শান্ত কাজল দিঘিতে দুরন্ত কিশোরের ছোড়া ঢিলে কয়েকটি জলবৃত্ত দৃশ্যমান হয়ে আবার মিলিয়ে যাওয়ার কথা। যদি তা না হয়? হয় যদি জলকম্প অথবা সুনামি। তাহলে সেটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। এরকমই একটি ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের জন্য আমেরিকা ঘোষিত ভিসা নীতির কারণে। সাদা চোখে দেখলে মনে হতে পারে, আমেরিকা এ সতর্কবাণী দিতে চাচ্ছে যে, ‘যদি ভোটের সময় কারচুপি, ভীতিপ্রদর্শন, সহিংসতা বা সভা-সমাবেশ ও মতপ্রকাশের অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার ঘটনা ঘটে, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ যেমন অবাধ্য শিশুকে বলা হয়, ‘আধখানা ডিম পুরাটো খাবা; না হলে পিণ্ডি চটকে দেব।’ কিন্তু গভীরের বাস্তবতা এরকম নয়। ফলে আমেরিকা ঘোষিত ভিসা নীতিকে এক ধরনের সতর্কতা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ ধারায় আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে আরও কঠিন কিছুর আশঙ্কা রয়েছে বলে ধারণা অনেকেরই। আবার অনেকেই মনে করেন, এর আগেই পর্দার আড়ালে একটা মিটমাট হয়ে যাবে। এ বিষয়ে নানান ধরনের জল্পনা-কল্পনা যেমন চলছে তেমনই আলোচনায় এসেছে নানান প্রেক্ষাপট। আর সবকিছু ছাপিয়ে প্রধান প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসেছে, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আমেরিকা ঘোষিত ভিসা নীতির আসল উদ্দেশ্য কী? এই যখন অবস্থা, তখন গত ২১ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন, তার মূল কথা হচ্ছে, আমেরিকা সেন্টমার্টিন দ্বীপ পেতে চায়। কিন্তু তিনি দেবেন না।
প্রধানমন্ত্রীর ২১ জুনের সংবাদ সম্মেলনে আগে কোনো কোনো মহল থেকে জুতা আবিষ্কারের মতো আরেকটি সহজ ইকোয়েশনের কথা বলা হয়েছে। তাদের বক্তব্য, বাংলাদেশের সমুদ্রতলে তেল-গ্যাসের দিকে আমেরিকার দৃষ্টি। এ সম্পদ উত্তোলনের দায়িত্ব নিতে চায় আমেরিকার কোম্পানি। আর এতে বাংলাদেশের আপত্তির কোনো কারণ থাকার কথা নয়। জানামতে নেইও। কেননা, এ সম্পদ উত্তোলন করতে বিদেশি কোম্পানি লাগবেই। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার কোম্পানি হলে দোষের কী? তবে এখানে বেশ বড় একটি ‘কিন্তু’ আছে! তা হচ্ছে, সমুদ্রতলের তেল-গ্যাস উত্তোলনের একক এখতিয়ার চায় আমেরিকা। আর এখানেই নাকি আপত্তি বঙ্গবন্ধুকন্যার। সূত্রমতে, তিনি দিতে চান একাধিক দেশের কোম্পানিকে। কিন্তু বিশ্বমোড়ল চায়, একক কর্তৃত্ব। জানামতে, জটিলতার উৎস এখানেই। কেউ কেউ বলেন, এটিই জটিলতার মূল কেন্দ্র এবং এটি পেলেই আমেরিকা শীতল হয়ে যাবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি আমাদের দেশে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। এ প্রেক্ষাপট সামনে রেখেই নানান পথে হাঁটছে সরকার। এদিকে আন্দোলনের কৌশল ও অপকৌশল ঠিক করতে গলদঘর্ম বিএনপি। আর মাঠে নামছে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল। অনেক নতুন সাইনবোর্ড কেন প্রকাশ্যে আসছে তা অনুমান করা কঠিন কোনো কাজ নয়। তবে বিষয়টি এখনো পুরো পরিষ্কার নয়। তবে এটি খুবই পরিষ্কার, আমেরিকার নতুন ভিসা নীতির ঝামেলার আওতায় আছেন সরকার ও বিরোধী দলের অনেক নেতা। হয়তো টেনশনে আছেন অনেক সংসদ সদস্যও। এ ব্যাপারে কাজী ফিরোজ রশীদের একটি উক্তি উল্লেখ করা যায়। এক টকশোতে তিনি বলেছেন, ‘ভিসা নীতির পর সংসদে অনেক বন্ধুর মুখ শুকিয়ে গেছে, তাদের দিকে তাকানো যায় না!’ মাঝের খবর হচ্ছে, হরিপদ শীল থেকে শুরু করে বাদশা আকবর পর্যন্ত ভিসা নীতির কারণে টেনশনে আছেন।
বাংলাদেশের জন্য আমেরিকার ভিসা নীতি ঘোষিত হয়েছে ২৪ মে। কোনো কোনো মহলের বিশ্লেষণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মতো যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার পেছনে আসল উদ্দেশ্য ভূরাজনৈতিক কৌশলগত ইকোয়েশন। গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন অথবা মানবাধিকার হচ্ছে আওয়াজ মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র আসলে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে বাংলাদেশকে চীনের প্রভাব-বলয়ের বাইরে রাখতে চায়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ ঘিরে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির যেসব পরিবর্তন হচ্ছে, তার মূল লক্ষ্য বাংলাদেশকে চীনের প্রভাব-বলয়ের বাইরে রাখা। অবশ্য এ নিয়ে ভিন্নমতও আছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ড. আনু আনোয়ার গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ নতুন ভিসা নীতির সঙ্গে চীনকে মোকাবিলার কোনো সম্পর্ক আছে এমনটা এককথায় বলা যাবে না। কেননা যুক্তরাষ্ট্র জানে, বাংলাদেশে চীন অনেক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। আবার বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতাও রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র জানে, বাংলাদেশ ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গেই ভারসাম্য রেখে চলতে চায়। তবে অনেকেই মনে করেন, আমেরিকার ভিসা নীতি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কারণ তা বাংলাদেশকে ঠেলে দিতে পারে চীনের সঙ্গে অধিকতর ঘনিষ্ঠ হওয়ার সীমানায়। এদিকে অনেকের এমন একটা ধারণা আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিরোধী। এ প্রসঙ্গে সংসদেও স্পষ্টভাবে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্লেষকদের ধারণা, মূলত চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ঠেকানোই আমেরিকার নতুন কৌশলের মূল লক্ষ্য। বলা হয়, বাংলাদেশ চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ অংশ হয়েছিল। ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘কোয়াড’ নামে ‘বেইজিংবিরোধী ক্লাবে’ যোগ না দেয় এবং এটা করলে চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মারাত্মক ক্ষতি হবে। তার এ মন্তব্য ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলে একে অপ্রত্যাশিত এবং দুর্ভাগ্যজনক বলে আখ্যায়িত করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রীও।
যে যাই বলুক, টানাপোড়েন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশ তিন শক্তির স্বার্থ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আর সবই চলছে লেনাদেনার ইকোয়েশনে। এ পরিস্থিতিতে সরকার রি-অ্যাক্ট করছে এলোমেলোভাবে। হয়তো মূল বিষয় আড়াল করতে চায়। এদিক-ওদিক হাঁটার মতো। আর সমানে আওয়াজ দিয়ে যাচ্ছেন মন্ত্রী-নেতারা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু অভিজ্ঞ মহল বলছে, নতুন মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে সরকারের যথেষ্ট মাথাব্যথা আছে এবং এর বেশ স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে ৩ জুলাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উচ্চারণে। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ স্বাগত জানাবে বাংলাদেশ।
জানা কথা, আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। আর বিশ্বের অনেক কিছু নাটাই এখনো আমেরিকার হাতে। এ ছাড়া যাদের নিয়ে আমাদের সরকার, তাদের অনেকেরই লেজ আমেরিকার কেঁচিকলে ধরা বলে মনে করা হয়। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রাখা হয়েছে বিদেশে। এই কাণ্ডে সরকারি-বিরোধী-ব্যবসায়ী-আমলা-কামলার মধ্যে কোনো ফারাক নেই। এ ক্ষেত্রে আমেরিকাকে মনে করা হয়েছে নিরাপদ সিন্দুক। এ বিভ্রমে আক্রান্ত নেতা-পাতা-আমলা-কামলা-চাকর-বাকর, কার টাকা নেই আমেরিকায়? অবৈধ টাকা মানেই আমেরিকায় উড়াল! সেই আমেরিকাই এখন অব্যর্থ খেলা খেলছে। নতুন ভিসা নীতির নামে আমেরিকা ব্রহ্মাস্ত্র তৈরি করেছে, যা যে কাউকে বিনাশ করে দিতে পারে। এ আশঙ্কায় অনেকেরই ঘুম হারাম হয়ে গেছে। অবশ্য তারা সাধারণত প্রকৃতির ঘোরের স্বাদ সাধারণত পান না। তাদের ঘুম আসলে রঙিন তরলনির্ভর। কিন্তু এখন তাদের ঘুমের ক্ষেত্রে এ তরল আর কাজে আসছে না বলে অনুমান অনেকেরই।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
মন্তব্য করুন