মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:০১ এএম
আপডেট : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:৪৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

একুশের বইমেলা বাঙালির প্রাণের সাংস্কৃতিক উৎসব

একুশের বইমেলা বাঙালির প্রাণের সাংস্কৃতিক উৎসব

বাঙালির প্রিয় মাস ফেব্রুয়ারি। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঔপনিবেশিকের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধের প্রতীক। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলার ছেলেরা বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গড়ে তুলেছিল প্রবল প্রতিরোধ। অকাতরে দিয়েছিল প্রাণ। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার, মাতৃভাষার মর্যাদা আর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। বিশ্বে একমাত্র বাঙালি জাতি নিজেদের ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে। বায়ান্ন ভাষা আন্দোলন শুধু এ দেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও নতুন প্রবাহচেতনার সৃষ্টি করেছিল। এ চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন। আজ পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর ৪ শতাংশ অর্থাৎ ২৩৩.৭ মিলিয়ন মানুষের প্রথম ভাষা বাংলা। বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাদেশের জাতীয় এবং দাপ্তরিক ভাষাও বাংলা। অথচ বিশ্বে বহু ভাষা নিষ্পেষিত হওয়ার পর বিলুপ্ত হয়ে গেছে, মানুষ তার মুখের ভাষা হারিয়েছে। শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ব্যবহৃত পৃথিবীর ৪ শতাংশ ভাষার পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটেছে। জাতিসংঘের মতে, ভাষার বৈচিত্র্যের বিলুপ্তি জৈবিক জীবন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক জীবন পর্যন্ত সবকিছুতেই প্রভাব বিস্তার করে। বাঙালি যে একটি ভাষাকে টিকিয়ে রেখেছে, এটাই তাদের জন্য কম গৌরবের নয়। একটি ভাষায় বাঙালি আজ সকাল, সন্ধ্যা, রাত অবধি অনর্গল কথা বলে, স্বপ্ন দেখে। বাঙালির বিরল এ আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সারা বিশ্বে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেসকো। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১—এই দুই দশকের আন্দোলন-সংগ্রামকে স্মরণ করে বাংলাদেশের বাঙালিরা বাংলা ভাষার মাহাত্ম্যকে আজ বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে ফেব্রুয়ারি জুড়ে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানমালার। অন্য ভাষাভাষী মানুষ আজ বাংলা শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে কমবেশি পরিচিত। অমর একুশের অর্জনের ধারাবাহিকতায় একাত্তরে আপামর বাঙালির নিরন্তর ত্যাগ ও তিতিক্ষা, ত্রিশ লাখ শহীদ ও আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা, পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ দিবসে যোগ হয় ভিন্নমাত্রা। বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের নাম। এরপর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে ভাষাশহীদ দিবসের মর্যাদা। বেগবান হয় আবহমান বাংলার ঐতিহ্য, একুশে ফেব্রুয়ারি হয় বিশ্বনন্দিত। ২০০০ সাল থেকে সারা বিশ্বে একুশে ফেব্রুয়ারি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা ভাষা আজ বিশ্বে চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর থেকে একুশের বইমেলাও এক নতুন ধারায় প্রবেশ করতে থাকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং অমর একুশের বইমেলা একই সূত্রে গাঁথা হয়ে যায়। একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করিয়ে দেয় না, ফেব্রুয়ারির সঙ্গে বইমেলা শব্দটিও যুক্ত হয়ে যায়। মহান ভাষা আন্দোলনের স্বাক্ষর হিসেবে প্রতি বছর গোটা ফেব্রুয়ারি ধরে চলে একুশের বইমেলা। শুধু ঢাকায়ই নয়, ফেব্রুয়ারি মাসের যে কোনো সুবিধাজনক সময়ে সারা দেশেই ছোট ছোট বইমেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। লেখক, প্রকাশকরাও একুশের মেলায় তাদের শ্রেষ্ঠ বইটি উপহার দিতে নিরন্তর কাজ করে যান। একুশের বইমেলায় বিভিন্ন স্টলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অংশের প্রবীণ, নবীন লেখকের নানা ধরনের বইয়ের পসরা বসে। মেলায় সমবেত হন বাংলাদেশের বাংলাপ্রেমী লেখক, পাঠক। দেখা মেলে পশ্চিমবঙ্গসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে আসা অতিথির। একুশের গ্রন্থমেলার মধ্য দিয়ে লেখক-পাঠক মতবিনিময়, ভাবের আদানপ্রদানের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। তারপরও বলতে হয় স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা বায়ান্নর আত্মত্যাগের অভিযাত্রার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। বরং ধীরে ধীরে হারাতে বসেছি আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি। পোশাক পরিচ্ছদ, আচার-আচরণে আমাদের অর্জিত গৌরবও অনেকটা হারিয়ে যেতে চলেছে। সরকারি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি অফিস, আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে। দেশে প্রকাশিত, মুদ্রিত বাংলা বইয়ে অসংখ্য ভুলভ্রান্তি এবং অসংগতি চোখে পড়ে। বাংলা বানানেও আজ অবধি প্রতিষ্ঠিত হয়নি একটি জাতীয় মান। তারপরও ফেব্রুয়ারির ভাষাশহীদদের কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করার নানা আয়োজন, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা থেকে বয়সনির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের অগণিত বাংলা বই কেনা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়া বাংলার ঐশ্বর্যের মূল্য অনেক।

অমর একুশের বইমেলার পরিধি সম্প্রসারিত হয়ে বাংলা একাডেমির চত্বর ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অবধি বিস্তৃত হয়েছে বেশ কয়েক বছর হলো। মেলার পরিসরের সঙ্গে বেড়েছে স্টলের সংখ্যা। বাড়ছে ক্রমশ প্রকাশিত বই। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সেকালের বর্ধমান হাউস (আজকের বাংলা একাডেমি) প্রাঙ্গণের বটতলায় একটুকরো চটের ওপর চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত (আজকের মুক্তধারা প্রকাশনী) কলকাতা থেকে আনা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা মাত্র ৩২টি বই নিয়ে যে একুশের বইমেলার শুভযাত্রা শুরু করেছিলেন, তা আজ অনেক বিস্তৃত। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি ১৫ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি এক সপ্তাহের জন্য হ্রাসকৃত মূল্যে বই বিক্রি করে একুশের বইমেলার ধারা অব্যাহত রাখে এবং ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একাডেমি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে, যা উদ্বোধন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রকাশকদের জন্য স্থান নির্দিষ্ট করে একুশের বইমেলার আয়োজন করা হয় এবং ১৯৭৯ সালে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। সময়ের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় মহান একুশের বইমেলা আজকের স্বকীয়তা নিয়ে দেশব্যাপী বিস্তৃতি হতে লাভ করে। ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি পূর্ণ করেছে তার গৌরব ও ঐতিহ্যের হীরকজয়ন্তী।

এবার ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে বইমেলা। একুশ মূলত বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের তারিখ। একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার বিশেষ সুযোগ ঘটে। সারা বছর ধরে বাংলা ভাষা সাহিত্যের যে বই বিক্রি না হয়, শুধু একুশে বইমেলায় তার চেয়ে অনেক বেশি বই বিক্রি হতে দেখা যায়। বইমেলার অগ্রযাত্রায় বাংলা সাহিত্যচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। তাই বাংলা ভাষার সাহিত্যকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণাসহ বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলায় লিখিত ভালো বইগুলোকে বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় অনুবাদের ওপর জোর দিতে হবে। তেমনি বিদেশি বিভিন্ন উন্নতমানের বইকে বাংলায় অনুবাদের উদ্যোগ নিতে হবে। অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের উৎসব। বাংলাদেশের বৃহৎ সাংস্কৃতিক উৎসব। এ উৎসবে সব অশুভ শক্তির দূর হোক। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অর্থনৈতিক দৈন্য যেন উৎসবের ঔজ্জ্বল্য ম্লান করে দিতে না পারে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক-বাহক এই বইমেলা অতীত গৌরব অক্ষুণ্ন রেখে যেন ইতি টানতে পারে। আলোর দিশারি বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই দেশের মানুষকে আলোর পথ দেখাক, দূর করে দিক সব অন্ধকার। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গড়ায় ব্রতী হোক মানুষ। অমর একুশে বইমেলা আগামী দিনে ৩৪ কোটি বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার বিকাশ, সব অপসংস্কৃতিকে রুখে এক অপসাম্প্রদায়িক, উন্নত সংস্কৃতিসমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে দেবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নতুন সিইসি ও কমিশনারদের শপথ রোববার

সবচেয়ে ভয়ংকর ৪ কবিরা গুনাহ 

জুমার দিন মসজিদে হেঁটে যাওয়ার পুরস্কার

কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ চায় না জাতীয় পার্টি

বায়ুদূষণে শীর্ষে লাহোর, ঢাকার অবস্থান কত

শীতে ব্যস্ততা বেড়েছে লেপ তোশক কারিগরদের

ধানবীজ কিনে প্রতারিত কৃষক

কুরিয়ার সার্ভিসে চুরি, ১৯ লক্ষাধিক টাকাসহ কর্মচারী গ্রেপ্তার

বিএনপির অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা

গুগল ড্রাইভ থেকে ডিলিট ফাইল খুঁজে পাবেন যেভাবে

১০

পাকিস্তানে যাত্রীবাহী গাড়িতে গুলি, নিহত ৪২

১১

আজ ঢাকায় আসছেন বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি

১২

ঝোপের ভেতরে গলাকাটা লাশ

১৩

বাকৃবি রোভাররা সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব গঠনে কাজ করবে : বাকৃবি উপাচার্য

১৪

আলু বীজের সংকটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি

১৫

গাজায় নিহতের সংখ্যা ৪৪ হাজার ছাড়াল

১৬

এইচএসসি পাসে চাকরি দিচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক

১৭

শীত নিয়ে যে বার্তা দিল আবহাওয়া অফিস

১৮

আ.লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা তুলে নিলেন ছাত্রদল নেতা

১৯

কুষ্টিয়ায় ভুয়া ডাক্তারকে জেল ও জরিমানা

২০
X