রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১
শংকর মৈত্র
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:১৭ এএম
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮:৫৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মোবাইল কোর্ট ও তথ্য অধিকার আইন নিয়ে কিছু কথা

চ্যানেল এসের পরিচালক ও বার্তাপ্রধান শংকর মৈত্র। সৌজন্য ছবি
চ্যানেল এসের পরিচালক ও বার্তাপ্রধান শংকর মৈত্র। সৌজন্য ছবি

২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ভ্রাম্যমাণ আদালতের কয়েকটি ধারার বৈধতার প্রশ্নে এক আপিল মামলার শুনানিতে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা মন্তব্য করেছিলেন, ‘সাধারণ মানুষের কথা কী বলব, আমার নিজেরই ভয় লাগে। বিনা কারণে কোনো নাগরিককে একদিন জেলে রাখাও সংবিধান সমর্থন করে না।’ (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর ১০/০২/১৮)।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় ক্ষমতার ব্যবহার উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছিলেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে মাজদার হোসেন মামলার রায় যথাযথ অনুসরণ করার কথাও বলেছিলেন সর্বোচ্চ আদালত। সর্বোচ্চ আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ দেওয়ার পরও এ পর্যবেক্ষণ কি মানা হচ্ছে? ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে সরকারের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ক্ষমতার অপব্যবহার করেই যাচ্ছেন। এর সর্বশেষ নজির হলো জামালপুরের এক সাংবাদিক তার সংবাদ-সংক্রান্ত কাজে তথ্য চাইতে গিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাকে ছয় মাসের জেল দিয়ে দেওয়া হলো। এই ঘটনা আইনের লঙ্ঘন কি না, জানি না; তবে ক্ষমতার যে লঙ্ঘন এটা স্পষ্ট। আরেক ঘটনা ১৪ মার্চ লালমনিরহাট সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লাহ আল নোমানের কার্যালয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে পাঁচ সাংবাদিককে আটক রাখেন এবং তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জেলে পাঠানোর হুমকি দেন। পরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গিয়ে এই এসিল্যান্ডকে নিবৃত করেন।

আরেকটি ঘটনাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় দেখতে পেলাম এক ব্যবসায়ীর দোকানে হানা দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ব্যবসায়ীর নানা অসংগতি নিয়ে জেরা করছেন। কাগজপত্র দেখছেন। একপর্যায়ে বয়স্ক ব্যবসায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে বলছেন, ‘হোল্ড অন’। আর যায় কোথায়? তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। ব্যবসায়ীকে বলছেন, ‘কী, এত বড় সাহস? আপনি আমাকে আদেশ দেন? আমি ম্যাজিস্ট্রেট। আমাকে আদেশ দিতে পারেন না। অনুরোধ করতে পারেন।’ এ ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে মনে হয় আমাদের আমলাতন্ত্রে প্রভুত্বের মনোভাবটা দিন দিন যেন বাড়ছেই। দুনিয়াজুড়ে যেখানে সরকারি কর্মচারীরা জনগণের সেবার মানসিকতা নিয়ে চাকরি করেন সেখানে আমাদের এখানে তারা ধরে নেন জনগণ হলো তাদের চাকর। তারা প্রভু।

জামালপুরের সেই সাংবাদিকের অপরাধটা কী ছিল? সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেল তিনি তার সংবাদ-সংক্রান্ত কাজের জন্য এডিপির কিছু প্রকল্পের বিষয়ে তথ্য চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে আবেদন করেছিলেন। আইন অনুযায়ী এটাই হওয়ার কথা। একজন সাংবাদিক বা যে কোনো নাগরিক সরকারি অফিসে তথ্য চাইতে পারেন। এজন্য তথ্য অধিকার আইন রয়েছে।

আমরা যদি তথ্য অধিকার আইনটি পড়ি তাতে দেখা যায়, প্রত্যেক নাগরিক সরকারের সব দপ্তরের (সুনির্দিষ্ট কয়েকটি তথ্য ছাড়া) তথ্য জানার অধিকার রাখেন। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে—“এই আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকিবে এবং কোনো নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাহাকে তথ্য সরবরাহ করিতে বাধ্য থাকিবে।”

আইনের এ ধারাটি পর্যালোচনা করলে স্পষ্টই বোঝা যায় কর্তৃপক্ষের কাছে শুধু সাংবাদিক নয়, প্রত্যেকে নাগরিক তথ্য চাইতে পারেন এবং কর্তৃপক্ষ তথ্য দিতে বাধ্য।

আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি এ আইনের অধীনে তথ্য প্রাপ্তির জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বা ইমেইলে অনুরোধ করতে পারবেন। যাতে নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত উল্লেখ করে এবং এজন্য সরকার নির্ধারিত ফি দাখিল করতে হয়। আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অনুরোধপ্রাপ্তির তারিখ হতে অনধিক ২০ দিনের মধ্যে অনুরোধকৃত তথ্য সরবরাহ করবেন। ৯-এর (২) উপধারা অনুযায়ী অনুরোধকৃত তথ্যের সঙ্গে একাধিক তথ্য প্রদান ইউনিট বা কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা থাকলে সর্বোচ্চ ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তথ্য সরবরাহ করতে হবে। ৯-এর (৩) উপধারায় বলা হয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোনো কারণে তথ্য প্রদানে অপারগ হলে অপারগতার কারণ উল্লেখ করে আবেদনপ্রাপ্তির ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তিনি তা অনুরোধকারীকে অবহিত করবেন। আইনের ৯ ধারায় ১০টি উপধারায় এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত বলা হয়েছে। সাংবাদিক আইনের বিধান মেনেই তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়েছিলেন। ইউএনও তথ্য না-ই দিতে পারেন। সাংবাদিকও ইউএনওর কাছে তথ্য না পেলে আইনমতে আপিল করতে পারেন তথ্য কমিশনে। কিন্তু তাকে এ সুযোগ না দিয়ে ভিন্ন অভিযোগে অর্থাৎ সরকারি কাজে বিঘ্ন সৃষ্টির অভিযোগ এনে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাকে সরাসরি ছয় মাসের জেল দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন। এটা তো ক্ষমতার চরম অপব্যবহার। এমন ঘটনা যে নতুন তাও নয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতার অপব্যবহারে প্রায়ই মানুষকে বিপদে পড়তে হয়। তারা আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে মাঝেমধ্যে এমন সব ঘটনা ঘটান যাতে জনপ্রশাসন সম্পর্কে মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে যায়। অথচ ভালোর জন্যই মোবাইল কোর্ট আইন করা হয়েছিল। খাদ্যপণ্যে ভেজাল জনবিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ইভটিজারদের বিরুদ্ধে জনকল্যাণে দ্রুত বিচারের স্বার্থে ২০০৭ সালে মোবাইল কোর্ট অধ্যাদেশ জারি করা হয়, যা ২০০৯ সালে আইনে পরিণত হয়। এ ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক হন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯-এর ৫ ধারায় উল্লিখিত যে কোনো সরকারি কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট; জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আঞ্চলিক অধিক্ষেত্রে যে কোনো এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে লিখিত আদেশ দ্বারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবেন। এই আইনের আওতায় একজন ম্যাজিস্ট্রেট কোনো ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং নির্ধারিত সীমার মধ্যে যে কোনো পরিমাণ অর্থদণ্ড আরোপ করতে পারেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আপিল করা যায়। আর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে জেলা ও দায়রা জজের কাছে আপিল করা হয়। সরকার জনগণের ভালোর জন্যই আইন করে। ২০০৯ সালের গুরুত্বপূর্ণ দুটি আইন তথ্য কমিশন আইন ও মোবাইল কোর্ট আইন যদি পর্যালোচনা করা যায় তাহলে দেখা যায় দুটি আইনের উদ্দেশ্যই ছিল মহৎ। তাৎক্ষণিকভাবে সংঘটিত অপরাধ, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যে ভেজাল জনবিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ইভটিজারদের বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকতেই পারে। কিন্তু এটার অপপ্রয়োগ হবে কেন আর অপপ্রয়োগ করছেন কারা? নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কেউ কেউ তাদের ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে পুরো মোবাইল কোর্ট আইনটিকেই বিতর্কিত করে ফেলছেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। একই অবস্থা তথ্য কমিশন আইনের ক্ষেত্রেও। আইনটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জনগণের তথ্য জানার একটি চমৎকার আইন এটি। রাষ্ট্রের অত্যন্ত গোপনীয় কিছু বিষয় ছাড়া আর সব ধরনের তথ্য জনগণকে জানার অধিকার দেওয়া আছে এ আইনে। প্রত্যেক সরকারি অফিসে তথ্য দেওয়ার সুনির্দিষ্ট একজন কর্মকর্তা রাখার কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু এই আইন মেনে কোনো নাগরিক তথ্য চাইলে তাকে তথ্য দেওয়া হয় না। সাধারণ নাগরিকরা হয়তো তথ্য চান না কিন্তু সাংবাদিকরা তাদের সংবাদের জন্য বিধিবিধান মেনে তথ্য চাইলেও তথ্য পেতে বেগ পেতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তথ্য দিতে টালবাহানা করা হয়। সরকারের কর্মীরা মনে করেন, তথ্য লুকিয়ে রাখা তার দায়িত্ব। কিন্তু এটা যে কত বড় ভুল তা তারা বোঝেন না। প্রথমত রাষ্ট্র সবার এবং জনগণকে নিয়েই সরকার। কাজেই জনগণের তথ্য জানার অধিকার রয়েছে। জনগণ তথ্য চাইলে তাকে দিতে হবে। আইনেও তা আছে। তথ্য না দিলে বরং আইনের ব্যত্যয় হবে। আর দ্বিতীয়ত তথ্য লুকিয়ে রাখলে এবং সঠিক তথ্য না দিলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। তথ্য বিভ্রাট ঘটে। সরকারি কর্মচারীরা এটা যত ভালো বুঝবেন সরকার ও রাষ্ট্রের জন্য ততই মঙ্গল হবে।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল এস

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বৃষ্টি নিয়ে সুখবর

গণঅধিকার অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে খুঁটি হিসেবে কাজ করছে

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত

‘ভারতকে ছাড়া বাংলাদেশের পরিস্থিতি উন্নতি হবে না’

ইসরায়েলকে ছাড় দিচ্ছে না প্রতিরোধ যোদ্ধারা

কয়রায় গণঅধিকার পরিষদের আনন্দ মিছিল 

অবশেষে কমলো সোনার দাম

ভারতে টাইগার রবির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ

যুক্তরাষ্ট্রে ঘূর্ণিঝড় হেলেনের ভয়াবহ তাণ্ডব

মামলার আসামি হলেই গ্রেপ্তার নয় : আইজিপি

১০

বৈরুতে বিপাকে বাংলাদেশিরা, দ্রুত সরে যাওয়ার পরামর্শ

১১

বিএনপি জনগণের ভালোবাসার ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় : নয়ন

১২

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের বিচার দাবি ‘সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের’

১৩

আরব শেখদের লালসার শিকার ভারতের কুমারীরাও!

১৪

বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে গেল ৯৯ টন ইলিশ

১৫

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে মাহমুদুর রহমান

১৬

নেতাকর্মীদের মানুষের পাশে থাকার আহ্বান যুবদল সভাপতির

১৭

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৫ জেলার বিদ্যুৎ শ্রমিকদের হুঁশিয়ারি

১৮

মরছে ফিলিস্তিন-লেবানিজরা, মুসলিম বিশ্ব কি হাততালি দেওয়া দর্শক?

১৯

সৈয়দ আফছার আলী ডিগ্রি কলেজ / ৮ বছর অনুপস্থিত থেকেও বেতন নেন পিয়ন সেলিম 

২০
X