সেদিন এক বন্ধু প্রবাসী এক ইউটিউবারের নাম উল্লেখ করে বললেন, তিনি খুব জনপ্রিয়, বিশেষ করে বিএনপি সমর্থকদের কাছে। আমিও তার সঙ্গে একমত পোষণ করি। বিশেষ করে ইউটিউবে তার কনটেন্টের ভিউ দেখলে একমত না হয়ে উপায়ও নেই। তবে আমি তাকে এও বললাম, তার মতো কয়েকজন ইউটিউবারই বিএনপির আজকের করুণ পরিণতির জন্য দায়ী। তারা শুধু শারীরিকভাবে দেশের বাইরে থাকেন তাই নয়; মানসিকভাবেও তারা দেশ থেকে, দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। গত কয়েক বছর ধরেই তারা ‘যে কোনো মুহূর্তে সরকার পতন হয়ে যাচ্ছে’—এ বয়ান প্রচার করছেন। কখনো গণঅভ্যুত্থান, কখনো সেনা বিদ্রোহ, কখনো প্রশাসনিক ক্যুর স্বপ্ন দেখেন তারা এবং সেটা জোর গলায় প্রচারও করেন। আর তাদের এসব বাগাড়ম্বর শুনে বিএনপি নেতাকর্মীরা আশাবাদী হন, প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘরে বসে থাকেন—এই বুঝি সরকার পতন হয়ে গেল, এই বুঝি তারা ক্ষমতায় চলে এলেন। কিন্তু সমস্যা হলো, সেই দিন আর আসে না। ইউটিউবারদের এই অন্তঃসারশূন্য বক্তব্য বিএনপি নেতাকর্মীদের আন্দোলনবিমুখ করেছে। তারা ভাবেন, ইউটিউবারদের কথামতো ভেতরে ভেতরে বুঝি কিছু একটা হচ্ছে। কিন্তু কিছুই হয় না। কূটনীতিকদের তৎপরতা আর ইউটিউবারদের বাগাড়ম্বরে বিএনপি আন্দোলন না করে অপেক্ষা করে। বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক দল। কিন্তু অনেক দিন ধরেই তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে। সবাই যখন বলছিল, অস্তিত্বের স্বার্থেই বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত, তখন তারা আবারও নির্বাচন বর্জনের পথেই হাঁটল। কিন্তু নির্বাচন বর্জন করে ঘরে বসে থাকলেই হবে না। নির্বাচন ঠেকানোর মতো আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সেটা তারা পারেনি। বরং যখন সরকার পতনের একদফা আন্দোলন তুঙ্গে থাকার কথা, তখন বিএনপিকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না।
ওই যে বললাম, বিএনপি আসলে আশায় বসেছিল, ইউটিউবারদের কথামতো সরকার পতন হয়ে যাবে, কূটনীতিকরা তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। এটা ঠিক, বিদেশিদের অনেকে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য নানা চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে বিএনপি না আসায় যুক্তরাষ্ট্রও পিঠটান দেয়। তপশিল ঘোষণার আগপর্যন্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস খুব তৎপর ছিলেন। বিএনপি নেতারা তাকে ‘ভগবান, অবতার’ বলেও অভিহিত করেছিলেন। যেন পিটার হাস মার্কিন রাষ্ট্রদূত নন, বিএনপি চেয়ারপারসন। কিন্তু তপশিল ঘোষণার পর পিটার হাস নীরব হয়ে গেলে হতাশ হতে হয়। এ যেন গাছে তুলে মই সরিয়ে নেওয়ার মতো। পিটার হাস নীরব হয়ে গেলেও নিরাপদ দূরত্বে বসে থাকা ইউটিউবারদের তোড়জোড় কমছিল না। বিদেশিদের ভরসায় বসেছিল বিএনপি।
একটা গল্প আছে না। হিংসুটে প্রতিবেশী বলেন, অমুকের তো বিয়ে হবে না, বিয়ের পর বলে সন্তান হবে না, সন্তান হওয়ার পর বলেন পড়াশোনা হবে না, পড়াশোনা করার পর বলেন চাকরি হবে না, চাকরি হওয়ার পর বলেন বেতন পাবে না। বিএনপির অবস্থাও হয়েছে তাই। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর বিএনপি বলল, তারা নির্বাচনে যাবে না এবং নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। লন্ডনে বসে তারেক রহমান সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক দিলেন। কিন্তু তাতে কেউ সাড়া দেননি। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগেও বিএনপি কানে কানে বলত, নিশ্চিত থাকেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন হচ্ছে না। তারা আরও একটি ১/১১-এর আশায় বসেছিল। নির্বাচন যখন হয়ে গেল, তখন বলল, সরকার গঠন করতে পারবে না। নির্বাচনের আগে আগে যুক্তরাষ্ট্রের সব তৎপরতা থেমে গেলে, বিএনপি নেতারা বললেন, এই নীরবতা বড় ঝড়ের পূর্বাভাস। তারা আশায় বুক বেঁধে বসেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বড় কোনো নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সরকার গঠন ঠেকিয়ে দেবে বা আওয়ামী লীগকে বিদায় করে দেবে। কিন্তু ঘটনা ঘটতে থাকে উল্টো। পিটার হাস ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবনে নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেও পিটার হাসের হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি বিএনপির মনে জ্বালা ধরিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হয়নি বললেও এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেয়নি, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা একে একে নতুন সরকার ও টানা চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাতে থাকেন। বিএনপি যেখানে বসেছিল আওয়ামী লীগ সরকারই গঠন করতে পারবে না, সেখানে অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসে যায় আওয়ামী লীগ সরকার ও শেখ হাসিনা। একেকটি অভিনন্দন বার্তা যেন বিএনপির আন্দোলনের কফিনে একটি পেরেক। তবে শেষ পেরেকটা এসেছে এমন জায়গা থেকে, বিএনপি যাদের দিকে তাকিয়ে আশায় বসেছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চিঠি পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। গত রোববার ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের কাছে চিঠিটি পৌঁছে দেন। চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সমর্থনের পাশাপাশি একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্নপূরণে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় ঢাকার সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো চিঠিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারত্বের পরবর্তী অধ্যায় শুরুর পর্বে আমি বলতে চাই, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ আরও অনেক ইস্যুতে আমাদের প্রশাসন একসঙ্গে কাজ করার ঐকান্তিক ইচ্ছা আমি তুলে ধরছি।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘সমস্যা সমাধানে একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের দীর্ঘ ও সফল ইতিহাস রয়েছে। আর আমাদের এ সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে দুই দেশের জনগণের শক্তিশালী সম্পর্ক।’
জো বাইডেনের এই চিঠি আসলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের এক নবযাত্রার অঙ্গীকার। দুই দেশ নিজ নিজ স্বার্থে পারস্পরিক উন্নয়নে কাজ করবে। এই চিঠি বিএনপির সব আশার বেলুন ফুটো করে দিয়েছে। বিদেশিদের ভরসায় বসে না থেকে, প্রবাসী ইউটিউবারদের ফাঁপা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান না হয়ে বিএনপিকে এখন নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আন্দোলন করতে হবে জনগণের জন্য, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ