প্রতিবছরই শীতের শুরুতেই রাজধানীর বাতাস ধুলায় ধূসর হয়ে ওঠে। বাতাসে বিদ্যমান এই ধুলোবালি শহরের মানুষের জন্য চরম দুর্ভোগ বয়ে আনে। এ সময় বিভিন্ন ধরনের শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হন ঢাকার মানুষ। বাংলাদেশে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের অর্থাৎ ঢাকার গত আট বছরের বায়ুমান সূচক বা একিউআইর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। গবেষণা তথ্যমতে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের গড় বায়ুমান সূচক কম পরিলক্ষিত হয় অর্থাৎ বায়ুদূষণ কিছুটা কমেছে। ২০২২ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের তুলনায় ২০২৩ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের বায়ুমান সূচক যথাক্রমে ০.৩৮ ও ৮.৭৩ শতাংশ কমে গিয়েছিল। সর্বশেষে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের গড় বায়ুমান সূচক আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ২৮১-এর তুলনায় কমে গিয়ে ২৬০-তে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বায়ুমান সূচক ৭.৫১ শতাংশ কমে গিয়েছে। আবার ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে মোট ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বা দুর্যোগপূর্ণ’ দিন ছিল ১৩ দিন, সেটি কমে গিয়ে ২০২৪ সালে জানুয়ারি মাসের মোট ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বা দুর্যোগপূর্ণ’ দিন পাওয়া গেছে মাত্র তিন দিন। ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বা দুর্যোগপূর্ণ’ দিনের হ্রাস যেন ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ কমার আশ্বাস দিচ্ছে।
২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের এবং ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বায়ুদূষণ কম হওয়ার অন্যতম একটি প্রধান কারণ হতে পারে মেট্রোরেলের যাত্রী পরিবহন কার্যক্রম শুরু হওয়া। ২০১৩ সালে অতি জনবহুল ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও পথের দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় যার অধীনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। মেট্রোরেলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড। ২০১৬ সালে প্রণীত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় নির্মিতব্য মেট্রোরেলের লাইনের সংখ্যা তিনটি থেকে বাড়িয়ে পাঁচটি করা হয়। ২০৩০ সাল নাগাদ ১২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মোট ছয়টি মেট্রো লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ নেটওয়ার্কের অধীনে ৫১টি উড়াল স্টেশন ও ৫৩টি ভূগর্ভস্থ স্টেশন থাকবে। ছয়টি লাইন মিলিতভাবে দিনে ৪৭ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। ২০১৬ সালের ২৬ জুন এমআরটি-৬ প্রকল্পের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে শুরু হয় ঢাকা মেট্রোর নির্মাণকাজের সূচনা। মেট্রোর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই বায়ুদূষণের একটি ঊর্ধ্বমুখী প্রভাব দেখা গিয়েছিল। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর রাজধানীর বায়ুদূষণ করায় মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষকে মোট ৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের দুটি ভ্রাম্যমাণ আদালত। নির্মাণকাজের সময় নিয়ম মেনে ধুলা নিয়ন্ত্রণ না করায় তাদের এ জরিমানা করা হয়েছে। তবে মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকেই বায়ুদূষণের একটি নিম্নমুখী প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানী ঢাকার অসহনীয় যানজটে শুধু মানুষের ভোগান্তি ও কর্মঘণ্টাই নষ্ট হচ্ছে না, এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়ও। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা বলছে, যানজটের কারণে প্রতিদিন যে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, তার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ঢাকার সড়কে প্রতিদিন ৮০ লাখের বেশি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে, যা ২০১৭ সালে ছিল দিনে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা। ওই গবেষণায় আরও বলা হয়, ঢাকায় প্রতিদিন স্বল্প ও দীর্ঘ দূরত্বে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে প্রায় আড়াই কোটি ট্রিপ দেওয়া হয়, যার মধ্যে ৪৪ শতাংশ অফিসগামী যাত্রী। ২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট কর্মঘণ্টার মূল্য বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। দীর্ঘক্ষণ যানজটে গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকার ফলে জ্বালানির অপচয় হয়, নগরীর বায়ুদূষণও বৃদ্ধি পায়। মেট্রোরেল ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকে সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী বা প্রতিদিন প্রায় ৯ লাখ ৬০ হাজার জন যাত্রী যাতায়াত করছে। ফলে যানজট থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণও কিছুটা কমেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমানো গেলে প্রতিবছর ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব হবে। এ ছাড়া ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুসারে, মেট্রোরেল প্রকল্পটি প্রতিবছর ২.৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে, যা জাতীয় জিডিপির ১.৫ শতাংশের সমান। যানজটের আরেকটি ক্ষতি হলো রাস্তার আয়ুষ্কাল কমে যাওয়া। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি থেমে থাকলে রাস্তার আয়ুষ্কাল ১৮-৩০ শতাংশ কমে যায়। প্রকৌশলীরা যখন রাস্তা ডিজাইন করেন তখন তারা চলমান লোড বিবেচনা করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কয়েক হাজার যানবাহনে ভরা থাকায় রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মেট্রোরেলের যাত্রী পরিবহন কার্যক্রম শুরু হওয়ায় রাস্তার ওপর থেকে লোড কমে যাবে। আবার ঢাকার রাস্তায় চলমান প্রায় সব যানবাহন জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করে, যা বায়ুদূষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। মেট্রোরেল চলছে বিদ্যুতের সাহায্যে, ফলে দেখা যাচ্ছে যে, এটির চলাচলের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হচ্ছে না। সুতরাং কার্বনসহ অন্যান্য ক্ষতিকর দূষিত কণার নিঃসরণও হচ্ছে না। তাই এ উৎস থেকেও বায়ুদূষণ কিছুটা কমেছে যার প্রভাব ঢাকা শহরের বায়ুমানে লক্ষণীয়। ক্যাপসের গবেষণা অনুযায়ী, শুধু একটি মেট্রোরেলের লাইন চালু হওয়ার ফলে নগরে প্রায় ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ কমেছে। মেট্রোরেলের সব লাইন চালু হলে এবং যদি গাড়ির সংখ্যা ও ফ্রিকোয়েন্সি কমে আসে, তাহলেই ঢাকার বায়ুদূষণ আশানুরূপভাবে কমে যাবে।
মেট্রোরেল চালু হওয়ায় এখন ঢাকা শহরের কেন্দ্রীয় অংশের জনসংখ্যার ঘনত্ব কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। মানুষ কম বাসা ভাড়ায় অনেক অল্প খরচ করে শহরের বাইরে থাকতে পারবে এবং অফিস ও অন্যান্য কাজে সহজে ঢাকায় আসতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, উত্তরায় বসবাসকারী মানুষজন খুব কম সময়ের মধ্যে মূল শহরে চলে আসতে পারছে। এক গবেষণায় দেখা যায় যে, নগর এলাকায় প্রতি এক লাখ মানুষের বৃদ্ধিতে গড়ে ১ মাইক্রোগ্রাম করে বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পায়। মেট্রোরেলের সুবিধার কারণে ঢাকা শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে মানুষ শহরের আশপাশের উপশহরগুলোতে বসবাস করতে পারে। এতে করে একদিকে যেমন কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক এলাকার (সিবিডি) ওপর চাপ কমবে, পাশাপাশি ঢাকার বায়ুদূষণও কমে আসবে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)