মসজিদ আল্লাহর ঘর। ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত শুদ্ধাচারের মাধ্যমে যেমন আত্মিক পরিশুদ্ধতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, তেমনি মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে সামাজিক ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রতিও তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ও যাপিত জীবনকে কল্যাণময় করার জন্য মসজিদ ও জামাতের গুরুত্ব অত্যধিক। মসজিদকে বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলা হয়। যুগে যুগে আল্লাহতায়ালার প্রেরিত নবী-রাসুলরা মসজিদকে কেন্দ্র করেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছেন।
পৃথিবীতে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যা কালান্তরের ধারাবাহিকতায় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হোক সেটা অত্যন্ত মূল্যবান বা হাজার বছরের স্মৃতিচিহ্নের ধারক, কিন্তু আল্লাহতায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য ও প্রিয় স্থান হলো একমাত্র মসজিদ। সেই মসজিদটি হতে পারে স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব নিদর্শন অথবা হতে পারে খড় বা ছনের ছাউনি দিয়ে আবৃত্ত মাটির বিছানা। যখনই এটিকে মসজিদ বলা হবে, তখনই এর সম্পর্ক হয়ে যায় আল্লাহর সঙ্গে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান হলো মসজিদ আর সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট স্থান হলো বাজার।’ (মুসলিম : ৬৭১)
আল্লাহর সম্মান সবকিছুর ওপর। তাই আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছু সম্পর্কিত হলে সেটিও মর্যাদাবান হয়ে যায়। ঠিক তেমনি মসজিদও আল্লাহর ঘর; সেখানে শুধু আল্লাহরই ইবাদত করা হয়ে থাকে। তাই আল্লাহর মাহাত্ম্যের কারণেই মসজিদকে সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে মোহাব্বত রাখতে চায়, সে যেন আমাকে ভালোবাসে। যে আমার সঙ্গে ভালোবাসা রাখতে চায়, সে যেন আমার সাহাবিদের ভালোবাসে। যে সাহাবিদের সঙ্গে ভালোবাসা রাখতে চায়, সে যেন পবিত্র কোরআনকে ভালোবাসে। যে কোরআনের সঙ্গে ভালোবাসা রাখতে চায়, সে যেন মসজিদগুলোকে ভালোবাসে। কেননা মসজিদ আল্লাহর ঘর। আল্লাহ এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আদেশ দিয়েছেন এবং এতে বরকত রেখেছেন। মসজিদ আল্লাহর হেফাজতে থাকে, মসজিদের সঙ্গে সম্পর্কিতরাও আল্লাহর হেফাজতে থাকেন। তারা নামাজে মনোযোগী হন, আল্লাহ তাদের কার্যোদ্ধার এবং অভাব দূর করেন। তারা মসজিদে থাকা অবস্থায় আল্লাহতায়ালা তাদের জিনিসপত্র হেফাজত করেন।’ (তাফসিরে কুরতুবি : ১২/২৬৬)
মসজিদকে সব রকমের অপবিত্রতা ও দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু থেকে বিরত রাখা ইমানের দাবি। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার সামনে আমার উম্মতের ভালো-খারাপ সব আমল পেশ করা হলো। ভালো আমলগুলোর মধ্যে আছে, রাস্তার মধ্যে কোনো কষ্টদায়ক বস্তু থাকলে তা সরিয়ে দেওয়া। আর খারাপ আমলের মধ্যে আছে যে, মসজিদে থুতু, ময়লা-আবর্জনা থাকা সত্ত্বেও পরিষ্কার না করা।’ (বোখারি : ৪১৫; মুসলিম : ৫৫২)। মসজিদে কিছু কিছু বৈধ কাজ করাও জায়েজ নেই। যেমন লেনদেন, বেচাকেনা ইত্যাদি। আল্লাহর ঘরে এসে নিজের জাগতিক প্রয়োজন পূরণ করাটা বিবেকসম্পন্ন কাজ হতে পারে না। আল্লাহতায়ালা এটা খুব অপছন্দ করেন। আল্লাহর রাসুল এ ধরনের লোককে কঠিন ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘মসজিদে কাউকে বেচাকেনা করতে দেখলে তোমরা বলবে, আল্লাহ তোমার ব্যবসা লাভজনক না করুক।’ (তিরমিজি : ১৩৩৬)
নিয়মিত মসজিদে যাতায়াতকারী ব্যক্তি পরিপূর্ণ ইমানদার হওয়ার আলামত। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা যখন কাউকে নিয়মিত মসজিদে যাতায়াত করতে দেখবে, তখন তার ইমানের সাক্ষ্য দেবে। কেননা আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তারাই হতে পারে মসজিদের আবাদকারী যারা আল্লাহর ও পরকালের ওপর ইমান আনে।’ (সুরা তাওবা : ১৮)। নবীজি (সা.) আরও বলেছেন, ‘মুসলিম ব্যক্তি যতক্ষণ নামাজের জন্য মসজিদে অবস্থান করে, ততক্ষণ সে নামাজরত বলে বিবেচিত হবে। নামাজের স্থানে যতক্ষণ বসে থাকবে ফেরেশতারা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে—হে আল্লাহ! তাকে দয়া করো, হে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করো, যতক্ষণ পর্যন্ত তার অজু ভঙ্গ না হয়।’ (বোখারি : ৬৪৭; মুসলিম : ২৫৭)। মসজিদে গমনকারীদের প্রতিটি পদক্ষেপেই সওয়াব লেখা হয় এবং কেয়ামতের দিন তাদের জন্য নুরের সুসংবাদ রয়েছে। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (সা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মসজিদে নববির পাশে কিছু জমি খালি ছিল। বনু সালামার লোকেরা মসজিদের কাছে স্থানান্তরিত হওয়ার ইচ্ছা করল। এ সংবাদ নবীজি (সা.)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি তাদের বললেন, আমার কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছেছে যে, তোমরা নাকি মসজিদে নববির কাছাকাছি আসার ইচ্ছা পোষণ করেছ? তারা বললেন, হ্যাঁ, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা মসজিদের কাছাকাছি আসার ইচ্ছা পোষণ করেছি। তিনি বললেন, হে বনু সালামা! তোমরা তোমাদের ঘরেই থাকো। (ঘর থেকে মসজিদ পর্যন্ত) তোমাদের প্রতিটি পদচিহ্ন লিপিবদ্ধ করা হবে (এবং সে অনুযায়ী সওয়াব দেওয়া হবে)। এ কথা তিনি দুবার বলেছেন। তারা বলল, এখন আমাদের আর বাড়ি বদলানোর ইচ্ছা রইল না। (মুসলিম : ৬৬৫)
লেখক: ইমাম ও খতিব