এম আবদুল্লাহ
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৪, ০৪:৪৬ এএম
আপডেট : ০১ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি কতটা গ্রহণযোগ্য

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি কতটা গ্রহণযোগ্য

নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে অসহনীয় মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য আরেক দফা বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে। এবারে মূল্যবৃদ্ধির হারও উচ্চ হবে বলে আভাস দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের টানা শাসনের চতুর্থ মেয়াদের শুরুতে মার্চের মধ্যে বর্ধিত মূল্য কার্যকর হবে বলে খোদ জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর জবানিতে জানা গেছে।

আইন সংশোধন করার কারণে বিদ্যুৎ বা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির জন্য এখন আর এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসির) অনুমোদন প্রয়োজন হবে না। নির্বাহী আদেশে বাড়ানোর ক্ষমতা নিয়েছে সরকার। বিইআরসিতে শুনানির মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা যেসব যুক্তিতর্ক নিয়ে হাজির হতেন, তা আর শোনা যাবে না। মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করে বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি ও ভুলনীতি থেকে বেরিয়ে আসার ওপর তারা যে জোর দিয়ে আসছিলেন, তা আর শুনতে চাইছে না সরকার।

গত ১৫ বছরে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে ১৪ দফা। গত বছরই তিন দফায় ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয় অনেকটা নীরবে। আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ১৪১ শতাংশ বেড়েছে। সর্বশেষ গত বছর ১২ ও ৩১ জানুয়ারি এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। তার আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে বাড়ে। প্রতি পাঁচ বছর মেয়াদ বিবেচনায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে রেকর্ড গড়েছে বর্তমান সরকার। তিন মেয়াদে গড়ে ৪৭ শতাংশ হারে বেড়েছে, যা স্বাধীনতা-পরবর্তী অন্য কোনো সরকারের আমলে হয়নি।

অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে নয়বার বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়েছে। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ তথ্য তার এ বক্তব্য সমর্থন করে না। অতীতে মূল্যবৃদ্ধির তথ্য-পরিসংখ্যান বলছে—বিএনপি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ মেয়াদে তিন দফায় ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ দাম বাড়িয়েছে। তখন ভোক্তা পর্যায়ে ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত প্রতি ইউনিটের দাম ১ টাকা ৬৫ পয়সা থেকে ১০ পয়সা বাড়িয়ে ১ টাকা ৭৫ পয়সা করা হয়েছিল। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম আমলে সাত দফায় মোট ২২ দশমিক ৮৫ শতাংশ মূল্য বাড়ানো হয়েছিল। তাতে আবাসিক গ্রাহকদের ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত ১ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বেড়ে ২ টাকা ১৫ পয়সায় উন্নীত হয়েছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদে বিএনপি সরকার তিন দফায় বিদ্যুতের দাম মোট ৩৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে। সে সময় ২ টাকা ১৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৩ টাকা (৪০০ ইউনিট পর্যন্ত)। অর্থাৎ পুরো মেয়াদে বিএনপি ইউনিটপ্রতি ৮৫ পয়সা বাড়িয়েছিল। এরপর সেনাসমর্থিত মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের সময়ে এক দফায় বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। ইউনিট মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ১৫ পয়সা।

বিদ্যুতের মূল্য ফের বাড়ানোর প্রশ্নে সরকার যে অনমনীয় তা স্পষ্ট হয়েছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কয়েকটি বক্তব্যে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর আগেই আইন সংশোধন করে বিদ্যুৎসহ সব ধরনের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির বা কথিত সমন্বয়ের ক্ষমতা সরকারের এখতিয়ারে নেওয়ার মধ্য দিয়েও যখন-তখন যথেচ্ছ হারে দাম বৃদ্ধির বেপরোয়া মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

দেশের উন্নয়ন তথা জিডিপি প্রবৃদ্ধির একটি বিশেষ উপাদান হিসেবে বিদ্যুৎ খাতকে বিবেচনা করা হয়। অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, বর্তমান সরকারের সময়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। লোডশেডিং কমেছে। চলতি বছর উৎপাদন ক্ষমতা ৩১ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়াবে বলে জানানো হয়েছে। যদিও গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে আগস্ট মাসে ১৩ হাজার ১২৩ মেগাওয়াট। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছে—‘শীত না কাটতেই লোডশেডিং শুরু’। আকাশছোঁয়া সক্ষমতার মধ্যে লোডশেডিং কেন? এ যেন দুর্বোধ্য গোলকধাঁধা!

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে যেসব যুক্তি দেখানো হচ্ছে তার অন্যতম হচ্ছে—ভর্তুকি কমানো। আইএমএফের ঋণের কিস্তি পাওয়ার শর্ত হিসেবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমানোর কথা বলা হয়েছে। সরকার বলছে, এ শর্ত পূরণের চাপ রয়েছে তাদের ওপর। বিদ্যুতে ভর্তুকির অর্থ পরিশোধে এরই মধ্যে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করতে হয়েছে সরকারকে। কিন্তু ভর্তুকির প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি। আর বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকৃত ব্যয় বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ না পেয়েও কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে পিডিবিকে, যার প্রভাব পড়ছে উৎপাদন মূল্যে।

সর্বশেষ হিসাবে বিদ্যুতের উৎপাদনে জ্বালানি খাতে ব্যয় ইউনিটপ্রতি ৫ টাকা ৪৫ পয়সা। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে প্রতি ইউনিটে ক্যাপাসিটি চার্জ ৬ টাকা ১১ পয়সা। অর্থাৎ উৎপাদন করতে গিয়ে জ্বালানি বাবদ যা ব্যয় হয়, তার চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে বিদ্যুৎ না পেয়ে বেসরকারি কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ খাতে।

সরকার তিন মেয়াদে রেকর্ড হারে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করায় জীবনযাত্রার সব পর্যায়ে ব্যয় বেড়েছে কল্পনাতীতভাবে। মানুষ খাদ্য থেকে শুরু করে জীবনযাপনের প্রতিটি পর্যায়ে কাটছাঁট করে কোনোমতে বেঁচে থাকার লড়াই করছে। সঞ্চয় ভেঙে জীবনের চাকা সচল রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টার খবর আসছে সংবাদমাধ্যমে। কোলের সন্তান বিক্রি করে সংসার চালানোর মতো হৃদয়বিদারক একাধিক ঘটনা সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছে। এমন একটি পর্যায়ে বিদ্যুতের মতো জীবনের অপরিহার্য একটি উপাদানে আরেক দফা ব্যয়-উল্লম্ফন ঘটলে তা যে জনজীবনে কত বড় অভিঘাত হয়ে দেখা দেবে, তা অনুধাবনের জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবিত হারে বিদ্যুতের দাম বাড়লে চার সদস্যের একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এ খাতে মাসিক খরচ কম করে হলেও ৩০০ টাকা বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ব্যয় বৃদ্ধি এখানেই থেমে থাকবে না। বিদ্যুতের খরচ বৃদ্ধির প্রভাবে পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়বে। অনিবার্যভাবে সব পণ্যের দাম আরেকবার বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা গ্রাহকের কাছ থেকেই বিদ্যুতের বাড়তি ব্যয় আদায় করবেন। হিমায়িত খাদ্যপণ্যের দামে এর প্রভাব অনিবার্য।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ অবধারিতভাবে চাপে পড়বে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বড় চ্যালেঞ্জে পড়বে শিল্পকারখানা। বর্ধিত বিদ্যুৎ বিলের ভার বহনের সক্ষমতা দেশের নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের যেমন নেই, তেমনি সাধ্য নেই শিল্প খাতেরও। ভুল নীতি-পরিকল্পনা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে জোর না দিয়ে দাম বৃদ্ধির প্রতি মনোযোগ দিয়ে সরকার কার্যত দেশের মানুষের সাধ্য-সামর্থ্যের যে তোয়াক্কা করছে না, তা-ই জানান দিচ্ছে। একশ্রেণির লুটেরা ও অর্থ পাচারকারীদের সুযোগ করে দিতে জনগণের ওপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দিয়ে সরকার বলছে, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ দিতেই হবে। সংগতভাবে প্রশ্ন ওঠে উৎপাদন খরচ কত? রাষ্ট্রায়ত্ত সবকটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি তো ২০২০-২১ অর্থবছরে মুনাফা করেছে। গত ২১ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, পিডিবি ২৬৯ কোটি টাকা, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি ৪৩০ কোটি, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি ৯৯ কোটি এবং নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ১১৮০ কোটি টাকা মুনাফা গুনেছে এক বছরে। তাহলে উৎপাদন খরচ ওঠানোর নামে দাম বৃদ্ধির অজুহাতের ভিত্তি কী?

নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়া ও ভোটারদের কাছে জবাবদিহির দিনগুলো অতীত হওয়ায় এখন নিরীহ-নিরুপায় ভোক্তাদের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা নেই বললেই চলে। বিরোধী শক্তিও ক্ষয়িষ্ণু। ফলে জনভোগান্তি থাকছে উপেক্ষিত। তবুও জনগণের কষ্ট অনুধাবনের দাবিদার সরকারের উচিত হবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দাম বাড়ানোর চিন্তা থেকে সরে আসা। বিদ্যুৎ খাতে বিরাজমান দায়দেনাজনিত সংকটের মূল কারণগুলো আমলে নিয়ে তা নিরসনে বিকল্প পন্থাগুলো অনুসরণ করা।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হত্যা মামলায় আ.লীগ নেতা প্রদীপ গ্রেপ্তার

নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ববি ছাত্রদলের বিক্ষোভ

সরিষাবাড়ীতে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের তিন নেতা গ্রেপ্তার

পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ

পীরগঞ্জে বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল চেষ্টার অভিযোগ

দায়িত্ব অবহেলায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের এমডিকে তিনমাসের বাধ্যতামূলক ছুটি

কেশবপুরে পূজা উদযাপন ফ্রন্টের প্রতিনিধি সভা

শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে উইন্টার ও স্প্রিং সেমিস্টারের নবীনবরণ অনুষ্ঠিত

৪৩তম বিসিএসে বাদ পড়াদের অধিকাংশ হিন্দু দাবি করে ভারতীয় মিডিয়ার গুজব

নিহত ছাত্রদল নেতা সবুজ হাসানের পরিবারের পাশে তারেক রহমান

১০

রমজানে ঢাকার ১০০ পয়েন্টে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি হবে ডিম-মুরগি

১১

সুবাতাস বইছে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের পালে

১২

ডেঙ্গুতে বছরের প্রথম মৃত্যু, হাসপাতালে ৫৬

১৩

রাঙামাটিতে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প নিয়ে আইএসপিআরের দাবি নাকচ ইউপিডিএফের

১৪

ফারুকের ওপর হামলার ঘটনায় ছাত্রশিবিরের নিন্দা

১৫

উঠান বৈঠকে বিএনপি, আবেদের কোম্পানিগঞ্জ দিয়ে শুরু

১৬

নদীতে আফগান বাঁধ, ইরানের প্রতিবাদ

১৭

তাহসানের হবু শ্বশুর শীর্ষ সন্ত্রাসী পানামা ফারুক

১৮

ছেলের বউকে উত্ত্যক্ত, প্রতিবাদ করায় প্রাণ গেল শ্বশুরের

১৯

৬৫ পণ্যে ভ্যাট : যে ব্যাখ্যা দিল এনবিআর

২০
X