ইতিহাস পাঠ না করলে এবং বারংবার পাঠ না করলে, ইতিহাসকে দিয়ে কথা না কওয়ালে ইতিহাস কথা কয় না। তেমন হলে ইতিহাস শুয়ে থাকে। এবং তার নিশ্চেতন লাশের সমান দেহের ওপরে বিকৃতি এবং বিস্মৃতির পলেস্তারা পড়তে পড়তে ইতিহাস অজানার গভীর থেকে গভীরে বিলুপ্ত হতে থাকে।
টানা পাঁচ মাস ধরে মুদ্রাস্ফীতি কমছে, বাড়ছে রাজস্ব আদায়, বাজেট ঘাটতি কমছে, তৈরি পোশাক খাতে ক্রয় আদেশ বাড়ছে, প্রবাসী আয় বাড়ছে, রপ্তানি আয়ে রেকর্ড, ব্যাংকে আমানত বাড়ছে, কমেছে খেলাপি ঋণ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতে আমানত দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৪ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণের সুদ বাড়ার কারণে আমানতের সুদহার বেড়ে গেছে। আর আমানতের সুদহার বাড়ার কারণে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছেন সুদ আয়নির্ভর আমানতকারীরা। ব্যাংক এমডিদের বক্তব্য, সুদহার নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি প্রচলনের পর এর প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্মার্ট রেট (ছয় মাসের ট্রেজারি বিল বন্ডের গড় রেট) অনুযায়ী সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য ব্যাংকের বিনিয়োগে (ঋণে) সর্বোচ্চ সুদহার ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে তারল্য সংকটে থাকা ইসলামী ব্যাংক আরও প্রতিযোগিতামূলক হারে সর্বোচ্চ ১১ থেকে ১২ শতাংশ মুনাফায় আমানত নিচ্ছে। আমানতে প্রবৃদ্ধির যা অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগে এক বছরের বেশি সময় ধরে আমানতের সুদহার ছিল মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে নিম্ন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই একটা কথা বলে থাকেন। তা হলোÑ‘আমার কাছে ক্ষমতা মানেই হচ্ছে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করা। জনগণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা।’ তিনি এও বলেন, ‘কী পেলাম, কী পেলাম না, সে হিসাব মেলাতে আমি আসিনি। কে আমাকে রিকগনাইজ করল, আর কে করল না, সে হিসাব আমার নেই। একটাই হিসাব, এই বাংলাদেশের মানুষ ও তাদের পরিবর্তনে কিছু করতে পারলাম কি না, সেটাই আমার কাছে বড়।’
মাত্র এক যুগের বাংলাদেশে খুব সহজে এই বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়া, অর্থনীতিতে দ্রুত বর্ধনশীল দেশের তালিকায় জায়গা করে নেওয়া, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়ন, পদ্মা সেতু নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেল, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণসহ দেশের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন—সবকিছুই বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ। শুধু তাই নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচকে দেশ যেভাবে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে; তাতে দ্বিধা ছাড়াই বলা যায়—হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি আজ বিশ্বের দরবারে অস্তিত্বকে সদর্পে নিজেদের জানান দিচ্ছে।
১৯৭১ সালে ৯ মাস জনযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ ছিল পৃথিবীর অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত রাষ্ট্র। মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। এই ৫১ বছরে সেই দরিদ্রতা নেমে এসেছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। এটা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুফল। ১৯৭১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সামষ্টিক ও ব্যাষ্টিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথম (১৯৭২-৭৩) অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৫০১ কোটি টাকা। অথচ বর্তমান (২০২৩-২৪) অর্থবছরে বাজেট ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বেশি। ১৯৭০-এ সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৪০ ডলার। বর্তমানে ১৭ কোটিরও বেশি মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ২ হাজার ৭০০ ডলারের বেশি।
বাংলাদেশে প্রায় প্রতিনিয়ত ডলার সংকট ও এর ফলে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির খবর কোনো না কোনোভাবে পত্রিকায় আসে। অথচ পার্শ্ববর্তী পাকিস্তানের দিকে তাকালে দেখা যাবে, পাকিস্তানি রুপি এখন এক ডলারের বিপরীতে দাম ২৯০ রুপিতে দাঁড়িয়েছে। এক কেজি আটা কিনতেও সেখানে আজ ১৬০ রুপির বেশি গুনতে হচ্ছে। চিনির দাম হয়েছে ৩০০ রুপির বেশি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ যেখানে এ ক্ষেত্রে ক্রমোন্নতির ধারায় ১২৯ নম্বর অবস্থানে উন্নীত, সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান নেমে গেছে ১৬১ নম্বরে। সম্প্রতি ‘পাকিস্তানের ভুল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয়’ শীর্ষক নিবন্ধে প্রকাশিত বাংলাদেশ-পাকিস্তানের কয়েকটির তুলনা দেখিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—মাথাপিছু জিডিপিতে পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ ৬৫ শতাংশ এগিয়ে যায়, রপ্তানি আয়ে পাকিস্তানের তুলনায় দ্বিগুণের চেয়েও বেশি; বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির হিসাব) আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী ২০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও তা পাকিস্তানের ছয় গুণেরও বেশি; বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭৩ বছর, যেখানে পাকিস্তানের ৬৬ বছর ৫ মাস; বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ; বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার; বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ, পাকিস্তানের ২ দশমিক ১ শতাংশ; বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ২৩ শতাংশ, পাকিস্তানে তা জিডিপির ৪৬ শতাংশ এবং বাংলাদেশের নারীদের ৪১ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে এই অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ প্রভৃতি।
চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করা এক সময়ের বাংলাদেশকে এখন বিশ্বের রোল মডেল আখ্যা দিয়ে গত বছরের শেষদিকে ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন সম্পর্কে অন্যদের যা শেখাতে পারে’ শীর্ষক নিবন্ধ প্রকাশ করে বিশ্বখ্যাত ‘দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’। লেখার শুরুটা হয়েছে এভাবে, ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনের একজন শিশু পাঁচ বছর পূর্ণ করার আগে মারা যেত, বর্তমানে সেই হার এখন ৩০ জনের মধ্যে একজনে নেমে এসেছে। সংবাদমাধ্যমটির ভাষ্য, অতীতে নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশটি আজ অনেকটাই বদলে গেছে। মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে আটগুণ। নারীদের গড়ে সন্তান সংখ্যা দুজন। অর্থাৎ প্রতিটি সন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও তাদের ভালো রাখতে বাবা-মা এখন আরও বেশি ব্যয় করতে পারেন। ব্যাংকগুলোর কাছে শিল্প খাতে বিনিয়োগের মতো সঞ্চয়ও বেড়েছে। অন্যদিকে ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’-এর নিবন্ধ মতে, রেনেসাঁ ক্যাপিটালের প্রধান অর্থনীতিবিদ চার্লি রবার্টসন বাংলাদেশের উন্নয়ন সাফল্যের পেছনে তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো—সাক্ষরতা, বিদ্যুৎ এবং জন্মহার। ‘শিল্পোন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশের ওপরে থাকা, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ৩০০ কিলোওয়াট ঘণ্টার ওপর বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং জন্মহার তিনটি শিশুর কম থাকাÑ বাংলাদেশ এই তিনটি সূচকে উত্তীর্ণ।
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ আজ নবদিগন্তের সূচনা করেছে। বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথাক্রমে রূপকল্প-২০৪১ ঘোষণা করেছেন। শেখ হাসিনার সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনের জন্য পাঁচ বছর অন্তর তিনটি পর্বে সপ্তম, অষ্টম ও নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০টি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এগুলো হলো—একটি বাড়ি একটি খামার, আবাসন প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, সবার জন্য বিদ্যুৎ, কমিউনিটি ক্লিনিক, মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, বিনিয়োগ উন্নয়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষা।
১৯৭১-এ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান যে জাতির পরিচয় দিয়েছিলেন, ভিত্তি রচনা করেছিলেন, আজ স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর এক সুবর্ণলগ্নে সেই জাতিকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি দিয়েছেন তারই উত্তরসূরি শেখ হাসিনা। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘দ্য রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার: বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড বিজনেস সামিট’ শীর্ষক এক রোডশোতে তার স্বপ্নের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে, যা বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষেরও স্বপ্ন, আর তা হলো, ২০৪১ সালের মধ্যে একটি ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এবং একটি সম্পূর্ণ উন্নত স্মার্ট জাতিতে পরিণত করা।’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরাও সেই অর্থনীতির স্বপ্ন দেখি, দেখছি।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক