বিশ্বের ১১০টি শহরের মধ্যে বায়ুদূষণে ২৭৬ স্কোর নিয়ে শীর্ষে উঠে এসেছে রাজধানী ঢাকার নাম। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স গত ২৭ জানুয়ারির ঢাকার বাতাসকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বলে অভিহিত করেছে। ঢাকার বাতাসে দূষিত কণাবস্তু উপস্থিতির মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের চেয়ে ২৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে বছরের বেশিরভাগ সময় ঢাকার বাতাসের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে ধরা হয়। সাধারণত ১০১ থেকে ১৫০-এর মধ্যে বায়ুমান স্কোর হলে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’, ১৫০ থেকে ২০০-এর মধ্যে একিউআই স্কোর ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ২০১ থেকে ৩০০ হলে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর একিউআই স্কোর ৩০১+ হলে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে। সেগুলো হলো—বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), এনও২, সিও, এসও২ এবং ওজোন (ও৩)। ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) দূষণের প্রধান উৎস।
বায়ুদূষণ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পাওয়া তথ্য মোটামুটি আঁতকে ওঠার মতো। ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’ বলছে, মানবদেহের জন্য দূষণের অসহনীয় উপাদান মাত্রা পিএম-২.৫ নিয়ে বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর মতে, ঢাকার বায়ুদূষণে সর্বোচ্চ দায়ী নির্মাণকাজ (৩০ শতাংশ)। মানুষের প্রয়োজনে রাজধানীতে গড়ে উঠছে নানা অবকাঠামো। আর এসব নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ইট, বালু, সিমেন্ট খোলা ট্রাকে করে এক জায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তর এবং নির্মাণকাজ চলাকালে অসতর্কতার কারণে বাতাসে ছড়াচ্ছে সূক্ষ্ম বিষাক্ত কণাবস্তু। বায়ুদূষণে ইটভাটার যে ভূমিকা, তা মোট দূষিত পদার্থের ২৯ শতাংশ। অবকাঠামো নির্মাণসামগ্রী হিসেবে বাংলাদেশে ইটের ব্যবহার সর্বাধিক। ইট বাদ দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশে নগর-অবকাঠামো নির্মাণের কথা ভাবা যায় না। ভিত্তি থেকে শুরু করে উপরিকাঠামো নির্মাণকাজে কোনো না কোনোভাবে ইটের ব্যবহার আজও অপরিহার্য। অবকাঠামো নির্মাণকাজে ইটের এ ধরনের সর্বজনীন ব্যবহার দেশের ইট উৎপাদনকে উৎসাহিত করছে। আর এ সুযোগে শুধু রাজধানী ঢাকার আশপাশেই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ইট তৈরির ভাটা। এসব ইটভাটায় বছরে ২৩ বিলিয়নের বেশি ইট তৈরি হচ্ছে এবং তাতে মাটির প্রয়োজন পড়ে প্রায় ৩৩ হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এ ইট প্রস্তুত করতে বছরে প্রায় ৫ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন টন কয়লা পোড়ানো হয়। গবেষণায় বলে, বাতাসে সহনীয় বায়ুদূষকের মাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রাম হলেও খোদ রাজধানী ঢাকায় ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়াজনিত কারণে এ মাত্রা এখন পাঁচগুণ।
ইটভাটা নির্মাণে এবং ইট তৈরি প্রক্রিয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইনকানুন মানা হয় না। ফলে ইটভাটায় সৃষ্ট ধোঁয়ায় ঘটছে ভয়াবহ বায়ুদূষণ। দেশের বনজসম্পদ উজাড় করার ফলে জনস্বাস্থ্য পড়ছে হুমকির মুখে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ইটভাটার জ্বালানি দহনে ছড়াচ্ছে বিষাক্ত জীবনবিনাশী যৌগ পদার্থ। ইটভাটায় সৃষ্ট কালো ধোঁয়ায় রয়েছে মারাত্মক পরিবেশবিনাশী প্রতিক্রিয়া। ইটভাটা থেকে উৎপন্ন ধোঁয়ায় বাতাসে মিশে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইট, সালফার ডাইঅক্সাইড, হাইড্রোকার্বনসহ নানারূপ বিপজ্জনক বিষাক্ত গ্যাস। ফলে বাতাস মধ্যস্থিত অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পায় এবং কার্বনের নানাবিধ যৌগের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। বেড়ে চলে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা। শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ শ্বাসকষ্ট, ব্রংকাইটিস, হাঁপানি এবং ফুসফুসের নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। গৃহপালিত প্রাণীর রোগবালাই বৃদ্ধি পায়। ফসলি জমির উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়। দেশে আধুনিক পদ্ধতিতে মানসম্পন্ন কয়লা দিয়ে ইটভাটা চালানোর কথা থাকলেও কোথাও কোথাও ইটভাটায় ব্যবহার করা হয় অতি নিম্নমানের কয়লা। এ ছাড়া ইটভাটাগুলোতে অতি পুরোনো কায়দায় পোড়ানো হয় বিপুল পরিমাণ কাঠ। আর এ কাঠের জোগান দিতে কেটে ফেলা হচ্ছে দেশের অমূল্য সম্পদ—আম, তেঁতুল, সুন্দরী, মেহগনি, শিরীষ, খেজুরসহ বিভিন্ন রকমের গাছপালা। উজাড় করে দেওয়া হচ্ছে বনভূমি। ব্যাপক বৃক্ষ নিধনের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের দ্রুত অবনতি ঘটছে। সরকারি বিধিবিধান না মেনে ১২০ ফুটের কম উচ্চতায় চিমনি স্থাপনের ফলে কালো ধোঁয়ায় বিপন্ন হচ্ছে পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। অবৈধ ইটভাটা বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা না মেনে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন বাড়িঘর এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশেই জ্বালানি হিসেবে স্থানীয় লোকালয়ের পরিবেশ রক্ষাকারী মূল্যবান কাঠ ব্যবহার করে ইট পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়ায় স্থানীয় জনগণ এবং শিক্ষার্থীদের নানারূপ রোগব্যাধির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমনকি এলাকার রবিশস্য, আমের মুকুলসহ সব ধরনের ফল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সনাতন পদ্ধতিতে ইটভাটার কার্যক্রম চলতে থাকলে বায়ুমণ্ডল দূষণ থেকে যেমনি রেহাই মিলবে না, তেমনি জনগণকে স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে মুক্তি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমের কম গতিবেগে বায়ুপ্রবাহে ইটভাটাগুলো পুরোদমে চালু থাকলে সহজে পরিবেশ দূষক বিষাক্ত গ্যাস পরিবেশের ওপর বেশি প্রভাব বিস্তার করে জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকিও অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে। কাঠ পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট বায়ুদূষণ থেকে পরিত্রাণ পেতে ইটভাটার স্থান নির্বাচন, ভাটা নির্মাণ প্রক্রিয়া, বিশেষ করে চিমনির উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ ও ইটভাটাকে পরিবেশবান্ধব করে তোলা বিশেষ জরুরি। ইটভাটা লোকালয় থেকে দূরে স্থাপন করে চিমনিকে সর্বনিম্ন ১২০ ফুট উচ্চতায় রাখতে হবে। বিশেষ করে, ইটভাটায় কাঠের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর নজরদারি অত্যাবশ্যক। উন্নত বিশ্বে নানা ধরনের ব্রিক ক্লিনে আধুনিক প্রক্রিয়ায় ইট পোড়ানো হয়ে থাকে। এর মধ্যে অধিক প্রচলিত হচ্ছে, এফসিকে পদ্ধতি, যাতে জ্বালানির জন্য কয়লা ও কাঠ উভয়ই ব্যবহার করা যায়। আইএফসিকে পদ্ধতিতে ইট পোড়ানো হলে জ্বালানির দহনে কালো ধোঁয়ার নির্গমন কম হয়। ইটভাটার ধোঁয়া থেকে বায়ুদূষণ রোধে সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পোড়া ইটের বিকল্প হিসেবে সিমেন্ট-বালুর তৈরি ব্লক ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করতে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী