একটি তরমুজের দাম নাকি আটশ টাকা! মানুষের আহাজারি দেখছি সামাজিক মিডিয়ায়। শুধু তরমুজ নয়, বিভিন্ন জিনিসের দাম নিয়ে কষ্টে আছে মানুষজন। এই যে দ্রব্যমূল্য ও তার নিয়ন্ত্রণহীনতা নিয়ে সরকারের কি আসলেই মাথাব্যথা আছে? সরকার বলতে শুধু সরকারপ্রধান তো নন, যেসব মন্ত্রী খুশিতে আটখানা হয়ে শপথ নেন, সরকারি গাড়ি হাঁকান, মাইক্রোফোনের সামনে রাতদিন বকবক করেন তাদের কাজ কী? হ্যাঁ, কাজ আছে বলতে পারেন। যেমন ধরেন আপনি খেজুর খাবেন না বরই দিয়ে ইফতারি করবেন সেটা তারা বাতলে দিতে পারেন। শুধু পারেনই না, নতুন নতুন তত্ত্বও বের করেন। এ কথাগুলো যে হাস্যকর এবং বিরক্তিকর তারা সেটা চেয়ারে থাকার সময় টের পান না। যেই চেয়ার চলে যায়, ইনু সাহেবের মতো গর্জে ওঠেন। তখন মনে হয় এগুলো বলা জাতির সঙ্গে মশকরা করা। এই হচ্ছে জনগণের সেবক আর অভিভাবকের কাজ বা কথাবার্তা।
অথচ এই যে আমরা বিদেশে আছি এখানে বেশিরভাগ মানুষজন অমুসলিম। তারপরও শপিং মলে দোকানে বাজারে দেখি সুন্দর করে লেখা আছে রমাদান মোবারক। এই লেখা শুধু সৌজন্যের নয়, এর সঙ্গে আন্তরিকতা আছে বলেই দামের বিষয়ে সচেতন তারা। তারা জানে মুসলিম জনগোষ্ঠী ইফতারি বা সেহরিতে কী খায়। সেজন্য তারা খেজুর এক বাক্স কিনলে আরেক বাক্স ফ্রি দেয়। কোনো কোনো দ্রব্যের দাম কেটেছেঁটে কমানো হয়। এর নাম নিয়ন্ত্রণ। এর ভেতরে আছে আন্তরিকতা। লাভ ছাড়া কেউ বাণিজ্য করে না। বাণিজ্যের মূল কারণ আয়-উপার্জন। কিন্তু কে কতটা লাভ করবে তার একটা লিমিট বা সীমা আছে। সে লিমিট বেঁধে দেওয়ার দায় সরকারের কিন্তু পালন করার দায়িত্ব ব্যবসায়ীদের। মাহে রমজান বলে যারা খোশ আমদেদ জানান তারা কিন্তু এ নিয়ম মানেন না। কৃচ্ছ্র শুধু খাবারের বেলায় নয়, দামের বেলায়ও মানতে হয়।
এ দাম বৃদ্ধির কুপ্রভাবে যখন মানুষজন হতাশ তখন আমরা কী দেখছি? বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্যের দপ্তরে ফুলের জলসা। কেউ উপাচার্য পদে আসীন হলে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা বা শুভেচ্ছা জানানো সমাজ ও জাতির কর্তব্য। যারা তার নিকটজন বা সঙ্গে আছেন তারা সবাই ফুল দিতেই পারেন। কিন্তু ওই যে আমাদের সবকিছু সীমাহীন। আলগা আবেগে ভাসা এক অস্থিরতা। এত ফুল, এত স্তবক, এটা যে স্তাবকতা, যিনি পেয়েছেন তিনিও জানেন। কিন্তু সময় এমনই তা ভুলিয়ে দেয়। কারণ যে কোনো ভুলের পূর্বশর্তই হচ্ছে নিয়ম নৈতিকতা ভুলিয়ে দেওয়া।
উপাচার্য কেন, এখন যে কোনো পদে পদোন্নতি বা নিয়োগপ্রাপ্তদের সংবর্ধনা দেখলে মনে হয় রাজসিক কাজকারবার চলছে। যারা পদক পুরস্কার পান তাদের বেলায়ও এই নিয়ম চালু আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে লাখ টাকার ফুলমালা উপহার, এগুলোর টাকা আসছে কোথা থেকে? আপনি যদি লাখ টাকার ফুল কিনতে পারেন, আটশো টাকার তরমুজ পারবেন না কেন?
আমরা আসলে দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। আমি যখন এ দেশে এসে ব্যাংকে কাজ শুরু করেছিলাম তখনকার একটি ঘটনা মনে পড়ল। অনেকেই হয়তো জানেন যে অস্ট্রেলিয়ার কোনো সীমান্তসংলগ্ন প্রতিবেশী নেই। এমনকি নিজের দেশটিও সমুদ্র দিয়ে বিভক্ত। হোবার্ট বা তাসমানিয়া যেতে হলে আপনাকে জলপথ পাড়ি দিতেই হবে। দূরের হলেও মোটামুটি কাছের একটি দেশ নিউ ক্যালেডোনিয়া। ফ্রেঞ্চ কলোনি বা ফরাসিদের অধীনে ছিল এই দেশ। এখনো সেখানকার মানুষ অনর্গল ফ্রেঞ্চ বা ফরাসি ভাষায় কথা বলতে পারেন। সে দেশের এক দম্পতি এসেছিল ব্যাংকে। তাদের কাজগুলো শেষ করতে গিয়ে আমার প্রায় অর্ধেক দিন শেষ। পরদিন দেখি সেই যুবক আর যুবতী দাঁড়িয়ে আছে, হাতে বিশাল এক ফুলের তোড়া। আমি ভাবলাম কোথাও হয়তো যাচ্ছে, যাওয়ার পথে ব্যাংকিং করতে ঢুকেছে। অবাক করে দিয়ে সেই ফুলের গুচ্ছ আর কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, তোমার জন্য। আমি তো আনন্দে অভিভূত। ওরা চলে যাওয়ার পর আমি সেগুলো রাখার জন্য ভেতরে ঢুকে আমার বসকে জানাতেই সে বলল—আমি দেখেছি। অভিনন্দন তোমাকে। তবে একটা কাজ বাকি আছে। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম—কী কাজ?
বস একটা লাল মলাটের রেজিস্টার বই খুলে বলল—এতে তুমি তোমার নাম, ওদের নাম, কী পেয়েছ তার একটা ছোটখাটো বিবরণ লিখে দাও। আমার প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিল—এটি গিফট রেজিস্টার বা উপহার বই। মনে মনে ভাবলাম আমাদের দেশেও আছে তবে বিয়েবাড়িতে আগে এসব লিপিবদ্ধ করে রাখা হতো যাতে উপহার না হারায় বা চুরি না যায়। আর এখানে লেখার কারণ গিফটের নামে কোনো ঘুষ বা অন্যায় কিছু নেওয়া হচ্ছে কি না। এর মূল্যমান যদি পাঁচশ ডলারের অধিক হতো হয়তো আপনাকে আরও একটা ফরম পূরণ করতে হবে। সে তথ্য অনুযায়ী টিম এসে পরে অনুসন্ধান চালাবে। আমি জানতে চেয়েছিলাম যদি কেউ এর চেয়ে বেশি ডলার উপহার হিসেবে পায়? বস জানিয়েছিল, পেতেই পারে। কিন্তু সে অর্থ তার ভাগে যাবে না। তারটা বাদে বাকিটা কল্যাণ তহবিলে জমা হয়ে যাবে। বুঝেন এবার।
এই নিয়ম সংযমী হওয়ার জন্য বাধ্য করে। আমাদের দেশে ধর্মীয় বিধানের পরও কিছু মানুষ সংযম মানে না। সংযমে তাদের আপত্তি। একদিকে দ্রব্যমূল্য আরেক দিকে ফুলের স্তবকের নামে উপচেপড়া স্তাবকতা। আমার যেটা ভয় সেটা হচ্ছে এই অশুভ প্রবণতা শিক্ষা খাতকেও আক্রমণ করেছে। একটি জাতির জন্য যা ভয়াবহ। যেসব মানুষ প্রতিবাদ করেন বা এসব নিয়ে ভাবেন তাদের অবস্থা সমাজে এতিমের মতো। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন—ভালো মানুষরা এখন বিচ্ছিন্ন। আর খারাপ মানুষরা শেয়ালের মতো সংঘবদ্ধ। হুক্কা হুয়া ধ্বনি দিলেই সব এক হয়ে ছুটে আসে। কথাটা সাংঘাতিকভাবে সত্য যার নমুনা এখন সবাই দেখতে পাচ্ছি।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে চ্যালেঞ্জ করছে এসব অশুভ বিষয়। উন্নয়ন কোনো বায়বীয় বিষয় নয়। উন্নয়ন ও মঙ্গল এক। যে উন্নয়নে মঙ্গল নেই, সামষ্টিকতা নেই, তার আয়ু বেশি দিন হয় না। যে উন্নতি মানুষ নিজেদের মনে করতে পারে না বা যার ন্যায্য ভাগ সে পায় না, সে উন্নতি যে উন্নতি নয় তার প্রমাণ বিশ্বে ভূরি ভূরি। আমাদের রাস্তাঘাট উড়াল পুলের উন্নয়ন যদি মানুষের কষ্ট আর অধিকারে তার শুভ প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয় তো ভবিষ্যৎ ছেড়ে কথা বলবে না। নিয়ন্ত্রণহীন, বল্গাহীন সমাজের তলায় যে অন্ধকার তার দিকে আলো না ফেললে চামচামি আর স্তাবকতার কারণেই নষ্ট হয়ে যাবে সবকিছু। ফুল না তরমুজ, খাদ্য না উপহার—এ প্রশ্নই তখন বড় হয়ে দাঁড়াবে ক্রমেই।
লেখক: ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক, সিডনিপ্রবাসী