বিশ্বব্যাপী আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় প্রতি বছর ৮ মার্চ দিবসটি পালন করা হয়। এর পেছনে আছে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের এক সংগ্রামমুখর ইতিহাস। নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে সারা পৃথিবীতে পালিত হয় দিনটি।
পৃথিবীতে মানবজাতি গঠিত হয়েছে নর ও নারীর সমন্বয়ে। একে অন্যের পরিপূরকের মর্যাদা প্রদান করেছে ইসলাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নারীরা তোমাদের আবরণ আর তোমরাও তোমাদের নারীদের আবরণ।’ (সুরা বাকারা : ১৮৭)। মানবসভ্যতায় ইসলামই নারীর সম্মান মর্যাদা ও প্রাপ্য অধিকারের ধারণা দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে পুরুষদের ওপর, যেমন পুরুষদের আছে তাদের (নারী) ওপর।’ (সুরা বাকারা: ২২৮)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘নেক আমল যেই করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী; যদি সে ইমানদার হয় তাহলে অবশ্যই আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব। আর আমি তাদের তাদের সৎ কর্মগুলোর বিনিময়ে উত্তম প্রতিদান দান করব।’ (সুরা নাহল: ৯৭)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনে নারীদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি সুরা নাজিল করেছেন। সেটি হলো ‘সুরা নিসা’ অর্থাৎ নারীদের সুরা। এ সুরায় নারীদের অধিকার বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নারীদের সঙ্গে সৎভাবে জীবনযাপন করো। অতঃপর তোমরা যদি তাদের অপছন্দ করো তবে এমন হতে পারে যে, তোমরা এরূপ জিনিসকে অপছন্দ করছ যাতে আল্লাহতায়ালা প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন।’ (সুরা নিসা: ১৯)। অন্যত্র ইরশাদ করা হয়েছে, ‘পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার প্রাপ্য অংশ আর নারী যা অর্জন করে সেটা তার প্রাপ্য অংশ।’ (সুরা নিসা: ৩২)। এসব আয়াতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, ইসলাম নারীর অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার।
ইসলামে মুসলিম নারীর সবরকম অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা হলেও আজ তারা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত। উত্তরাধিকার, দেনমোহর, ভরণপোষণ ইত্যাদি নানাদিক থেকে নানাভাবে বঞ্চিত নারীরা। অন্যদিকে সঠিক জ্ঞান না থাকায় ইসলাম নারীকে ঠকিয়েছে মর্মে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়। ইসলামে উত্তরাধিকার আইনে পুরুষদের চেয়ে নারীদের সম্পদের অংশ কম দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে যুক্তিসংগত কারণ বুঝতে না পেরে অনেকে ইসলামী নীতিমালা সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে থাকেন। তাদের ধারণা নারীদের প্রতি ইসলামের আইন হলো বৈষম্যমূলক। পবিত্র কোরআনের বিধান অনুযায়ী, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন সম্পর্কিত সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। এরপরও মহাবিজ্ঞানময় পূর্ণ জীবনবিধান সম্পর্কে না বুঝে অনেকে কটাক্ষ করে থাকেন। সত্য অনুসন্ধিৎসু সুন্দর মনের অবলোকনের জন্য সম্পত্তিতে নারীর যে কোরআনিক অধিকার রয়েছে, তা জানা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমাজে কোরআনের আইন মোতাবেক নারীরা সম্পত্তি সর্বক্ষেত্রে পাচ্ছে না বিধায় তারা আজ অধিকারহারা, সম্পত্তিহারা ও নির্যাতিতা। এজন্য মানবতার ধর্ম ইসলামকে কটাক্ষ করা মানে এর বিরোধিতা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর বর্তমানে নারীর এ বঞ্চনার জন্য প্রকৃতপক্ষে প্রচলিত সমাজব্যবস্থা দায়ী।
পবিত্র কোরআনের বণ্টননীতি অনুযায়ী একজন তিনটি সূত্র থেকে তিনভাবে সম্পদ লাভ করেন—১. মিরাস। ২. মোহর। ৩. নাফাকা। অর্থাৎ পিতার মৃত্যুর পর মিরাসের অংশ। বিয়ের সময় স্বামী থেকে উপযুক্ত দেনমোহর এবং স্বামীর পক্ষ থেকে জীবনধারণের ওয়াজিব খরচ, বাসস্থান, খাদ্য, ওষুধ ইত্যাদি; যাকে আরবিতে নাফাকা বলা হয়। পক্ষান্তরে পুরুষ শুধু একটি সূত্র থেকে সম্পদ লাভ করে, সেটা হলো মিরাস। কিন্তু সমাজে নারীর এসব অর্থনৈতিক সূত্রগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে এবং এসব অধিকার নিশ্চিত না করে নানা বিতর্কের অবতারণা করা হয়, যাতে ডুকরে কাঁদে অপ্রাপ্তিগুলো। ইসলামে দেনমোহরের এত সুন্দর বিধান থাকা সত্ত্বেও সমাজে এখন উল্টো ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। পাত্র কাবিন তো পরিশোধ করেই না, উল্টো কন্যাপক্ষ থেকে উপহারের নামে যৌতুক নেয় আর মেয়ের বাবার ঘাড়ে একরাশ বরযাত্রী খাওয়ানোর বোঝা চাপিয়ে দেয়। ইসলামে যৌতুক নেওয়া সম্পূর্ণরূপে হারাম ও কনেপক্ষকে যে কোনো রকমের জুলুম করাকে যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সবাই তা বেমালুম ভুলে যায়। আমরা কি জানি, আমাদের ধর্মে মেয়ের পক্ষ বিয়ের খরচ দিতে পর্যন্ত বাধ্য নয়? এমনকি ছেলের বাবা-মায়েরও দায়িত্ব নয় বিয়ের খরচ বহন করা। ছেলের দায়িত্ব হলো বিবাহের ভোজস্বরূপ অলিমার আয়োজন করা এবং কাবিন পরিশোধ করা।
ইসলামের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার আগে পৃথিবীর কোনো জাতিই নারীর কোনো কিছুর ওপর নিজস্ব অধিকারকে স্বীকার করত না। ইসলাম এসে নারীজাতির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা স্বীকার করেছে। যেমন কোরআনে বলা হয়েছে, ‘পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য।’ ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ উভয়ই তাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে। কোরআন বলা হয়েছে, ‘নারীদের ন্যায়সংগত অধিকার আছে যেমন রয়েছে পুরুষদের।’ নারীর সম্পত্তিতে অধিকার নিশ্চিত করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে; অল্প হোক কিংবা বেশি। এ অংশ নির্ধারিত।’ (সুরা নিসা : ৭)। ইসলাম একাধারে কন্যা, স্ত্রী, ভগ্নি, মাতা হিসেবে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করেছে।
প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়, ইসলামে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে নারীদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। খুবই দুঃখের বিষয় একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এসেও নারীরা সম্পত্তি বণ্টনসহ বিভিন্ন জায়গায় তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ায় এবং পারিবারিক ও সামাজিক কার্যকলাপ ধর্মীয় রীতিতে সম্পন্ন হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের ধর্মীয় রীতিনীতিকে দোষারোপ করা যুক্তিসম্মত মনে হতে পারে। কিন্তু আসলেই কি ইসলাম নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি?
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে, একজন নারী তার পিতামাতার সম্পত্তির ওয়ারিশ হওয়ার পাশাপাশি তার স্বামী ও সন্তানের সম্পত্তির ভাগীদার। যেই মর্যাদা ইসলামী শরিয়াহ আইনের মাধ্যমে একজন নারীকে দেওয়া হয়েছে। তবুও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়, কেন ইসলাম ছেলে ও মেয়েকে পিতার সম্পত্তিতে সমান অধিকার দেয়নি। কেন পিতামাতার সম্পত্তিতে একজন ছেলে একজন মেয়ের দ্বিগুণ পায়। ইসলামী শরিয়াহ আইন অনুযায়ী, পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব শুধুই একজন ছেলের ওপর বর্তায়। এখানে সে স্ত্রীর সম্পত্তি ব্যবহার করতে পারবে না। আবার বিয়ের সময় মেয়েরা তাদের স্বামী কর্তৃক দেনমোহর পান। কিন্তু ইসলামে স্বামী কিংবা তার পরিবারকে কোনো উৎকোচ দেওয়ার বিধান নেই। সব দিক বিবেচনা করলে মেয়েদের মূলধন হ্রাস পায় না, কিন্তু ছেলেদের মূলধন হ্রাস পায়।
ইসলামী বিধান অনুযায়ী মেয়েদের সম্পত্তির সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমাদের ভূখণ্ডের প্রাচীন সমাজব্যবস্থা দায়ী। ইসলাম ইনসাফ বা ন্যায্য অধিকারে বিশ্বাসী। এখানে ইনসাফ হচ্ছে নারী ও পুরুষের মধ্যে সুষম বণ্টন। ধর্মীয় মূল্যবোধ নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে নয় বরং সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। প্রাক ইসলামী যুগে বহু নারী ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনেক নারী সাহাবিরা পর্দার অন্তরালে থেকে পুরুষ সাহাবিদের হাদিস শিক্ষা দিতেন। এমনকি অনেক নারী যুদ্ধে পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) ও উম্মে সালমা (রা.) উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। উষ্ট্রের যুদ্ধে আয়েশা (রা.)-এর ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। বাঙালি সমাজব্যবস্থা ও ইসলাম নারীকে উচ্চমর্যাদার আসনে বসিয়েছে। সর্বোপরি নারীবাদ ও পুরুষতন্ত্রের বাইরে গিয়ে উদারনৈতিকতা চর্চা করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে হলে নারী-পুরুষ উভয়ের সমান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পোন্নয়নে, অন্যান্য পেশায় নারী-পুরুষের সমান ভূমিকা থাকলে রাষ্ট্র উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহণ করতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ থেকে সহস্র বছরের ইসলামী শাসনামলেও নারীরা জ্ঞানচর্চা থেকে শুরু করে যে আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ভোগ করেছে, তা আধুনিক সময়েও বিরল। আমাদের প্রত্যাশা, নারী দিবস শুধু স্লোগানসর্বস্ব না হয়ে বাস্তবেই ফিরে পাক নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ