ভাষা এক বিশেষ মুহূর্তে মানুষের মুখনিঃসৃত হয়ে মানুষের বৈশিষ্ট্যে প্রকাশ পেয়েছে, যা মানুষকে পৃথিবীর সব প্রাণিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে, যা একজন মানুষের মনের ভাব আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এবং একটি জাতির যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যে জাতি ভাষাগত দিক দিয়ে যত বেশি সমৃদ্ধ, সে জাতি তত বেশি উন্নত। তবে পৃথিবীতে অনেক জাতি ছিল যাদের কোনো ভাষা ছিল না। তবে ভাষা না থাকলেও প্রতিটি জাতির আছে একটি নিজস্ব সংস্কৃতি। প্রতিটি জাতির জীবনযাপনের ধরন, তাদের আচার-আচরণ, কৃষ্টি-দর্শন মিলিয়ে তাদের সংস্কৃতি তৈরি হয়। আমরা বাঙালি, আমাদের আছে সমৃদ্ধ একটি ভাষা, আমাদের আছে হাজার বছরের নিজস্ব সংস্কৃতি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অলংকারে আমরা সারা বিশ্বে পরিচিত। বাংলা ভাষা মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্বভাষা তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে এর অবস্থান সপ্তম। বাঙালির বাইরেও সারা বিশ্বে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বাংলায় কথা বলেন ২৮ কোটিরও বেশি মানুষ। ইতিহাস সাক্ষী দেয় আমরা বাঙালি জাতি হিসেবে বীরের জাতি। আমরা জাতি হিসেবে শক্তিটা পেয়েছি আমাদের ভাষা থেকে, আমাদের সংস্কৃতি থেকে। বাঙালির ভাষা এবং সংস্কৃতি বাঙালিকে বিশ্বদরবারে অনন্য সাধারণ পরিচয়ে পরিচিত করেছে যে, এ জাতি ব্যতিক্রমী একটি জাতি যারা সশস্ত্র জাতীয় আন্দোলনের মাধ্যমে নারী-পুরুষ, ছাত্র-শিক্ষক, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ভাষার অধিকারের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিজাতীয় শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ভাষার অধিকার রক্ষা করেছে, জয় করেছে নিজের আত্মপরিচয়ের ভূমি। সংগ্রামের সেই কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে জয় করে নিয়েছে জাতীয় অধিকার, সমগ্র বাঙালির অধিকার।
আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতির শক্তি আজকে আমাদের যে কোনো সংকটে বারবার শক্তি জোগাচ্ছে। যখনই বাঙালি কোনো বিজাতীয় শক্তির দ্বারা অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হয়েছে, তখনই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং এই ঐক্যের প্রয়োজনে সবাইকে আহ্বান জানাতেও হয়নি বা কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা না বললেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাঙালি তার নিজস্ব দায়িত্ববোধ থেকে তার কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ভাষা, কবিতা, গানকে রক্ষার জন্য অপশক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সুতরাং এই ঐক্যের শক্তি ছিল রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতায়, গানে, সাহিত্যে, এ ঐক্যের শক্তি ছিল রজনীকান্ত-শাহ আবদুল করিমের গানে, এ ঐক্যের শক্তি ছিল লালন-রাধারমনের গানে, এ ঐক্যের শক্তি ছিল জীবনানন্দের-জসীমউদদীনের কবিতায়। বাঙালির এই যে ভাষা এবং সংস্কৃতির বন্ধন, এই বন্ধন কোনো বৈষয়িক লাভের জন্য নয়, এটি হৃদয়ের অতল গভীর থেকে উৎসারিত মানুষের নিরন্তর প্রেরণার উৎস হিসেবে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় কল্যাণে অবদান রাখার ক্ষেত্রে সবসময় প্রেরণা জুগিয়ে আসছে। যার স্বাক্ষর আমরা বিভিন্ন আন্দোলনে, সংগ্রামে এবং জাতীয় কর্তব্যের ক্ষেত্রে দেখেছি। বাঙালি তার ভাষা-সংস্কৃতি-দেশের প্রশ্নে আপসহীন, বাঙালি সবসময় তার ভাষা এবং সংস্কৃতির শক্তির সহজাত সামর্থ্যকেই অবলম্বন করে জাতীয় কর্তব্য পালনে অগ্রসর হয়েছে, সফল হয়েছে। আজকেও যখন আমরা এ আধুনিক সমাজে নানা সংকট দেখতে পাই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সংকটসহ সামাজিক অবক্ষয়ের অনেক বিষয়; আজকে আধুনিক সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমরা দেখতে পাই নিয়ত যেমন, পারিবারিক সংকট, আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতা বা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা দেখতে পাচ্ছি বা সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে যে বাধা ও সংকট দেখতে পাচ্ছি, তা উত্তরণের মূল শক্তি জোগাবে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। কাজেই আজকে যখন পুরো বিশ্ব আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতার চাকায় গতিশীল থেকে জীবনকে দেখতে অভ্যস্ত, সেই সময় বাঙালি তার ভাষা-সংস্কৃতিকে সুকুমার, রুচিশীল, মানবিক, ভ্রাতৃত্ববোধ, কল্যাণ, সত্য ও ন্যায়ের পথে ঐক্যবদ্ধ করার যে আদি এবং প্রাকৃতিক শক্তি, যা আসলে বাঙালির মূল সম্পদ হিসেবে সব সংকটের সময় প্রতিভাত হয়েছে, আজকের দিনেও সেই শক্তিকে ব্যবহার করে এগিয়ে যেতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের জাতীয় সংকট মোকাবিলায় এবং সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধ বাঙালি জাতীয় অগ্রগতি ও সাফল্যের ক্ষেত্রে এই ভাষা এবং সংস্কৃতির শক্তিকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। কারণ এটি হলো আমদের জাতীয় ঐক্যের মূল শক্তি। এটিকে আমাদের সযত্নে লালন করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়