রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আমাদের প্রধান অর্জন হচ্ছে একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ আমাদের মধ্যে ছিল না এই অর্থে যে, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা ওই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ থেকে ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদে প্রবেশ করেছি। চেতনা এবং দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে এটা আমাদের একটি বড় অর্জন। এ চেতনার মধ্য দিয়েই আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। আমাদের ইতিহাসের স্বাভাবিকতাই এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল দেশপ্রেমিক মানুষের আন্দোলন। এ ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আমাদের দেশের শাসকশ্রেণির মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব রয়েছে। এ কারণে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনা ব্যাহত হয়েছে এবং এই আন্দোলনের ৭২ বছর পরও আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতি বছর আমাদের নতুন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এরই মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করেছে। যদিও সারা পৃথিবীতে এখন মাতৃভাষা বিশ্বায়নের মাধ্যমে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্বায়ন চাচ্ছে জাতিগত সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করে একটি সংস্কৃতিতে পরিণত করতে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে নতুন চেতনা ও জাগরণের সৃষ্টি করলেও এখন পর্যন্ত আমরা এ জাগরণকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারিনি। ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুটি জায়গায় আমরা থেমে গিয়েছি, বলা যায় ব্যর্থ হয়েছি। উচ্চতর আদালত ও উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। উচ্চতর আদালতে একসময় ফারসি ভাষা ছিল। এই জায়গায় পরে ইংরেজি এসেছে। আমাদের কথা ছিল এই জায়গায় আমরা বাংলাকে নিয়ে যাব। তাতে আমাদের দুটো লাভ হবে। প্রথমটি হচ্ছে বাংলা ভাষার বিকাশ হবে এবং প্রকাশ ক্ষমতা বাড়বে। দ্বিতীয়ত বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক আরও স্বাভাবিক এবং নিবিড় হবে। এটা আমরা করতে পারলাম না।
আবার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমাদের খুব স্বাভাবিক একটা অঙ্গীকার ছিল সব শিক্ষাব্যবস্থা মাতৃভাষার মাধ্যমে হবে। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার এ ধারাকেও আমরা এগিয়ে নিতে পারিনি। এই জায়গাতেও আমরা থেমে গেছি। যে পরিমাণ মৌলিক এবং অনুবাদের বই বাংলায় রচনা করা উচিত ছিল তা আমরা করতে পারিনি। এটা আমাদের একটি সীমাবদ্ধতা—বলা যায় একটা ব্যর্থতা। এর সঙ্গে আরেকটা বিষয় উল্লেখ করতে হবে যে, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা হওয়াটাই স্বাভাবিক এবং সেই দৃষ্টান্ত আমরা এখানে স্থাপন করব মাতৃভাষা বাংলাকে কীভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়।
কিন্তু যেটা ঘটল তা হলো, পাকিস্তান আমলের তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার বিভাজন বাংলাদেশ আমলে আরও গভীর হলো। এ বিভাজনটা আমাদের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। এই তিন ধারা হলো, ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম এবং মাদ্রাসাতে আরবির ব্যবহার। এই তিন ধারা আবার শ্রেণি বিভাজনের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। উচ্চবিত্তরা ইংরেজি মাধ্যমে যাচ্ছে, মধ্যবিত্তরা বাংলা মাধ্যমে পড়ছে এবং নিম্নবিত্তের দরিদ্র মানুষ মাদ্রাসায় পড়ছে। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষা যে ভূমিকা পালন করেছিল এবং যে ঐক্যের ফলে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই ঐক্য প্রতিষ্ঠা না করে শিক্ষা বরং বিভাজন সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে শ্রেণি বিভাজনকে আরও দৃঢ় এবং গভীর করে তুলেছে। মাতৃভাষা শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে না পারা আমাদের একটি বড় সমস্যা। আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে একই ধারায় পরিচালিত করতে পারলাম না। এটা আমরা পারলাম না নেতৃত্বের কারণে। কারণ নেতৃত্ব রয়ে গেল সেই বিত্তবান শ্রেণির হাতে। একদিক থেকে এটা সত্য যে, এরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন অন্যদিকে তারা পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গেও জড়িত। জনবিচ্ছিন্নতা এবং পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গে সংলগ্নতার কারণে এ নেতৃত্বদানকারী শ্রেণি রাষ্ট্রীয় কাজে এবং সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে যথার্থভাবে ব্যবহার করল না এবং প্রয়োগ করল না। এ থেকে আমাদের শাসকগোষ্ঠীর প্রকৃত চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ এখানে শাসক বদল হয়েছে এ অর্থে—একদল ক্ষমতায় আসে এবং অন্য দল ক্ষমতা থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় শাসকশ্রেণির যে চরিত্র এটা বদলের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ শাসকশ্রেণি একটাই অবিভাজ্য ও অবিভক্ত। এই শাসকশ্রেণি বাংলা ভাষাকে সর্বক্ষেত্রে ব্যবহারে উৎসাহী নয়। ঐতিহাসিকভাবে আমরা যেটা দেখে এসেছি তা হলো শাসকশ্রেণি কখনোই বাংলা ভাষার মিত্র ছিল না। বাংলা ভাষা সবসময়ই জনগণের ভাষা আর শাসকশ্রেণি কখনো সংস্কৃতি, কখনো ফারসি, কখনো ইংরেজি ব্যবহার করেছে এবং তারা আবার উর্দু চাপিয়ে দিতে চাচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের শাসকশ্রেণিও আগের মতোই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। তারাও জনগণের যে ভাষা, সাধারণ মানুষের যে ভাষা তা ব্যবহার না করে তাদের অনুরাগ দেখা যাচ্ছে ইংরেজির দিকে। তাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ভাষায় পড়ছে এবং তাদের ব্যক্তিগত কথাবার্তায় ও আলাপ-আলোচনায় যে পরিমাণ ইংরেজি শব্দ, বাক্যাংশ এবং পুরোপুরি বাক্য ব্যবহার করা হয় তাতে বোঝা যায় এরা মাতৃভাষা থেকে কীভাবে দূরে সরে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আকাশ সংস্কৃতির যে আগ্রাসন সেটাও বাংলা ভাষার ওপর একটা আক্রমণ হিসেবে আসছে। সেইসঙ্গে বাংলা ভাষার মধ্যে অনেক বিকৃতি দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনওয়ালার বাংলার মধ্যে ইংরেজি ঢুকিয়ে দিচ্ছে, বাংলা শব্দকে ইংরেজি বর্ণে লিখছে।
অর্থাৎ ঐতিহাসিকভাবে শাসকশ্রেণি হলো বাংলা ভাষার শত্রু এবং বাংলাদেশের শাসকশ্রেণিও বাংলা ভাষার মিত্রে পরিণত হয়নি যদিও বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে এবং বাংলা এ দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
লেখক: শিক্ষাবিদ। ত্রৈমাসিক ‘নতুন দিগন্তের সম্পাদক, সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্রের সভাপতি।
অনুলিখন: জাকির হোসেন