মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১
ড. অরূপরতন চৌধুরী
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৪, ০৩:২৫ এএম
আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৪, ০৯:০৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পবিত্র রমজানেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত সময়

পবিত্র রমজানেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত সময়

ধূমপান বা তামাকজাতীয় দ্রব্য (জর্দা, গুল, সাদাপাতা, খইনি ইত্যাদি) স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। ধূমপান ও তামাক ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই সার্বিক দিক চিন্তা করে তামাক ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেন, তবে কোনটা তাদের জন্য মোক্ষম সময় সেটা খুঁজে পান না। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলা যায়, পবিত্র রমজান মাস ধূমপান, তামাকপাতা, জর্দা ছেড়ে দেওয়ার উপযুক্ত সময়। একজন মানুষ যখন সারা দিন কোনো কিছু না খেয়ে থাকতে পারে এবং দিনের এই দীর্ঘ প্রায় ১৩ থেকে ১৫ ঘণ্টা সময় না খেয়ে থাকতে পারে এবং সেই সময়ে সিগারেট, জর্দা, পান কোনো কিছুই না খেয়ে থাকতে পারে; তারা কেন জীবনের বাকি সময়ের জন্য ধূমপান বা তামাক ছাড়তে পারবে না? এটা তো সম্পূর্ণভাবে একজন মানুষের ইচ্ছা ও সংকল্পের ওপর নির্ভর করে। তা ছাড়া রমজান হচ্ছে সংযমের মাস। এ সময়ে মানুষ অনেক সংযমী হয় এবং সারা দিন ধর্মীয় নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলার সঙ্গে চলতে হয়। তাই এ রমজান মাস তামাক ও ধূমপানকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিন আপনার জীবন থেকে। এ সিদ্ধান্তের মধ্যেই নিজের এবং অন্যের মঙ্গল অন্তর্নিহিত। কেননা, তামাক বা ধূমপান কোনো খাদ্য নয় যে এটি আপনার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। এটি এক ধরনের ক্ষতিকর নেশা। এ নেশার মূল উপাদান ‘নিকোটিন’।

বহুকাল থেকে মানুষ দুভাবে তামাকের ব্যবহার করে আসছে। একটি হচ্ছে ধোঁয়াহীন তামাক বা জর্দা, গুল, সাদাপাতা আরেকটি হচ্ছে ধোঁয়াযুক্ত তামাক বা সিগারেট, চুরুট ইত্যাদি। বিজ্ঞানের গবেষণায় এ দুই ধরনের তামাকই দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তামাক এবং বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় সাত হাজারের বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। যার মধ্যে ৭০টি রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি ক্যান্সার সৃষ্টি করে।

তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে বছরে ৮৭ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। বাংলাদেশে তামাকের কারণে বছরে প্রাণহানি ঘটে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি (টোব্যাকো অ্যাটলাস-২০১৮)। সুতরাং করোনা মহামারির চেয়ে বড় মহামারি ‘তামাক’। এককথায় বলতে গেলে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ ও দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তামাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন—মাথার চুল পড়া, চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট, মুখ ও গলার ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, পাকস্থলীর ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, যৌনশক্তি নাশ, গর্ভপাত, মৃতশিশু জন্ম, পায়ের পচনশীল রোগ, গ্যাংগ্রিন, পা কেটে ফেলা ইত্যাদি। ধূমপান যে শুধু ধূমপায়ীকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নয়, বরং পাশে থাকা অধূমপায়ীকে সমানভাবে রোগাক্রান্ত ও মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে।

তামাক সেবন প্রতিরোধযোগ্য অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যয়বহুল রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। তামাক সেবনের ফলে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার ৬৭ শতাংশ যার অন্যতম কারণ তামাক সেবন। এর ফলে ফুসফুস, মুখ, খাদ্যনালি, গলা, মূত্রাশয়, কিডনি, লিভার, অগ্ন্যাশয়, কোলন, মলদ্বার এবং মহিলাদের জরায়ুর ক্যান্সারসহ মাইলয়েড লিউকোমিয়া এবং আরও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার হতে পারে। সব মিলিয়ে ২৭ শতাংশ ক্যান্সারের ক্ষেত্রে তামাক সেবনকে দায়ী করা হয়। ৯০ শতাংশ ফুসফুস ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই প্রধান কারণ তামাক, ধূমপান। অর্থাৎ তামাক সেবন অথবা ধূমপান বর্জন করলে ৯০ শতাংশ ফুসফুস ক্যান্সার এড়ানো সম্ভব। বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহার মৃত্যুর প্রতিরোধমূলক একমাত্র কারণ হিসেবে বিবেচিত এবং প্রতি দশজনে একজনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে সরাসরি দায়ী।

একজন ধূমপায়ী ব্যক্তি নিজের ক্ষতির পাশাপাশি আশপাশের অন্যদেরও ক্ষতি করে থাকে (পরোক্ষ ধূমপান), যা সম্পূর্ণ অনৈতিক কাজ। যারা ধূমপান করে বা তামাক সেবন করে তাদের মুখে ও শরীরে একধরনের উৎকট বিশ্রী দুর্গন্ধ হয়, যা মানুষের কষ্টের কারণ হয়। ধর্মেও এগুলোকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ধূমপান করে অন্যের ক্ষতির কারণ হওয়া বিষয়টি নিয়ে ধূমপায়ীসহ সবাইকে ভাবতে হবে। কারণ আমাদের দেশে বিশালসংখ্যক জনগণ তামাকের ভোক্তা। বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি তামাকসেবী জনগণের মধ্যে অন্যতম একটি দেশ।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস্) ২০১৭-তে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৩৫.৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিভিন্নভাবে তামাক সেবন করে। এর মধ্যে ১৮ শতাংশ ধূমপান করে, যার সংখ্যা ১ কোটি ৯২ লাখ। এদের কারণে আবার কর্মক্ষেত্রে ৪২.৭ শতাংশ, গণপরিবহনে প্রায় ৪৪ শতাংশ এবং ৪৯.৭ শতাংশ মানুষ রেস্তোরাঁয় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। বাড়ি, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র ও জনসমাগমস্থল মিলিয়ে এ সংখ্যা প্রায় আট কোটি! বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে বছরে ১২ লাখ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)।

সুতরাং এ পবিত্র মাসে যদি সিগারেট বা জর্দা না খেয়ে কাটাতে পারেন তবে বছরের বাকিটা সময় তামাকবিহীন থাকতে পারবেন না কেন? রোজা রাখার সময় থেকেই একজন ধূমপায়ীকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, আমি এই পবিত্র রমজান মাসে যেহেতু রোজা রাখব, নামাজ আদায় করব, সংযমী হব, সেহেতু আমি এখন থেকেই আমার এই বদভ্যাসটি বা নেশাকে পরিত্যাগ করব। সারা দিন রোজা রেখে ইফতারি করেই ধূমপানের তাড়না দেখা যায় অনেকের মধ্যে, যা রমজানের সংযমকে দুর্বল করে এবং স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো ফল আনে না। ইফতারের পর ধূমপান স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। তাই রমজানে ধূমপান ত্যাগ করার জন্য দৃঢ়চেতা ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকা উচিত। এ ক্ষেত্রে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোবল বজায় রাখতে হবে। একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এ ধরনের বদভ্যাস বা নেশা থেকে মুক্ত হতে পারেন। সুতরাং পবিত্র এ রমজান মাস থেকেই শুরু হোক সব ধরনের তামাক বর্জন। এ ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শও নেওয়া যেতে পারে।

আপনি যদি ধূমপান ছাড়তে পারেন তবে আপনার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবরাও বিভিন্নভাবে উপকৃত হবেন। যেমন—

১. তারা মুক্ত বায়ু সেবনের আস্বাদ পাবেন।

২. আপনি তাদের সঙ্গে মিশে আরও আকর্ষণীয় ও মধুর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবেন; কারণ একটি বিদেশি প্রবাদ আছে—একজন অধূমপায়ীকে চুমু দাও এবং তার স্বাদ অনুভব করো, দেখবে কত সুখকর সেই মুহূর্তটি।

৩. আপনি যদি ধূমপান না করেন তবে আপনার সন্তানও ধূমপান করবে না, কারণ শিশুরা যা দেখে তা-ই শেখে।

৪. যারা ধূমপান করেন, তাদেরই শুধু বিপদের সম্ভাবনা থাকে তা-ই নয়, আশপাশে যারা থাকেন তাদেরও বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ধূমপান ছাড়তে প্রবল ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন। কাজটি কয়েকটি পর্যায়ে করা যায়।

১. প্রথমত আপনি চিন্তা করে নিন কেন ধূমপান ছাড়বেন। মনে মনে শক্ত যুক্তি খুঁজে নিতে চেষ্টা করুন।

২. আপনি নিজের মনকে ওই যুক্তিগুলোর আলোকে ধূমপান ছাড়ার জন্য প্রস্তুত করতে থাকুন।

৩. সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপনি বিশেষ দিনে কাজটি সম্পন্ন করুন। সেই দিন অবশ্যই ধূমপান ছেড়ে দিন।

৪. আপনার ধূমপানের নেশার তাগিদ উঠলে অন্য কোনো কাজে বা চিন্তায় নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।

৫. রমজানে ইফতারের পর ধূমপানের ইচ্ছা প্রবল হয়। এ সময়ে চিন্তাশীল ও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকুন।

৬. রমজানের সংযম অন্য দিনগুলোতেও কাজে লাগান। যেমন—রোজা রাখাকালে যেমন খাদ্য বা কোনো পানীয় গ্রহণ না করে সংযম বজায় রেখেছেন, নিজের ও প্রিয়জনদের স্বার্থে সিগারেট সেবনের ক্ষেত্রেও সংযম বা সংকল্প ধরে রাখুন। দেখবেন আপনি জয়ী হবেন। আর জয়ী হতে পারলেই রক্ষা পেতে পারবেন তামাকজনিত অসংখ্য রোগের ঝুঁকি থেকে। তাই আর দেরি কেন? রমজান হোক তামাকের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পথ। প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও ধর্মের প্রতি অগাধ সম্মান ধূমপানের মতো ক্ষতিকর নেশা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা (একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র)

প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ক্রীড়াবিদ শওকত আলীর স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল

শাহরিয়ার কবির আটক

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

রাসূল (স.) আদর্শ ধারণ করে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে

ঝিনাইদহে নাশকতা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী সুজনের গ্রেপ্তারের খবরে বিএনপির আনন্দ মিছিল

মানিকগঞ্জে ধলেশ্বরী নদী থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার

ভূমি উপদেষ্টার পরিদর্শন, হয়রানি ছাড়া নামজারি খতিয়ান পেয়ে উৎফুল্ল নাজিম  

চট্টগ্রামে জশনে জুলুশে মানুষের ঢল  

বন্যা পরবর্তী প্রাণী চিকিৎসায় বাকৃবি শিক্ষার্থীরা

১০

‘দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির জন্য রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে’

১১

নার্সের ভুলে ৩ দিনের শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ

১২

‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড় গণসমাবেশ’ করার প্রস্তুতি বিএনপির

১৩

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালিত

১৪

রাত ১টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

১৫

সিরাজগঞ্জে কবরস্থানে মিলল অস্ত্র ও গুলি

১৬

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমিরের মতবিনিময়

১৭

২৮ থেকে ৪২তম বিসিএসের বঞ্চিত সেই ক্যাডাররা ফের বঞ্চনার শিকার

১৮

তিন বিভাগে ভারি বৃষ্টির আভাস

১৯

আমার কষ্ট নেই, আজ আমরা স্বৈরাচারমুক্ত : আহত তানভীরের পিতা

২০
X