আকমল হোসেন
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৪, ০২:২৭ এএম
আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৪, ০৯:১০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নারীর মুক্তি কীসে

আকমল হোসেন। সৌজন্য ছবি
আকমল হোসেন। সৌজন্য ছবি

গত ৮ মার্চ ছিল বিশ্ব নারী দিবস। কর্মজীবী নারীদের প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা শ্রম এবং মজুরি বৃদ্ধি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দিবসটি পালনের সূত্রপাত ঘটলেও এবার বিশ্বব্যাপী নারী দিবস পালিত হয়ে গেল নারী মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে। পৃথিবীর প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের প্রায় অর্ধেকই নারী। সমাজেরই একটা অংশ, আমরা একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। গঠন প্রকৃতির সামান্য ভিন্নতা ছাড়া অন্য কোনোদিক থেকে নারীকে পুরুষ থেকে আলাদা করা যায় না, আধুনিক সমাজের অগ্রসরমান চিন্তার মানুষগুলো এটাই বলে এবং সেই আঙ্গিকেই পৃথিবীর অনেক দেশে সংবিধানে নারী অধিকার সংযোজিত হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে এমন বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম, শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্য দেশেও। সৃষ্টির প্রারম্ভে পুরুষ, সমাজ শাসনের যে লাগাম কবজা করেছিল, সেটা আজও ছাড়েনি। নেতার পরিবর্তন হলেও নীতির পরিবর্তন হয়নি। তাই শাসক নারী হওয়ার পরও তার সাম্রাজ্যে নারী আজও বিভিন্নভাবে অধিকার বঞ্চিত, নির্যাতিত। প্রয়োজনে পুরুষ নারীকে বাহুডোরে বেঁধেছে আবার ছুড়েও দিয়েছে, তাদের শুধু ভালো লাগা আর না লাগার কারণে। বহু বিবাহ ও তালাক প্রথা সেটাই মনে করিয়ে দেয়। ইতর প্রাণী যেমন তার জৈবিক কাজের জন্য কোনো বিচার-বিবেচনা করে না, নারীদের নিয়ে এমন খেলা অনেকেই খেলেছে, এখনো খেলছে।

ধর্ম শাসন আইন সামাজিকতা আর লোকাচার সবটার দ্বারাই কোনো না কোনোভাবে নারীকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল, বর্তমানে সেটা কমলেও সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যায়নি। নারী যেন পুরুষের ভোগ-বিলাসের সামগ্রী বস্তুগত কোনো জিনিস। মাছি লেগে খাবার নষ্টের মতো তাকে ও দূষিত করবে তাইতো বস্তায় ভরে রেখেছে। নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার অভাবই হোক আর প্রচলিত বিধি ব্যবস্থার জাঁতাকলের কারণেই হোক, নারী আজও নারী, যেন সে মানুষ হয়নি অথবা মানুষ হতে চায় না।

প্রত্যেক জাতি ও সম্প্রদায় তার লোকাচার ও সংস্কৃতির মাধ্যমে পরিচিত হবে এটা দোষের কিছু নয়। পৃথিবীর ৬ হাজার প্রকার ভাষাভাষীর প্রতিটির অবস্থান সংখ্যার বিচারে ক্ষুদ্র আর মানুষ বিশাল এক জনগোষ্ঠীর সদস্য।

সেখানে সংকীর্ণতা পরিহার করে মানুষ হতে পারে বিশ্ব পরিবারের একজন সদস্য। এক সময় নারী ছিল সামাজিকভাবে উপেক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, প্রশাসনিক ভাবে ক্ষমতাহীন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অবরুদ্ধ। নারীর ছিল না ভোটাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নারীর গতরই শুধু নয়, নারী মুখের কথাও পর পুরুষে শুনবে না—এমনতর ভাববাদী তকমা। পর্দার বেষ্টনী, আইবুড়ির অপবাদ, মৃত স্বামীর সঙ্গে সহমরণে চিতায় ঝাঁপ এ প্রবণতা কমলেও সমাজ থেকে মুছে যায়নি। বাবার জমিতে তার মালিকানা ক্ষেত্র বিশেষে আজও জন্মেনি। নারী যতই গুণী হোক, সাক্ষ্য প্রদানে এক পুরুষের সমান হতে দুই নারী প্রয়োজন ভাববাদীদের বিধান। খ্রিষ্টান ধর্মে বয়স বেশি হওয়ার পর অবিবাহিত নারীদের আইবুড়ি অবপাদে হত্যার স্বীকার হতে হয়েছে। হিন্দু ধর্মের গুরু তুলসী দাসতো বলেছেনই, ‘নারী শিশু কালে থাকবে বাবার অধীন, বয়স্ককালে থাকবে স্বামীর অধীন, পতিদেবের মৃত্যুর পর সে হবে ছেলের অধীন; নারীকে কোনোভাবেই স্বাধীনতা দেওয়া যাবে না।’ অনেক ধর্মে নারীকে পাপের আঁধার বলে অবিহিত করেছে। বাবার সম্পত্তিতে মেয়ের অংশীদারিত্ব ছেলের অর্ধেক। নারী নেতৃত্ব বৈধ নয়, এমন বিধান থাকলে নারী অধিকার নিশ্চিত কতটুকু সম্ভব? মেয়েদের শারীরিকভাবে দুর্বল রাখতে আফ্রিকার অনেক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে মেয়েদের খাতনা করানো হয়, প্রথম মাসিক হওয়ার পরই মেয়েদের বিবাহ দেওয়ার রেওয়াজ নারী নির্যাতনের আরেক উপায়। ১২ বছরের পিরিয়ড (মাসিক) হওয়া মেয়েটির গলায় পরিয়ে দিচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ বছরের এক যুবককে, জেলে না গিয়েও মেয়েটি স্বামীগৃহে প্রতিদিনই জেল খাটে।

নারীদের এহেন জেল খাটা থেকে মুক্তির চেষ্টা করলেও আমরা মুক্তি দিতে পারিনি, মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর মধ্য দিয়েই সেটার প্রমাণ পাওয়া গেল। তেঁতুল হুজুররা স্বাধীন দেশে এখনো মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণে নিরুৎসাহিত করছে, মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর ফতোয়া দিচ্ছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। এই নারীদের কথায় তার দলীয় লোকগুলো ওঠবস করলেও নারী মুক্তি সেই অর্থে কিন্তু এখনো আসেনি। কারণ ক্ষমতার আসনে নেতার পরিবর্তন হলেও নীতির পরিবর্তন হয়নি। ধর্মীয় সংকীর্ণতা, মৌলবাদীদের ফতোয়া দোড়রার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত নারী। ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে বিচারকদের মুর্তাদ ঘোষণাকারীরা সরকারের ক্ষমতার পাটনার হলেও স্বয়ং সরকারপ্রধান নারী নীরব। পোশাক শিল্পে ৯০% শ্রমিক নারী। মজুরি বৈষম্য, কাজের সময়ের লাগামহীনতা, নিরাপত্তাহীনতা এ সব শ্রমিকের নিত্যদিনের সঙ্গী। প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি আছে প্রতিকার নেই। শুধু জীবন বাঁচানোর তাগিদে ৮৪% মুসলমানের দেশে লক্ষাধিক নারী সরকারি লাইসেন্সের মাধ্যমে পতিতা বৃত্তি করছে। পুঁজিবাদ নারীকে যেভাবে মেলে ধরেছে, তাতে মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার যেমন নিশ্চিত হয়নি, তেমনিভাবে মানবিক মর্যাদাও বাড়েনি। যতদিন তার জৌলুস আছে ততদিন তার কদর আছে, এই তো পুঁজিবাদী নারী স্বাধীনতা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্ষমতার মসনদে নারী যতবারই আসুক, তাতে প্রকৃত অর্থে নারী অধিকার নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। পৃথিবীর ইতিহাস সেই কথাই বলে। ৩০ লাখ লোকের জীবনদান এবং দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া দেশের সংবিধানে নারীর ক্ষমতায়নে অনেক কথা থাকলেও বাস্তবায়িত হয়নি। এটাই চরম এবং পরম সত্য। এই সত্যকে সততার সঙ্গে বোধ ও বিবেচনায় না আনলে নারীর মুক্তি নিশ্চিত হবে না। শুধু নারীরাই বঞ্চিত নয় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও বঞ্চিত তবে সম্পদের সুষম বণ্টন না হওয়ায় বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। আয় বৈষম্য বাড়তে বাড়তে আজ আকাশ আর পাতালের অবস্থানে। ধনী-গরিবের আয় বৈষম্যের অনুপাত ১:৮৪। এই অবস্থায় সম্পদ বৃদ্ধি যতই হোক সমাজ থেকে বঞ্চনা কমবে না, অর্থনৈতিক উন্নয়নও আশা করা যায় না। সমাজের বৃহৎ অংশের মানুষ যেখানে অধিকার বঞ্চিত সেখানে নারী অধিকার ভিন্ন করে না দেখে বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য একটা কাফেলায় সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। নারীর ক্ষমতায়ন নারীর অর্থনৈতক মুক্তি ও ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্তির জন্য এনজিওরা কাজ করলেও সফলতা অনেক দূর। আর এই ব্যবস্থাপনায় দরকার স্বচ্ছ আলোর। সেই আলো এখনো নাগালের বাইরে। তাই নারীদের করুণার পাত্র হয়ে অন্যের কাছে আবেদন-নিবেদনের চেয়ে অধিকার আদায়ের লৌহ দৃঢ় ঐক্য গড়াই জরুরি। ধর্মীয় শাসন ও কুংসস্কার মুক্ত হতে সেক্যুলারিজম রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত হতে সমাজবাদী অর্থনীতি, এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সমাজতান্ত্রিক সমাজের অন্বেষণ জরুরি। নারী শুধুই ক্ষমতা শূন্য ক্ষমতার আসন অলংকৃত করলে নারী মুক্তি আসবে এমন আশা-নিরাশার নামান্তর। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের নারীরা নিজের প্রতি আস্থাহীন বলেই মনে হয়। তারা এখনো পরাধীন ও আশ্রিত তাদের বেশ সনে মনে হয়। গহনা, পোশাক-আশাক আর প্রসাধনীতে অনেকেই নিজেকে স্বাধীন বিবেচনা করেন, আসলে এগুলো দ্বারা নারীকে ভুলিয়ে রাখার একটা মাধ্যম। হাতের বালা, কানের দুল, নাকের নোলক, গলার মালা জেলখানার কয়েদিদের পরাধীনতার শৃঙ্খল বলে অনেকেরই ধারণা। পুরুষ শাসিত সমাজে বহু নারীতে আসক্ত শাসক ও সমাজপতিরা ঘরের বিবিদের মুখ বন্ধ করতেই নারীকে বেশভূষায় সজ্জিত করেছির বলে অনেকেরই ধারণা। নারীরা আজও সেটা বোধে আনছে না।

নারী শুধু পুরুষ শাসিত সমাজের আইন-কানুনের কারণেই নিষ্পোষিত নয়, সে নিজেও নারী অধিকারের অন্তরায়। কারণ নারী, নারী হিসেবে না থেকে সবাই মানুষ হলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। তাইতো কবি বলেছেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’ তাই বঞ্চিত নারী সমাজ যদি মুক্তি চায় তবে তাকে প্রথমেই মানুষ হিসেবে ভাবার প্রয়োজন, দ্বিতীয়ত সে বঞ্চিত মানুষ কি না, তৃতীয়ত সে বঞ্চনা থেকে মুক্তি চায় কি না, সেটা ঠিক করতে হবে। বঞ্চিতের কারণগুলো শনাক্ত করতে হবে তারপর আন্দোলনে নামতে হবে, কারণ আন্দোলন ছাড়া শুধুই আবেদন-নিবেদনে অধিকার আদায়ের অবস্থা এখন নেই। আন্দোলন কার বিরুদ্ধে? যে বা যারা বঞ্চনার কাঠামো দাঁড় করে রেখেছে। সেটা সামাজিক, প্রথাগত, ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় ভাবে হতে পারে। অতএব শোষণ বঞ্চনার এহেন কাঠামো ঠিক রেখে ক্ষমতার মসনদে নারীকে বসাইলেই নারী মুক্তি সম্ভব নয়। তার উদাহরণ ৩৪ বছরের নারী শাসকদের বাংলাদেশ। মুক্তিতে চাই নারী বান্ধব শাসক এবং শাসন।

লেখক: অধ্যক্ষ এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নাসরুল্লাহ নিহতের ঘটনায় যে প্রতিক্রিয়া দেখালেন বিশ্বনেতারা

কারাগারে মাহমুদুর রহমান

তৃতীয় দিনের প্রথম সেশনের খেলাও হচ্ছে না

আ.লীগের দোসরদের চারপাশে বসিয়ে সংস্কার সম্ভব নয় : কাদের গনি

জবির নতুন পরিবহন প্রশাসক অধ্যাপক ওমর ফারুক

চবিতে হলে আটকে রেখে ছাত্রলীগ কর্মীকে বেদম পিটুনি

কোরআন পড়ে বাড়ি ফেরা হলো না চার শিশুর

আদালতে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান

শাবিপ্রবি ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রেপ্তার

নোয়াখালীতে গণপিটুনিতে যুবলীগ নেতা নিহত

১০

সুসংবাদ পেতে পারে কন্যা

১১

‘রাসুল (সা.) এর দেখানো পথে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে কাজ করতে হবে’

১২

চার জেলায় তীব্র বজ্রপাত ও ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস

১৩

ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কমিশন হচ্ছে : হাসনাত আবদুল্লাহ

১৪

বিপৎসীমার ওপরে তিস্তার পানি

১৫

ঢাকা সিএমএইচে নেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থী কাউসারকে

১৬

তাপমাত্রা নিয়ে নতুন তথ্য দিল আবহাওয়া অফিস

১৭

দেশে ফিরলেন ড. ইউনূস

১৮

২৯ সেপ্টেম্বর : নামাজের সময়সূচি

১৯

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

২০
X