ড. সেলিম জাহান
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক। ইউএনডিপিতে যোগদানের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগ ও কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। অতিথি অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যাল্ড ইউনিভার্সিটিতে। বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা, আইএলও, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা-
কালবেলা : বাংলাদেশের উন্নয়নকে বিশ্ববাসী মিরাকেল হিসেবে অভিহিত করেছিল। কিন্তু কভিড-পরবর্তী দেশের অর্থনীতি নানা সমস্যা মোকাবিলা করছে। তার অর্থ কি আমাদের উন্নয়ন টেকসই হয়নি?
সেলিম জাহান : আমি উন্নয়নকে দুটো দিক থেকে দেখি। এর একটা হচ্ছে বৈশ্বিক দিক। বর্তমানে যেসব সমস্যার কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে জ্বালানি ও খাদ্য সমস্যা অন্যতম। এ সমস্যার অনেকটাই করোনাকালে শুরু। করোনার একটা প্রভাব উৎপাদন ও কর্ম নিয়োজনের ওপর পড়েছে। করোনার কারণে প্রবৃদ্ধি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। তারপর ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হলে খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের ওপর প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে সমস্যাগুলোর কথা বলা হচ্ছে তার কিছুটা বৈশ্বিক। তারপরের প্রশ্ন হলো—এর পুরোটাই কি বৈশ্বিক? আমি মনে করি না, সমস্যার পুরোটাই বৈশ্বিক। আমাদের অর্থনীতির কিছু জায়গায় নাজুকতা ও ভঙ্গুরতা রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতির যে চাপ রয়েছে তাকে আমি সংকট বলি না। এগুলো সমস্যা এবং এগুলো থেকে উত্তরণ সম্ভব। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে এটা সংকট, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে বিরাট সংকট। আমাদের জন্য এটা সংকট নয়।
আমাদের প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে দুটো খাত। একটা হচ্ছে পোশাক, আরেকটা হচ্ছে রেমিট্যান্স। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে আমরা অদক্ষ শ্রমিক বাইরে পাঠাই। এখানে একটি কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়লে বা তাদের প্রবৃদ্ধি কমে এলে অদক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে যে আয় করতে পারব সেটি আর পারব না। পোশাকশিল্পও এ ধরনের নাজুকতার মধ্যে আছে। পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রে বিশেষ করে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, তাইওয়ান নতুন প্রতিযোগী হিসেবে সামনে আসছে। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে আমাদের যে সুবিধা ছিল, সে জাতীয় তুলনামূলক সুবিধা এখন এসব দেশের আছে। আমরা যেহেতু দুটো খাতের ওপর নির্ভর করি সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই সেখানে একটা নাজুকতা চলে আসে। এ ক্ষেত্রে কৃষি খাত নিয়ে চিন্তার অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশের কৃষি খাত যতক্ষণ পর্যন্ত ঠিক থাকবে ঠিক ততক্ষণ দেশের অর্থনীতি বড় সংকটে পড়বে না। কৃষি খাতের দুটো ভূমিকা এখানে আছে। একটা হলো খাদ্য উৎপাদন এবং সরবরাহ। বিশেষ করে চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে কৃষি বড় ভূমিকা রাখছে। জনগণের অসন্তোষ যেন প্রকাশ না পায়, কিংবা জনগণের কাছে যদি এ জাতীয় একটি স্থিতিশীল মূল্য না থাকে তাহলে আমরা অনেক রকমের সমস্যা দেখতে পাই। দ্বিতীয়টি হচ্ছে কর্মনিয়োজন। জাতীয় আয়ে কৃষির অংশ কমে এলেও কর্মনিয়োজনে এ খাতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশ বিরাট অংশে বাইরের জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য অনেক বেড়ে যাওয়ায় দেশেও তার প্রভাব পড়েছে। বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমাদের অর্থনীতিতে ফেলছে। বিদ্যুতের সরবরাহ খুব স্থিতিশীল বা নির্ভরযোগ্য থাকছে না। বিভিন্ন সময়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত আমাদের যেসব শিল্পকারখানা রয়েছে, তারা বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুতের দাম বাড়লে তাদের ওপর অন্যরকম চাপ পড়ে। তৃতীয়ত জ্বালানির দাম বাড়ায় পরিবহন খাতও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই পরিবহনের মূল্য বেড়ে গেছে।
কালবেলা : একটা সময় বলা হতো, যেসব দেশে যে পণ্য বেশি উৎপাদিত হয়, সেগুলো আমদানি করবে না। এখন কি আমরা আগের পর্যায়েই ফিরে যাব, যেখানে প্রতিটি দেশ তার প্রয়োজনীয় সব পণ্য উৎপাদন করবে?
সেলিম জাহান : কভিডের সময় আমরা লক্ষ করেছি এবং যেটা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে, সেটি হলো ‘অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ’। এর আগে তুলনামূলক যে সুবিধাটা ছিল, সে অনুযায়ী আমরা কাজ করেছি। করোনার সময় সব দেশেই নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা গেছে। সব দেশই চেয়েছে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুবিধা তার নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এর ফলে করোনার সময় এক ধরনের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। খুব শক্তভাবেই এসেছে, তারই ফলে দেশগুলোর মনে হয়েছে যে, আগামী দিনগুলোতে ভঙ্গুরতা ও নাজুকতা আরও বাড়বে, তখন অন্যের ওপর আর নির্ভর করে থাকা ঠিক হবে না। করোনার সময় যখন একটা দেশে খাদ্যের সংকট দেখা গেছে তখন অন্য দেশ থেকে আনার সুযোগ তেমন ছিল না। এমনকি খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশগুলোও সতর্কতাবশত খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। করোনার সময় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ, আমি বলব না যে চরম অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ, তবে শক্ত অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ দেখেছি। ভবিষ্যতে দেশগুলো তুলনামূলক সুবিধা থেকে সরে গিয়ে বিশেষত খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করবে। এ জাতীয় মানসিকতা বিভিন্ন দেশের মধ্যে রয়েছে। এখন এটা থেকে আগামীতে কতটা উত্তরণ সম্ভব সেটা অনেকটাই নির্ভর করবে অতিমারির মতো আরেকটা সংকট যদি আসে তখন কী হবে। করোনার মতো সংকট না এলে আস্তে আস্তে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ দুর্বল হতে পারে। কিন্তু সে সঙ্গে এ কথাটাও বলতে চাই রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ এখন অনেক শক্তিশালী হয়েছে। যারা রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের কথা বলেন, তারা স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ সামনে নিয়ে আসেন। এটি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যদিও আমরা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বসবাস করি।
কালবেলা : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নাজুকতা তৈরির জন্য কী ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি দায়ী?
সেলিম জাহান : আমার মনে হয় এটা দুটো দিক থেকে হয়। আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আছে। যে কোনো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে সার্বিক একটা ব্যবস্থাপনা। সে ব্যবস্থাপনার দুটো দিক, একটা হচ্ছে নীতিমালা আরেকটা হচ্ছে প্রতিষ্ঠান। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে আমাদের প্রতিবছরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সংযোগ বড় দুর্বল। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, যারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত তারা আসলে ব্যবস্থাপনা এবং এ ব্যাপারে যখন নীতিমালা গ্রহণ করেন, তারা পরিকল্পনার কাছে যান কি না। আমার অনেক সময় মনে হয় পরিকল্পনা বা পরিকল্পনা গ্রন্থটা আমরা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখি। কিন্তু তার সঙ্গে মাঠপর্যায়ে ব্যবস্থাপনার সংযোগ নেই বলে আমার ধারণা। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকে একটা বার্ষিক পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়। বার্ষিক পরিকল্পনার বেশ কিছুটা বাজেট বক্তৃতায় প্রতিফলিত হবে। এটা যদি না করা যায়, তাহলে পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনার মধ্যে পার্থক্য থেকে যাবে। আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে পরিকল্পনা নিয়ে সবার মতামত নেওয়া হয়েছে, যখন ব্যবস্থাপনার কথা আসে, নীতিমালা বাস্তবায়নের কথা আসে তখন কিন্তু অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয়গুলো নিজেরা আলাদাভাবে কাজ করে। যেমন সম্পদ কতটা দেওয়া হবে মন্ত্রণালয়গুলোতে সেটা অর্থ মন্ত্রণালয় বিবেচনা করে এবং এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। কৃষি খাতে যখন আসে, তখন কৃষি মন্ত্রণালয়ই এর নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনা করে। এ ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কোনোরকম যোগাযোগ আছে কি না সেটা কিন্তু তারা দেখে না। আলাদাভাবে মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরগুলো যদি ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে, তাহলে বিভিন্ন অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়গুলোর ক্ষেত্রে কোনোরকম সামঞ্জস্য বা সাযুজ্য থাকবে না। তখন এটা অব্যস্থাপনায় পরিণত হবে। সব কিছুর ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরগুলোকে একত্রে এনে আলোচনা হবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সামঞ্জস্য বা সাযুজ্য রক্ষা করা সবসময় সম্ভব হবে না। ব্যবস্থাপনার মধ্যে পারস্পরিক সাযুজ্যের দুর্বলতা রয়েছে। নীতিমালা এবং পরিকল্পনার মধ্যে সংযোগগত দুর্বলতা রয়েছে। সে কারণে আমরা অনেক সময় দেখতে পাই ব্যবস্থাপনাগুলো অব্যবস্থাপনায় পরিণত হচ্ছে।
কালবেলা : আপনি সম্প্রতি একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দিয়েছেন, সেটি করতে গিয়ে কী মনে হয়েছে। বাংলাদেশ সেখান থেকে কী শিখতে পারে?
সেলিম জাহান : আমি যে দেশের পরিকল্পনা করেছি ওই দেশটির নাম সেইন্ট কিটস ও নেভিস, জনসংখ্যা মাত্র ৫৪ হাজার। সুতরাং, অনেক সময় তাদের সমস্যা বুঝতে গিয়ে আমার চিন্তা-চেতনা নামিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। যেমন আমি ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশের মানুষ। পরিকল্পনা ছোট দেশের জন্য হোক, আর পরিকল্পনা বড় দেশের জন্য হোক, এসবের মধ্যে এক ধরনের অভিন্নতা থাকে। আমার কাছে মনে হয়েছে তারা পুরো দেশের জন্য পরিকল্পনা করে। তারা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। যখন পরিকল্পনা প্রণয়ন হয় তখন দেশে যত প্রতিষ্ঠান আছে, সরকারি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর থেকে শুরু করে বেসরকারি সংস্থা, বেসরকারি খাত সবাইকে নিয়ে ১০ বার আলাপ-আলোচনা করতে হয়েছে। আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করতে হয়েছে। এর ফলে পরিকল্পনা যেটা এলো, সেটি সম্পর্কে প্রত্যেকে ওয়াকিবহাল, প্রত্যেকে জানে।
বাংলাদেশ সেখান থেকে শিখতে পারে। দেশটি ছোট, ক্যারিবীয় অঞ্চলে অন্য যে দেশগুলো আছে তারা সবাই পরস্পরের সঙ্গে পরিকল্পনার সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করে। সেটা বাংলাদেশের জন্য কতখানি সম্ভব হবে জানি না, কিন্তু যেটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে, তাদের পরিকল্পনার জন্য ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর সঙ্গে যোগাযোগ করল কি না, কতটুকু করা যায়, কীভাবে করা যায় ইত্যাদি। ছোট দেশ হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ যখন আসে তখন একা সামাল দিতে পারে না। যুথবদ্ধভাবে অন্য দেশের সঙ্গে মিলে এটি সামাল দিতে হয় বলে তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে।
কালবেলা : বাংলাদেশে এখন অনেক মেগা প্রকল্প চলমান, এটা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার অনেক বিদেশি ঋণ নিয়েছে। এখনকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে সংকট, তাতে অনেকে আশঙ্কা করছেন, ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের বেগ পেতে হবে। আপনি কী মনে করছেন?
সেলিম জাহান : মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে। সেটা বিশ্বব্যাংক হোক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক হোক। আরেকটা করেছে দ্বিপক্ষীয় ঋণ, চীনের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে। এখন ঋণ গ্রহণ করলেই সাধারণ ব্যক্তির মতো ফেরত দিতে হবে, এটাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের ঋণ গ্রহণ করা ও ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে কতগুলো জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণ ফেরত দেওয়ার মেয়াদ ৩০ থেকে ২০ বছরে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। তাদের ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ক্ষেত্রেও সত্য, এটি যদি হয় তাহলে একটা চাপ আছে। দ্বিতীয় হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় ঋণ যেগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, যেমন চীন, ভারত, রাশিয়া থেকে, তার সুদ অনেক। এটা ফেরত দিতে হবে। দ্বিতীয়ত এতদিন বাংলাদেশের যে সুবিধাটি ছিল সেটি হচ্ছে অনুদান। ঋণের বাইরেও অনেক রকম অনুদান তারা পেয়েছে। অথবা খুব অল্প সুদে ঋণ আমরা পেয়েছি, কারণ স্বল্পোন্নত দেশ ছিলাম। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে এরই মধ্যে চলে গেছে। বাংলাদেশ যদি ২০২৪ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে সামনে এগিয়ে যায়, তাহলে অনুদানের বা ভালো শর্তের ঋণ বাংলাদেশ পাবে না। সেইসঙ্গে মনে রাখতে হবে রপ্তানি সুবিধা এতদিন বিশ্ববাজারে পেয়েছি, সেটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র হতে পারে, সেটা কিন্তু আমরা পাব না। সবটা মিলিয়ে যেটা হচ্ছে আমাকে ঋণ ফেরত দিতে হবে। অনুদান এবং অন্যান্য সুবিধার কথা বললাম সেগুলো আমরা পাব না। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে। এটা খুব স্বাভাবিক।
কালবেলা : রিজার্ভের ওপর চাপটা কেন এলো? ব্যবস্থাপনাগত কোনো ত্রুটি রয়েছে কি?
সেলিম জাহান : জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে চাপ পড়েছে। কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে, অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। ভোগের চাহিদাও বেড়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমদানি ও রপ্তানির ব্যবধান বেড়ে গেছে। আমার মনে হয় সময় এসেছে চিন্তাভাবনা করার, আমাদের রপ্তানিকে আরও ব্যাপ্ত করতে পারি কি না। দুটো খাতের মধ্যেই রপ্তানিকে আবদ্ধ রাখলে ভবিষ্যতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কালবেলা : বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ ভোগ বেড়ে যাওয়া এবং সরকারের সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে কীভাবে দেখছেন?
সেলিম জাহান : ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে সবকিছুই বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে। আমেরিকা, কানাডার সবকিছুই আসছে। ফলের দোকানে গেলে অস্ট্রেলিয়ান আপেল, আঙুর থেকে শুরু করে সব কিছু রয়েছে। এসবের প্রয়োজন ছিল না। বিদেশি ফল, সাবান, কসমেটিকস, বিলাসসামগ্রী, দামি গাড়ি আমদানি করা ঠিক নয়।
কালবেলা : রিজার্ভ সংকটের পেছনে আমদানি ও ডলার ব্যয়ের সম্পর্ক রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
সেলিম জাহান : একদম, আমি এখানে ভারতের উদাহরণ দিতে চাই। নেহরুর একটা বই পড়েছিলাম। ভারত কিন্তু তার স্বাধীনতার পর বলেছিল, বড় বড় যেসব শিল্প আছে, জাহাজশিল্প বা অন্যান্য শিল্প সেদিকে তারা মনোযোগ দেবে। ভোগ্যপণ্য বাইরে থেকে আনবে না। এটি বহু দিন ভারতের নীতিমালার মধ্যে ছিল। ভারতের অ্যাম্বাসাডরের গাড়ি অনেকের হাসির পাত্র ছিল। দেশটির সাবানের মান খারাপ হলেও তারা বাইরে থেকে আনেনি। পরবর্তী সময়ে ১৯৯০ সালের দিকে মনমোহন সিং ভারতের অর্থনীতি খুলে দিলেন। ততদিনে ভারতের অর্থনীতির ভিত অনেক শক্ত হয়ে গেছে। আমরা ভোগ্যপণ্যের জন্য আমাদের অর্থনীতি খুলে দিয়েছি। কিন্তু আমাদের উৎপাদনের ভিত শক্ত না, এখনো শক্ত না। এখনো আমাদের সেবা খাত ৪০-৪৫ শতাংশ জাতীয় আয়ের ভাগ। একটি টেলিফোন যদি পাঁচবার হাতবদল হয়, তাহলে ১ টাকা থেকে ৫ টাকা হবে। জাতীয় আয় পাঁচ গুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু, টেলিফোন একটাই। এ জায়গায় আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত।
মন্তব্য করুন