সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২
খন্দকার ইসমাইল
প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:৫৬ এএম
আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:০৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও অস্ত্র জমাদান

ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও অস্ত্র জমাদান

আমি তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত অনুষ্ঠান ঘোষক ও উপস্থাপক। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সময়কার সংঘর্ষ, রক্তপাত, হানাহানির বিবরণ। কিন্তু কী কারণে এত হানাহানি, কখনো জানতে পারিনি। বিগত দিনে যারা দেশের ক্ষমতায় ছিলেন তারাও কখনো এ ব্যাপারটি জনগণের কাছে পরিষ্কার করেনি। দীর্ঘদিনের এই হানাহানি, রক্তপাত বন্ধের জন্য বহুদিন আগে থেকেই শান্তিবাহিনীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পরবর্তীকালে ১৯৯৬-এ নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পর তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পার্বত্য সমস্যাকে একটি রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা চালায় এবং সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানে সাংসদ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে চেয়ারম্যান করে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে। এই কমিটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা নামে পরিচিত) ও অন্য সদস্যের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে দীর্ঘ কাঙ্ক্ষিত ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তি দেশ-বিদেশে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। শান্তিচুক্তির অনেক শর্তের মধ্যে একটি শর্ত হচ্ছে—চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমাদানের দিন-তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করা হবে। তারই ধারাবাহিকতায় ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ সালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড়-টিলা পরিবেষ্টিত সবুজে ঘেরা খাগড়াছড়ি জেলার নবনির্মিত স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমাদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। ওইদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৭৩৯ সদস্য, সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম দফা অস্ত্র জমা দেবে, সূচিত হবে আরেকটি ঐতিহাসিক দিন।

পরবর্তীকালে তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদের প্রচেষ্টায় ৮ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয় সরাসরি সম্প্রচারের। বাংলাদেশ বেতারও সরাসরি সম্প্রচার করবে এ অনুষ্ঠান। ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, খাগড়াছড়িতে ঐতিহাসিক অস্ত্র জমাদান অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারের জন্য ধারাভাষ্যে সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী যাকের, আবেদ খান, শাহরিয়ার কবির, ড. হারুন অর রশিদ এবং সার্বিক উপস্থাপনা ও বর্ণনার জন্য বিটিভির পক্ষ থেকে আমাকে নির্বাচন করা হয়। এত বড় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজনও ব্যাপক। পুরো অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনার দায়িত্ব ছিল একমাত্র আমার ওপর ন্যস্ত।

যা হোক, অনুষ্ঠানটি সফল করার জন্য খাগড়াছড়ি যাওয়ার আগে ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠানটির ধারাভাষ্যকার আমরা সবাই সৈয়দ হাসান ইমাম ভাইয়ের অফিসে দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মিটিং করে অনুষ্ঠানটি কীভাবে করব, কে কতটুকু বলব—তা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়। মিটিংয়ের মধ্যে আবার বেশ কিছু মজার মজার গল্পও হয়েছে। যেমন আমরা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ১০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান শেষে হাসান ভাই প্রধানমন্ত্রীর ইন্টারভিউ নেবেন। আবেদ ভাই তখন বললেন, ‘আচ্ছা হাসান ভাই, ধরুন ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় আপনাকে কেউ গুলি করল, আপনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন আপনার কাজ আমি কীভাবে চালিয়ে নিতে পারি বলুন তো?’ হাসান ভাই তখন বললেন, ‘আমি গুলি খেলে তোমাকে আর অনুষ্ঠান চালাতে হবে না।’ আবেদ ভাই মুখ গম্ভীর করে বললেন, ‘কেন?’ হাসান ভাই বললেন, ‘ছোটবেলায় একটা ধাঁধা আমরা প্রায়ই একজন আরেকজনকে বলতাম, তা হলো একটি গাছে ছয়টি পাখি আছে। একটিকে গুলি করলে আর কয়টি থাকবে।’ এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।

১০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় মূল মঞ্চের পাশে আমাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসলাম। ঠিক পৌনে ১১টায় স্যাটেলাইট কানেকশন পাওয়া গেল। হঠাৎ শুনতে পেলাম সেনাবাহিনীর বাদক দল উপজাতীয় সংগীতে একটি চমৎকার সুর বাজাতে শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম স্টেডিয়ামের গেট দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্যরা সারিবদ্ধভাবে একে একে মাঠে প্রবেশ করতে শুরু করল। দর্শক করতালি দিয়ে তাদের বরণ করে নিচ্ছে। অনুষ্ঠানটি একই সঙ্গে বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে। যাক সে কথা, জনসংহতি সমিতির সদস্যদের মাঠে প্রবেশ শেষ হওয়ার পর, তারা সবাই সামরিক কায়দায় মাঠে তাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসেছে। এরই মধ্যে জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা মাঠে প্রবেশ করেছেন। গ্যালারিতে দর্শক আর উঠতে পারছে না। মাঠের বাইরে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে। সবাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কখন আসবেন। কিছুক্ষণ পর বাদক দল ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটির সুর বাজাতে শুরু করল। ১৯৭১-এ গানটির ভূমিকা সম্পর্কে আবেদ ভাই কিছুক্ষণ বললেন। এরই মধ্যে খবর এলো প্রধানমন্ত্রী আসছেন। প্রধানমন্ত্রী স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলেন। সবাই দাঁড়িয়ে এবং করতালির মাধ্যমে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। এরপর ঘোষণা করলাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের কথা; যার অক্লান্ত-আন্তরিক প্রচেষ্টায় ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই ১০ ফেব্রুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তিন পার্বত্য জেলার অনেক সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। সবাইকে শান্তির পতাকাতলে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানালেন এবং অস্ত্র জমাদানকারী সব সদস্যকে সাদরে বরণ করে নিলেন। প্রধানমন্ত্রী ভাষণের পরই ঘোষণা করলাম বহুকাঙ্ক্ষিত সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির কথা, যে মুহূর্তটির জন্য খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে দেশবাসী। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র জমাদান পর্ব। হাসিমুখে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন সন্তু লারমা। স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে শান্তির পক্ষে সম্মতি জানাল এবং করতালির মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি আরও প্রাণবন্ত, আকর্ষণীয় করে তুলল। প্রধানমন্ত্রী সন্তু লারমার হাতে একজোড়া সাদা গোলাপ তুলে দিলেন। সূচিত হলো শান্তির এক নবদিগন্ত।

লেখক: উপস্থাপক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পটুয়াখালীতে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্ক্র্যাপ শেডে ভয়াবহ আগুন

জুলাই আন্দোলনে সম্পৃক্ততা: জাবির ৯ শিক্ষক সাময়িক বরখাস্ত

বিএনপি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় : আমিনুল হক

টটেনহ্যামকে উড়িয়ে লিভারপুলের প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয়

দুই ছাত্রলীগ নেতাকে আটক করল ছাত্রদল, পুলিশে সোপর্দ

কুমিল্লায় বিএনপির কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে দুগ্রুপের সংঘর্ষ

নিরিবিলিতে মাদক ব্যবসায়ীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী

বরিশালে বজ্রপাতে গৃহবধূর মৃত্যু

কাশ্মীর হামলা তদন্তে চীন-রাশিয়াকে যুক্ত করার প্রস্তাব পাকিস্তানের

ডাকাত ধরতে গিয়ে ট্রাকচাপায় আহত পুলিশ সদস্যের মৃত্যু

১০

আল জাজিরাকে প্রধান উপদেষ্টা / শেখ হাসিনাকে চুপ রাখতে বললেন ড. ইউনূস, মোদি বললেন, ‘পারবেন না’

১১

সোনারগাঁয়ে অবৈধ চুনা ও ঢালাই কারখানায় তিতাসের অভিযান

১২

সিলেটে ডেভিল হান্টে আড়াই মাসে গ্রেপ্তার ৩৫৩

১৩

গ্রাম দখল করে প্লট বিক্রির অভিযোগ, ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা

১৪

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ‘গণপিটুনি’ দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

১৫

সিলেটের ছয়টি পাথর কোয়ারির ইজারা স্থগিত

১৬

জোড়া খুনের ঘটনায় ৩ দিনের রিমান্ডে ছোট সাজ্জাদ

১৭

পরিবেশগত বিবেচনায় ১৭টি পাথর কোয়ারির ইজারা প্রদান স্থগিত করেছে সরকার

১৮

চাঁদা আদায়কারী সেই পুলিশ সদস্য ক্লোজড

১৯

প্রবাসী বাবার লাশ উঠা‌নে রেখে পরীক্ষা দিল ছেলে

২০
X