গত মঙ্গলবার (৫ মার্চ) রাত ৯টার দিকে বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দেখলাম গুলির মতো মেসেজ। একটা বই পড়ছিলাম। মেসেজের টুংটাং শব্দে নজর দিলাম। কী এমন হলো যে, সবাই সব ছেড়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিতে মরিয়া হয়ে গেল। বই বন্ধ করে, ফোনে চোখ রাখলাম। দেখি ফেসবুক বন্ধ নিয়ে রীতিমতো আর্তনাদ। সরকার ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে, ফেসবুকে ঢোকা যাচ্ছে না, এ নিয়ে রীতিমতো হাহাকার। আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, সরকার কেন ফেসবুক বন্ধ করবে? দেশে কী এমন পরিস্থিতি হলো যে ফেসবুক বন্ধ করতে হবে? টেলিভিশন অন করলাম। ওমা, দেখি ‘মেটা’র সার্ভার ডাউন হওয়র কারণে বিশ্বব্যাপী ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও ইনস্টাগ্রাম সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ‘মেটা’কে দোষ দেবে কে? সব দোষ সরকারের। আকারে ইঙ্গিতে কেউ কেউ বোঝাতে চাইল সরকারই ‘ফেসবুক’ বন্ধ করে দিয়েছে। এক বিশাল বুদ্ধিজীবী যেন সব জানেন। কী অবলীলায় বেইলি রোডের দুর্ঘটনার সঙ্গে ফেসবুক বন্ধের ঘটনা মেলালেন। তার কল্পনা শক্তিতে আমি মুগ্ধ। রাতের মধ্যেই সত্য জানা গেল, ফেসবুক বন্ধে সরকারের কোনো হাত ছিল না। এটা বিশ্বব্যাপী একটা প্রযুক্তি বিভ্রাট। কিন্তু এই ছোট্ট একটা ঘটনা অনেক কিছু প্রমাণ করে দিল। বাংলাদেশের মতো জনসংবেদনশীল দেশগুলোতে নাগরিকদের সঙ্গে সরকারের এক অবিশ্বাসের আলো-আঁধারি খেলা চলে। নাগরিকরা তাদের যে কোনো সমস্যার জন্য সরকারকে দায়ী করে। যে কোনো ‘মুশকিল’ সরকারই ‘আসান’ করে দেবে, এমন প্রত্যাশা করে। কারণ এ দেশগুলোতে সরকার অনেক ক্ষমতাবান। তাদের ব্যাপ্তি সর্বত্র বিরাজমান। হাসপাতাল সেবা থেকে ব্যবসা, বিয়ে থেকে মৃত্যু, সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এ দেশে ব্যবসা করতে, টেন্ডার পেতে, চাকরি এবং পদোন্নতির জন্য ক্ষমতাবানদের সুনজরে থাকতে হয়। সরকারি দল মানেই ক্ষমতাবান। জনতুষ্টির আশায় সরকারই জনগণের সামনে প্রতিশ্রুতির মস্ত মস্ত বেলুন ওড়ায়, যা পারবে না, তাও করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। নির্বাচনে জিততে দেশের জনগণকে দুধে-ভাতে রাখার অঙ্গীকার করে। সরকার গঠন করে, মন্ত্রী, এমপি হয়ে রাজনীতিবিদরা যখন তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে না, তখন জনগণ বিশ্বাস হারায়। এভাবেই রাজনীতির প্রতি মানুষ অনাগ্রহী হয়। সাধারণ মানুষ তাদের সব ভোগান্তির জন্য সরকারকেই দায়ী করে। বাংলাদেশে বিষয়টি আরও জটিল এবং স্পর্শকাতর। এখানে একশ্রেণির মানুষ আছেন যারা মনে করেন, তাদের জীবনে সবকিছু ঠিকঠাক করে দেওয়ার দায়িত্ব এককভাবে সরকারের। একজন নাগরিক চান তার সন্তান সেরা স্কুলে পড়বে। যদি দেশে সেরা স্কুলে তার সন্তান ভর্তি হতে না পারে, তাহলে ‘সরকার দায়ী’। একজন অভিভাবক তার সন্তানের জিপিএ ৫ নিশ্চিত করার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত। এজন্য সব কোচিং সেন্টারে নিয়ে যান প্রিয় সন্তানকে, এসব কোচিং সেন্টারে যৌন হয়রানির মতো ঘটনা ঘটলে দোষ সরকারের। সব অভিভাবক কোচিং ব্যবসায়ের সমালোচনা করেন। আবার কোচিং বন্ধ করলে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে যান। বলেন, সরকার কি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করবে? শিক্ষায় সৃজনশীলতা নেই বলে যারা হতাশা প্রকাশ করেন, তারাই আবার সৃজনশীল শিক্ষার বিরুদ্ধে নানা গুজব ছড়ান। পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন হলে অধিকাংশ অভিভাবক বিশ্বাস করেন, সরকারের গাফিলতির জন্যই তার সন্তানের শিক্ষাজীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। একজন মানুষ সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সর্বোচ্চ সেবা চান। কিন্তু এজন্য পয়সা খরচ করতে রাজি নন। সরকারি হাসপাতালে সর্বোচ্চ সেবা না পেলে স্রেফ সরকারই দায়ী। এরকম ঘটনা প্রতিটি ক্ষেত্রে। সম্প্রতি বেইলি রোডে আগুন এবং তার প্রেক্ষাপটে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অভিযানের কথাই ধরা যাক। বেইলি রোডে আগুনের ঘটনার পর সরকারকে তুলাধুনা করার লোকের অভাব হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা। টকশো-বাগীশ থেকে শুরু করে বেকার, সবাই সরকারকে প্রায় খেয়ে ফেলে অবস্থা। সরকারের সমালোচনা করে রীতিমতো চামড়া ছিলে লবণ লাগানো হলো। সরকারের দোষ কী?Ñএকটু বোঝার চেষ্টা করলাম। অফিসের আড্ডায়, টকশোতে, সংবাদপত্রের পাতায় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। এরকম অবৈধভাবে যেখানে সেখানে রেস্টুরেন্ট চলে কীভাবে? অনুমোদনবিহীনভাবে, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে দোকান, শপিং মল হয় কীভাবে? ফায়ার ব্রিগেড কী করে, রাজউক তো দুর্নীতিতে সেরা, সিটি করপোরেশন লাইসেন্স দেয় কীভাবে—ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। একজন টকশোতে বললেন, আমরা যারা ঢাকায় বাস করছি তারা যেন এক জ্বলন্ত উনুনে বসে আছি। এটা চলতে দেওয়া যায় না। একজন বললেন সরকার ব্যর্থ। অবিলম্বে সরকারকে কঠোর হতে হবে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁ, শপিং মল, ভবন বন্ধ করে দিতে হবে। একজন বললেন, সরকারের লোকজনই এসব রেস্তোরাঁর মালিক, তাই সরকার এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না। এত তীব্র সমালোচনা, উপদেশ আর পরামর্শের পর কে চুপচাপ বসে থাকে! সরকারের সব সংস্থা, যাদের দায়িত্ব এসব অনিয়ম তদারকি করা, তারা জেগে উঠল। রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার ব্রিগেড নানা সংস্থা ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হলো অভিযান। অভিযানে বহু রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হলো। কারও ফায়ার ব্রিগেডের অনুমোদন নেই, কারও রাজউকের নকশার অনুমোদন নেই, কেউ সিটি করপোরেশনের লাইসেন্স না নিয়েই ব্যবসা করছে। কিছু কিছু অভিযানে দেখা গেল রেস্তোরাঁগুলো এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে, আরেকটি বেইলি রোড ট্র্যাজেডি হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি ভাবলাম দেরিতে হলেও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার এ উদ্যোগ টুপিখোলা অভিনন্দন পাবে। জনগণ খুশি হবে। সমালোচকরা সরকারকে বাহবা দেবে। কোথায় কী, অভিযান শুরুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শোনা গেল আর্তনাদ। আবার তীব্র সমালোচনা শুরু হলো সরকারের বিরুদ্ধে। এবার সরকারের অপরাধ কী বোঝার চেষ্টা করলাম। একজন বললেন, রোজার আগে এভাবে অভিযান তো রেস্তোরাঁ ব্যবসার সর্বনাশ করবে। রেস্টুরেন্ট মালিকরা সংবাদ সম্মেলন করে বললেন, ‘এই ব্যবসা বন্ধ করে দোকানের চাবি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়ে আসব।’ একটি টেলিভিশনে সংবাদ শিরোনামে বলা হলো ‘হ-য-ব-র-ল অভিযান’। কেউ কেউ বলছে, এসব অভিযান করে সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়া হলো। কেউ বলল, অভিযানের নামে চাঁদাবাজি চলছে। আমি হতবাক। সরকার তাহলে করবে কী? অভিযান না করলে সরকার নাকে তেল দিয়ে ঘুমায় আর অভিযান করলে দেশ ধ্বংস হয়ে যায়! সব দোষ সরকারের। এই অভিযান তো একটি উদহারণ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এরকম অবস্থা। কিছুদিন ধরে এসএসসি পরীক্ষা চলছে। বিভিন্ন রাস্তা পরীক্ষার্থীদের গাড়িতে সয়লাব। রাস্তা বন্ধ করে গাড়ি পার্কিং করা হয়েছে। তীব্র যানজট। আপনি বলবেন, ভাই রাস্তার ওপর এভাবে গাড়ি পার্ক করে রেখেছেন, সাধারণ মানুষ তো কষ্ট পাচ্ছে যানজটে। উত্তর আসবে, ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিচ্ছে, গাড়ি রাস্তায় রাখব না তো কি সরকারের মাথায় রাখব? স্কুলের সামনে সরকার পার্কিং রাখেনি কেন? কী তাজ্জব কথা? এর মধ্যে সরকার এলো কোথা থেকে? যে ভদ্রলোক তিন ঘণ্টা রাস্তায় গাড়ি রেখে তীব্র যানজট সৃষ্টি করলেন, তিনিই পরীক্ষার্থীদের নিয়ে ফেরার সময় যানজটে নাকাল হয়ে, সরকারকে গালি দেবেন। বলবেন, কীসব বানাইছে এলিভেটেড এক্সপ্রেস, মেট্রোরেল খালি পয়সা চুরি, দুর্নীতি। যানজট তো এক ফোঁটাও কমেনি। অথচ তার জন্য যে এ রাস্তাটাই যানজট তা তাকে কে স্মরণ করিয়ে দেবে। আপনি যত্রতত্র অবৈধভাবে গাড়ি
পার্কিং করবেন, পুলিশ এসে আপনার বিরুদ্ধে মামলা করলেই সর্বনাশ। সরকারের সমালোচনায় মুখর হবেন। বলবেন আপনি নির্যাতিত। যানজট নিরসনে আপনার কোনো দায়িত্ব নেই। আপনি ট্রাফিক আইন মানবেন না, কিন্তু সরকারকে ম্যাজিক করে শহরকে যানজটমুক্ত রাখতে হবে।
আপনি সরকারের রাজস্ব নীতির সমালোচনা করবেন। সরকার ঋণ নিয়ে দেশকে দেউলিয়া করে ফেলল বলে হাহাকার করবেন। আবার নিজে আয়কর ফাঁকি দেবেন, ভ্যাট ফাঁকি দেবেন। সরকারের পাওনা ট্যাক্স দিতে গড়িমসি করবেন। ট্যাক্স বাড়িয়ে সরকার জনগণকে জুলুম করছে বলে অভিযোগ করবেন। সব দোষ সরকারের। আপনি উন্নয়ন চান, কিন্তু ট্যাক্স দিতে রাজি নন।
আপনি আইনের শাসন, ন্যায়বিচারের কথা বলবেন। অভিযোগ করবেন, আইন সবার জন্য সমান নয়। ওপরতলার মানুষরা আইনের ঊর্ধ্বে—এমন কথা বলে সরকারের সমালোচনা করবেন। আবার ড. ইউনূসের মতো ওপরতলার মানুষের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচারের তদন্ত হলে আপনি হৈহৈ করে উঠবেন। বলবেন, সরকার কি পাগল হয়ে গেল? ড. ইউনূসের মতো লোককে আদালতপাড়ায় চরকির মতো ঘোরাচ্ছে। এ দেশে গুণীদের মান-ইজ্জত বলে কিছু থাকল না,Ñএরকম বক্তব্য রেখে আপনি দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। সব দোষ সরকারের। তাহলে ড. ইউনূস, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যরা কি আইনের ঊর্ধ্বে?
আপনি কথায় কথায় বিদেশের উদাহরণ দেবেন। সেখানে নিয়মনীতির প্রশংসা করতে করতে আপনি মুখে ফেনা তুলবেন। কিন্তু দেশে আপনি নিয়মনীতি মানবেন না। হাসপাতালে সিটের জন্য তদবির করবেন। চাকরি পেতে ঘুষের থলি নিয়ে ঘুরবেন। সরকারি অফিসে গেলে প্রভাবশালী পরিচিতের নাম ভাঙাবেন। এমনকি ব্যাংকেরও একটু পরিচিতি থাকলেই লাইনে দাঁড়াবেন না। চলে যাবেন ম্যানেজারের খাসকামরায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনি টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে কান্নাকাটি করবেন। কিন্তু দাম বেশি এজন্য কোনো পণ্য কেনা বাদ দেবেন না। আপনি চান সবকিছু হোক আপনার মতো করে। আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী। আপনি যা খুশি করবেন, বাধা দিলেই দোষ সরকারের। কিন্তু আরেকজন যা খুশি করলে আপনি ক্ষেপে যাবেন। আপনি মনে করবেন, সবকিছু ঠিকঠাক করার দায়িত্ব শুধুই সরকারের। স্রেফ সরকারের। কিন্তু নাগরিক হিসেবে কি একবার ভাবেন, আপনার কিছু দায়িত্ব আছে? সরকারের সমালোচনার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটা কি একটু দেখবেন? যে রেস্টুরেন্টে গেলেন, তা ঠিকঠাক কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব কি আপনারও না। যে হাসপাতালে যাচ্ছেন সেটা বৈধ কি না, তা দেখা আপনার নাগরিক দায়িত্ব। যানজটের সমালোচনা করার আগে আপনি ট্রাফিক আইন মানছেন কি না, সেটা নিশ্চিত করবেন না? সব দোষ সরকারের ঘাড়ে চড়ানোর আগে, আপনি নাগরিক হিসেবে আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেন কি না, তা একটু ভেবে দেখবেন?
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: [email protected]