ্যের যে খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তা কিন্তু আমলাতন্ত্রের অনেক গভীরের নগ্নদশা স্পষ্ট করেছে। এরকম ঘটনা অনেক আছে। এরা খুবই ক্ষমতাধর। সব মিলিয়ে দেশে বিরাজমান ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক ধারায় আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। কিন্তু এ বৃদ্ধি ধারণের অবস্থায় কি আমাদের আমলাতন্ত্র উন্নতি হয়েছে?

দেশে অনেক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ও হচ্ছে, যা অকল্পনীয় উন্নয়ন হিসেবে দৃশ্যমান। পাশাপাশি মনে করা হয়, সুশাসনের বিষয়টি সবচেয়ে অবহেলিত আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো রাজনীতির দৈন্যদশা। সাধারণভাবে রাজনীতিকরা শক্ত অবস্থানে নেই বলে আমলাতন্ত্র অধিকতর গুরুত্ব পায়, আশকারাও বলা চলে। একে আরও জটিল করে তুলেছে রাজনৈতিক গুমোট অনিশ্চয়তা। দেশ পরিচালনায় সরকার শক্ত অবস্থানে থাকলেও ‘কখন কী হয়’ এরকম একটি ধারণা সাধারণের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে, অথবা কৌশলে সংক্রমিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পুঁজি হচ্ছে, আমেরিকার জুজুর ভয়। যাকে ভিত্তি দিয়েছে আমেরিকার ওপর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অতিনির্ভরতা। যদিও এ থেকে সাবেক শাসক দলটির কোনো ফায়দা লাভ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজনের ধারায় জনগণ ও গণতান্ত্রিক ধারার আস্থা রাখার সুযোগ হ্রাস পেয়েছে। অথচ সামরিক শাসনের ধকল কাটিয়ে ১৯৯১ সালে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।

গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের আধাসামরিক সরকারের অবসান হওয়ার পর সবকিছু ঢেলে সাজিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার সুবর্ণ সুযোগ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার বৈরিতায় আশার প্রদীপ সর্বনাশা অগ্নিতে পরিণত হয়েছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তির গণতান্ত্রিক রীতিনীতিবিরুদ্ধ প্রবণতার জনগণনির্ভর রাজনৈতিক ধারা দুর্বল হয়েছে ক্রমাগত। এদিকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সর্বনাশা পটপরিবর্তনে রাজনীতির ধারায় যে বাঁক পরিবর্তন হয়েছে, সেটিই আবার ফিরিয়ে আনার অপচেষ্টা হয়েছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে। এ ঘটনায় আবার অকাট্যভাবে প্রমাণিত, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে বিনাশ করা হচ্ছে ৭৫-এর থিঙ্কট্যাঙ্কের একমাত্র এজেন্ডা। ফলে গণতান্ত্রিক ধারা বিকশিত করার ক্ষেত্রে সমঝোতার রাজনীতির পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায়। আরও পরিষ্কার করে বললে, দেশের রাজনীতিতে একটি মাত্র কবর রচিত হওয়ার মতো পরিবেশ হয়েছে। এই কবরে যাবে, হয় ৭১ বিজয়ী পক্ষ অথবা পরাজিত শক্তি। নির্বাচন বর্জনের ধারায় ৭১-এ পরাজিত শক্তি প্রায় কবরের কিনারে পৌঁছে। কিন্তু এ শক্তিকে ক্রোরামিন দিয়ে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে বলে অনেকেরই ধারণা। এ ক্ষেত্রে প্রধান সহায়ক পশ্চিমা বিশ্ব। নানানভাবে সরকারকে চাপে রাখা হচ্ছে। এতে জোর হাওয়া লেগেছে রাজনীতির বিভাজনে। আর বিরোধী পক্ষকে মোকাবিলায় কঠোর পথে হাঁটে সরকার। ফলে আশকারা পায় আমলাতন্ত্র। সরকার পরিচালনা ও টিকে থাকতে আমলাদের ওপর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নির্ভরতা বেড়েছে। উল্লেখ্য, আমলাদের ওপর রাজনৈতিক নির্ভরতার বিষয়টি সাধারণের কাছেও দৃশ্যমান হয়েছে ১৯৯৬ সালে। ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে ‘জনতার মঞ্চে’ যোগ দিয়ে অসংখ্য আমলা তৎকালীন খালেদা সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন। কোন দল ক্ষমতায় আসবে তা নির্ধারণে আমলারা প্রকাশ্যে জোটবদ্ধভাবে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন। এটি বাংলাদেশের প্রথম ঘটনা। এ ঘটনার পর আমলাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ছোটাছুটি করে এগিয়েছেন। পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও দক্ষতা।

বিরাজমান এ অবস্থা থেকে আমলাতন্ত্রের উত্তরণ কবে হবে কে জানে! তবে উত্তরণ অতি জরুরি। তা না হলে মৃদু ভূমিকম্পের মতো অশনিসংকেত আসতেই থাকবে। জানা কথা, বড় ভূমিকম্পের আগাম বার্তা দেয় একাধিক ছোট ভূমিকম্পন। তা আমলে নেওয়া হোক, অথবা নাইবা নেওয়া হোক। প্রসঙ্গক্রমে একটি উদাহরণ উল্লেখ করা যাক। খেজুরের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে শব্দ প্রয়োগে বড় ধরনের বিভ্রাটের বিষয়টি টক অব দ্য কান্ট্রি হয়েছে। উল্লিখিত চিঠিতে শব্দ প্রয়োগ কেলেঙ্কারি ঘটেছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ বিষয়ে ১৪ মার্চ ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বিচক্ষণতারই পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এই ভুল কার, মন্ত্রীর না আমলার? অবশ্যই আমলার! নিশ্চয়ই প্রতিমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী উল্লিখিত চিঠি তৈরি করেননি। আমলাদের কেউ এ চিঠি তৈরি করেছেন। এরপর সচিবসহ আমলাদের কয়েক টেবিল ঘুরে প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়া হয়েছে হয়তো। উল্লেখ্য, যেসব মন্ত্রণালয় প্রতিমন্ত্রী পরিচালনা করেন সেসব মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব থাকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। এ ছাড়া চলমান বাস্তবতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অধিকতর গুরুত্ব বহন করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতো সংবেদনশীল মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে এত বড় ‘কাঁচা ভুল’ কীভাবে হয়? আমলাকাণ্ডের আরেকটি বিষয় তো হাইকোর্ট পর্যন্ত পৌঁছেছে। বেইলি রোডের রেস্তোরাঁয় রহস্যজনক আগুন লাগার ঘটনায় নগরজুড়ে অসংখ্য রেস্তোরাঁর শত শত কর্মচারীকে গ্রেপ্তার এবং ভাঙচুরের কাণ্ডটি নিশ্চয়ই রাজনীতিকদের নয়। এই তুঘলকি সিদ্ধান্ত যারা নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে? এ আশা ক্ষীণ। অথচ প্রয়োজন হচ্ছে, যে আমলারা খেজুরের দাম প্রসঙ্গে চিঠি তৈরি করেছেন ও রেস্তোরাঁয় ঢালাও অভিযানের সঙ্গে জড়িত এবং অনিয়ম থেকে সুবিধা নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। যাতে অন্যরা সাবধান হন। কিন্তু তা কি হবে? সম্ভবত হবে না। এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে যাতে বিনা জবাবদিহিতায় আমলারা পার পেয়ে যান। তা হোক বৃদ্ধকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানো, তথ্য চাইতে যাওয়া সাংবাদিককে জেলহাজতে পাঠানো অথবা উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে জনপ্রতিনিধির সঙ্গে প্রকারান্তরে যুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি করে বরিশালে ১০ প্লাটুন বিজিবি চাওয়ার ঘটনা। সামগ্রিক অবস্থায় অনেকেরই হয়তো মনে পড়বে সেই প্রবচন, ‘কুকুরে লেজ নাড়ে না, লেজে কুকুর নাড়ে!’ এদিকে লেজে কুকুর নাড়া এবং সুশাসনের ক্ষেত্রে বিরাজমান করুণ দশার জন্য চূড়ান্ত বিচারে দায়ী মূলত রাজনীতিকরাই। দায় সওয়ারের, ঘোড়া অথবা গাধার নয়!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জোড়া সেঞ্চুরিতে রেকর্ড জয় ভারতের

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রোগ্রামার শাহেদা মুস্তাফিজকে নিয়ে রাহিতুলের বই

বাপার সংবাদ সম্মেলন / ‘পরিবেশ রক্ষায় প্রতিবন্ধক আমলারা, বন্ধু হচ্ছে জনগণ’

সর্বক্ষেত্রে মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করুন : সাবেক এমপি হাবিব

জুলাই ঘোষণাপত্র ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার অবৈধ : ফরহাদ মজহার

ভ্যাট-ট্যাক্স বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিলের আহ্বান

ঢাকায় নাটোরবাসীর মিলনমেলা শুক্রবার

সোনারগাঁয়ে শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব

বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ সংবিধান সংস্কার কমিশনের

পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন মোখলেছুর রহমান

১০

শেখ পরিবার সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ : দুদু 

১১

শীতে বাড়ছে ডায়রিয়া, ৮৫ শতাংশ রোগীই শিশু

১২

এসএমসি’র ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে লোগো উন্মোচন 

১৩

৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে ফের ভোটগ্রহণের প্রস্তাব

১৪

‘একদম চুপ, কান ফাটাইয়া ফেলমু’, অধ্যক্ষকে জামায়াত কর্মী

১৫

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন

১৬

বগুড়ায় নাশকতা মামলায় যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৭

বিয়েতে অস্বীকৃতি, বাবার গুলিতে মেয়ে নিহত

১৮

সাত কৃষককে ধরে নিয়ে গেল সন্ত্রাসীরা, মুক্তিপণ দাবি

১৯

ছাগলকাণ্ড : সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রিমান্ডে

২০
X