এ বিষয়ে তো কোনো সন্দেহই নেই যে, আমাদের দেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং তার সংরক্ষক ও সুবিধাভোগী শাসকশ্রেণির মতাদর্শিক আধিপত্য বিরাজ করছে। এ পুঁজিবাদে প্রগতিশীলতা নেই, অন্যদিকে এতে পুঁজিবাদের নেতিবাচক দিকগুলোর সবকটিই ভীষণভাবে উপস্থিত। উন্নতি হচ্ছে, তবে তার সঙ্গে সঙ্গে সমানতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈষম্য। পরাধীনতারকালে আমাদের মুক্তি সংগ্রামে দেশপ্রেম ছিল বড় ভরসা, এখন যে পুঁজিবাদীরা দেশ শাসন করছে, তাদের দৃষ্টি দেশের দিকে নয়, পুঁজিবাদী বিশ্বের দিকে; ফলে পুঁজি, সম্পদ, মেধা সবকিছুই পাচার হয়ে যাচ্ছে এবং দেশপ্রেম ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে। আমরা বিদেশি পণ্যের বাজারে পরিণত হচ্ছি। উৎপাদক খাতের তুলনায় সেবা খাত প্রসারিত হচ্ছে। যে কৃষক দেশবাসীকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তারা ভূমি মালিকানা হারিয়ে পরিণত হচ্ছে ক্ষেতমজুরে। শহর গ্রামকে নিঃস্ব করছে। গ্রামে কর্মসংস্থান নেই, ভরসাহীন মানুষরা শহরে ছুটছে। শহরে তারা উপযুক্ত কাজ পাচ্ছে না, অর্ধবেকার থাকছে, আবাস খুঁজছে বস্তিতে। বিনিয়োগ অল্প, অলস টাকা পড়ে থাকছে ব্যাংকে; ব্যাংক ডাকাতি এখন আর বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকেই ঘটছে। মেয়েরা এগিয়েছে, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা বাড়েনি। যে পোশাকশিল্প নিয়ে আমাদের অত্যন্ত অধিক গর্ব, সেটি দাঁড়িয়ে আছে সস্তা শ্রমের নড়বড়ে ও বিপজ্জনক ভিত্তির ওপর। পুঁজিবাদ এখন সব দেশেই বিদ্যমান, কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাদ কতটা যে নিম্নমানের তার নিদর্শন যেমন পাওয়া যাবে ভূমিদস্যুতা ও নির্লজ্জ দুর্নীতিতে, তেমনি পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের, যাদের অধিকাংশই নারী, তাদের অমানবিক দুর্দশাতে।
দ্বন্দ্বের কথা বলছিলাম; যে কোনো একটি সময়ে ও স্থানে অনেকগুলো দ্বন্দ্ব থাকে, কিন্তু তাদের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব প্রধান হয়ে ওঠে এবং তার মীমাংসার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জগতে দ্বন্দ্ব এখন পুঁজিবাদের সঙ্গে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদ লড়বে না। তাকে মানবিক করার যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, দেশের শতকরা পঁচানব্বইজন মানুষের বিরুদ্ধেই সে থাকবে। পুঁজিবাদের বিকল্প হচ্ছে সমাজতন্ত্র। বাংলাদেশে পুঁজিবাদী তৎপরতা আগেও ছিল; ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি উভয় শাসনামলেই যারা দেশ শাসন করত, মতাদর্শিকভাবে তারা পুঁজিবাদেই দীক্ষিত ছিল এবং জনগণকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুঁজিবাদের অধীনেই থাকতে হয়েছে। মানুষ মুক্তি চেয়েছে, মুক্তির আন্দোলনে জাতীয়তাবাদীরা ছিল, সমাজতন্ত্রীরাও ছিল। জাতীয়তাবাদীরা বিদেশিদের শাসনের বিরোধিতা করেছে ঠিকই, কিন্তু ওই শাসকদের মতো তাদের আকাঙ্ক্ষাটিও ছিল পুঁজিবাদী ধরনের। নানা ঐতিহাসিক কারণে জাতীয়তাবাদীরাই নেতৃত্বে থেকেছে। পাকিস্তানি শাসনামলে দেখা গেছে মুক্তির সংগ্রামে সমাজতন্ত্রীরাই ছিল প্রধান শক্তি, কিন্তু তারা মূল ধারায় পরিণত হতে পারেনি। নেতৃত্ব রয়ে গেছে জাতীয়তাবাদীদের হাতেই। মুক্তির সংগ্রাম একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয় এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার চাপে যুদ্ধ শেষে সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সমাজতন্ত্রের ওই সাংবিধানিক স্বীকৃতি টেকেনি, যেন পালিয়ে বেঁচেছে। কারণ যে জাতীয়তাবাদীরা শাসকশ্রেণিতে পরিণত হয়েছে, তারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল না; আপাতদৃষ্টিতে তারা পরস্পরবিরোধী, ক্ষমতার দখল নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর বিরোধ বিদ্যমান, কিন্তু তারা সবাই যে পুঁজিবাদে দীক্ষিত সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। পাকিস্তান আমলে পুঁজিবাদের বিকাশ কিছুটা বাধাগ্রস্ত ছিল, বাংলাদেশ আমলে তার অগ্রগমন নিশ্চিত হয়েছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ মুক্তি পায়নি, পুরাতন ব্যবস্থা নতুন নামে ও নববিক্রমে ফেরত এসেছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র উভয়ই ইহজাগতিক, কিন্তু পুঁজিবাদ যেমন বস্তুতান্ত্রিক, সমাজতন্ত্র তেমন নয়। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বে পুঁজিবাদ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছে, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে আস্থার বেলায় সে একেবারেই অটল। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে এ শিক্ষা নিতে হয়েছে যে, স্থানীয় পরিস্থিতির ওপর দাঁড়িয়েই তাকে আন্তর্জাতিক হতে হবে। ছিন্নমূল আন্তর্জাতিকতা ও গ্রাম্য স্থানীয়ত্ব দুটোই একপেশে এবং অকার্যকর।
আমাদের দেশে পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি সুপ্রতিষ্ঠিত। শিক্ষাব্যবস্থার কথাই ধরা যাক। এ ঘোষণা অটুট রয়েছে যে, শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষ সৃষ্টি করা। শিক্ষার্থীদের বলা হয় তুমি বড় হও; যার অর্থ তুমি নিজে উন্নতি করো, আত্মকেন্দ্রিক হও, অন্যের কথা ভেবো না। এ আদর্শটি পুঁজিবাদী বৈকি। শিক্ষাক্ষেত্রে যে তিনটি সুস্পষ্ট ধারা বিদ্যমান, তারা শ্রেণি বিভক্তির কারণে সৃষ্ট এবং শ্রেণি দূরত্বের ওপর নির্ভরশীল; কিন্তু তিনধারা অভিন্ন তাদের লক্ষ্যের ব্যাপারে; লক্ষ্য হলো সামাজিক মানুষের পরিবর্তে পুঁজিবাদী মানুষ তৈরি করা।
ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার ভেতর যোজন যোজন দূরত্ব, দুয়ের ভেতর মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত অসম্ভব; কিন্তু দুয়ে মিলে একটি কাজ খুব ভালোভাবে করে যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জনবিচ্ছিন্ন করা। ইংরেজি মাধ্যমের বেলাতে কাজটা বেশ পরিষ্কার; মাদ্রাসা শিক্ষাও যে ওই একই কর্তব্যে নিয়োজিত, সেটি কিছুটা অস্পষ্ট হলেও সত্য। মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা নিজেদের শিক্ষিত, কেবল শিক্ষিত নয়, পবিত্র শিক্ষায় শিক্ষিত বলে মনে করে, ফলে তাদের মধ্যে একটি বিশেষ ধরনের অহমিকা জন্মে, তারা উৎপাদনের কাজে হাত লাগাতে উৎসাহ বোধ করে না। তা ছাড়া কাজের দক্ষতাও তারা অর্জন করে না। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই গরিব ঘরের সন্তান, শিক্ষা তাদের জন্য দারিদ্র্য মোচনের সহায়ক না হয়ে বরং তাদের বেকার জীবনের দুর্বিষহতার দিকে ঠেলে দেয়। শিক্ষাদানের নাম করে তাদের দারিদ্র্যের বৃত্তে আটকে রাখার জন্য এ এক নির্মম পরিহাস ও ষড়যন্ত্র। এ শিক্ষার ব্যাপারে শাসকশ্রেণির সব মহল, কী সরকারি, কী বেসরকারি, সমানভাবে উৎসাহী। পেছনের কারণ গরিব মানুষকে সন্তুষ্ট রাখা, নিজেদের জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন এবং সেইসঙ্গে পরকালের জন্য পুঁজি সংগ্রহ করা।
পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যে এখন পাবলিকের সব জিনিস প্রাইভেট হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র পাবলিক রেলওয়ের উৎসাহ দেখায় না, পারলে তাকে বেসরকারি করে দেয়; রাষ্ট্রের উৎসাহ সবদিক দিয়েই বিপজ্জনক ও ক্ষতিকারক প্রাইভেট বাস সার্ভিসে। রাষ্ট্রীয় শিল্পকারখানার প্রসার নেই, কিছু কিছু বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকগুলো চলে গেছে ব্যক্তি মালিকানায়। চিকিৎসাব্যবস্থার প্রায় সবটাই এখন প্রাইভেটের দখলে। সরকারি ব্যাংককে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে দিয়ে রমরমা ব্যবসা চলছে প্রাইভেট ব্যাংকের। বলা হচ্ছে এবং প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে যে, পাবলিকের নিজের যেমন ভালো বলতে প্রায় কিছুই নেই, পাবলিক ব্যবস্থাপনাও তেমনি পুরোমাত্রায় অভিশপ্ত; সে দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অনুপযোগী। আর প্রাইভেট মানেই হলো দক্ষ, উৎপাদনশীল এবং চূড়ান্ত বিবেচনায় পবিত্র।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখনো টিকে আছে, তবে সেখানেও যে ধরনের বিশৃঙ্খলা ও দলাদলি বিদ্যমান, তা কোনো শুভ সংবাদ বহন করে না—না প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য, না দেশের জন্য। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় আসনসংখ্যা এতই অল্প যে, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ছুটতে হয়। সেখানে পড়তে গেলে খরচ অনেক। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে সন্দেহ আছে, তবু সেখানে যেতে হয় এবং খরচ জোগাতে নিরুপায় অভিভাবককে অনেক সময়ে জমিজমাও বিক্রি করতে হয় বলে জানা যায়।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীকারটি বেশ পরিচ্ছন্ন। সেটি হলো পুরোপুরি পুঁজিবাদী মানুষ তৈরি করা। সেখানে সেসব বিদ্যারই শুধু চল রয়েছে, যেগুলো জীবিকার জন্য উপযোগী; দর্শন, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান উপেক্ষিত। দর্শন অধ্যয়নের জন্য স্বতন্ত্র বিভাগ আছে এমন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর জানা যায় না, বাংলা সাহিত্যের চর্চার ব্যবস্থাও রাখা হয়নি। শিক্ষার্থীরা চটপটে ও কর্মকুশলী হোক, তারা অনেক খবর রাখুক, চাকরির জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠুক, এমনটাই চাওয়া হচ্ছে; তারা চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল ও সামাজিক হোক এমন লক্ষ্যকে দূরে সরিয়ে রেখে। তথ্যসমৃদ্ধ মানুষ আর জ্ঞানী মানুষ এক নয়। তথ্য যখন জ্ঞানে পরিণত হয় তখন আশা থাকে যে, তা প্রজ্ঞার জন্ম দেবে। জ্ঞান গভীর হওয়ার এবং প্রজ্ঞার পথে এগোবার সুযোগ পায়। যদি মাতৃভাষার মাধ্যমে তার অনুশীলন ঘটে। সেটি ঘটছে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান অকল্পনীয়।
বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও অনুশীলনের জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের ক্লাব আছে; কিন্তু যা নেই তা হলো ছাত্র সংসদ। ছাত্র সংসদ থাকলে রাজনীতি এসে যাবে এমন আশঙ্কা। রাজনীতি বলতে এ ক্ষেত্রে দলাদলি বোঝানো হয়। রাজনীতির যে একটি দার্শনিক দিক রয়েছে, সেটি খেয়াল করা হয় না; এটিও মান্য করা হয় না যে, রাষ্ট্র যেহেতু আছে তাই রাজনীতি থাকবেই এবং রাজনীতিতে যদি মেধাবানরা না আসে তাহলে ব্যবসায়ীরা আসবে, বাংলাদেশে এখন যেমনটি দেখা যাচ্ছে। মানুষের জন্য বিনোদন অত্যাবশ্যক। সেখানে বাণিজ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে। টেলিভিশন ও রেডিওতে যে বিনোদন সরবরাহ করা হয় সেটি পণ্যের বিজ্ঞাপনের স্বার্থে। বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে গান, নাটক, নৃত্য, আলোচনা চলে। পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারটিই লক্ষ্য, বাকিটি অজুহাত। দেখা যাচ্ছে যে, বিনোদন ক্রমাগত ঘরোয়া ও ব্যক্তিগত হয়ে পড়ছে, সামাজিক থাকছে না। কারণ পুঁজিবাদ সমাজ চেনে না, ব্যক্তিকে চেনে।
বিনোদন অবলম্বন করে হিন্দি ভাষা এখন মানুষের ঘরে ঘরে। উর্দুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছিল, হিন্দির বিরুদ্ধে নেই, কেননা হিন্দি বলপ্রয়োগ করছে না, আনন্দদানের ছদ্মবেশে ঘরের ভেতর অনুপ্রবেশ করছে এবং একটি সাংস্কৃতিক উপনিবেশ গড়ে তোলার অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে। পণ্যের বিজ্ঞাপন-বাণিজ্য কেমন সর্বগ্রাসী হয়ে পড়েছে তা আমাদের সংবাদপত্রগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়। সংবাদপত্রে সংবাদের চেয়ে বিজ্ঞাপনের মর্যাদা প্রাপ্তি একটি পুরাতন সত্য; কিন্তু অধুনা দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে জরুরি যে দুটি পাতা—প্রথমটি ও শেষেরটি; তারাও তলিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনের প্লাবনে। মালিকের তাতে আনন্দ, পাঠকের জন্য বঞ্চনা।
পুঁজিবাদ এখন শুধু রাষ্ট্রের ও সমাজের নয়, ব্যক্তিরও আদর্শ। সে স্থানীয় নয়, বৈশ্বিক। পুঁজিবাদীরা মাদকের ব্যবসা করে, এর দার্শনিক আদর্শটাও এক ধরনের মাদক, যাকে নানাভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে বিনামূল্যে, কিন্তু মূল্য দিতে হচ্ছে মনুষ্যত্বকে। সবকিছু মিলিয়ে আধুনিক বিশ্ব একটি বাজারে পরিণত হয়েছে এবং সেখানে সেই আদিম আরণ্যক নীতি প্রতিষ্ঠিত যে, সে-ই শুধু টিকবে যার শক্তি আছে টিকবার। পুঁজিবাদের সঙ্গে মনুষ্যত্বের যে দ্বন্দ্ব তার মীমাংসা তাই অত্যাবশ্যক। জ্ঞানই শক্তি, এ সত্য মিথ্যা হয়ে যায়নি, যদিও টাকার জোর সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওই জ্ঞান যদি ভাববাদী হয় তাহলে তার প্রসারে বস্তুতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষতি হবে না, উল্টো লাভই হবে; প্রকৃত জ্ঞান বৈজ্ঞানিক, অর্থাৎ ইহজাগতিক। কিন্তু কেবল জ্ঞানে তো কাজ হবে না, জ্ঞানের প্রয়োগ প্রয়োজন। প্রয়োগটা প্রথমত ব্যক্তির ক্ষেত্রেই ঘটবে, কিন্তু তার লক্ষ্য থাকবে সামাজিক। ঐক্যেই শক্তি, বিচ্ছিন্নতাতে হতাশা, এটিও সত্য বটে। ঐক্যবদ্ধ না হলে মানুষের অগ্রগতির পথে প্রধান প্রতিবন্ধক পুঁজিবাদকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। জীবন ও জগতে অসংখ্য দ্বন্দ্ব রয়েছে, কিন্তু অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের সঙ্গেই আজ মানুষের প্রধান দ্বন্দ্ব, ওই দ্বন্দ্বের মীমাংসা হলে সঙ্গে সঙ্গেই যে অন্যসব দ্বন্দ্বের অন্তর্ধান ঘটবে এমনটি অবশ্যই নয়, কিন্তু ওটার মীমাংসা ভিন্ন অন্য দ্বন্দ্বগুলো অনড়ই রয়ে যাবে, এখন যেমন আছে। এ তথ্যটি মনে হয় সত্য।
আমাদের এ গ্রহ এখন কোনো কাল্পনিক নয়, বাস্তবিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে; এর কারণ পুঁজিবাদের দুরন্ত দৌরাত্ম্য। সমাজ আছে, কিন্তু সমাজের ভেতর সবার স্থানটি সমান নয়। অল্প কয়েকজনের অবস্থান কেন্দ্রে, বাদবাকি সবার স্থান প্রান্তে। কেন্দ্র-প্রান্তের ব্যবধান দূর করতে না পারলে পৃথিবী বিপদমুক্ত হবে না। ভরসা এই যে, বিষয়টি অবজ্ঞা করা হচ্ছে না। দার্শনিক অতৃপ্তি মানুষের মস্ত বড় গুণ। সেই অতৃপ্তির পথে প্রধান প্রতিবন্ধক ও মানুষের ভবিষ্যতের প্রতি হুমকি এক ও অভিন্ন। তাকে অপসারণ করা মানুষেরই কর্তব্য, আত্মরক্ষা ও আত্মবিকাশের আবশ্যকতায়।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত সম্পাদক, সমাজ রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্রের সভাপতি
মন্তব্য করুন