আলম রায়হান
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:১৬ এএম
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:০৩ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কোথায় যাচ্ছে আওয়ামী লীগ

কোথায় যাচ্ছে আওয়ামী লীগ

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ এবং আওয়ামী ঘরানার লোকজনের জন্য এটি নিঃসন্দেহে আনন্দের সংবাদ। কিন্তু নিরানন্দের খবর, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক বিরোধ তৃণমূলে তুঙ্গে উঠেছে। এমনকি নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হেরে অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন নৌকার অনেক প্রার্থী। কোনো কোনো প্রার্থী নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে ভোট কারচুপির রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সঙ্গে হয়েছে দৃশ্যমান সহিংসতা। নির্বাচনের পর এক সপ্তাহেই সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় শতাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও দোকান, বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, তপশিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন-পরবর্তী এক সপ্তাহে সারা দেশে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। এতে অন্তত ১৫ জন নিহত এবং ২ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। নির্বাচনের পর সহিংসতার খবর বেশি পাওয়া গেছে মুন্সীগঞ্জ, ঝিনাইদহ, মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নোয়াখালী, রাজশাহী, পিরোজপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, খুলনা, পটুয়াখালীসহ আরও বেশ কয়েকটি জেলায়। এসব সংঘাত-সহিংসতার বেশিরভাগই ঘটেছে নৌকা প্রতীক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। যারা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থক। প্রার্থিতা ঘোষণার পর থেকেই নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের বিরোধ প্রকাশ্যে আসতে থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি আরও নাজুক হয় নির্বাচনের পর। সহিংসতা ছাড়াও নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকরা আমন্ত্রণ পাচ্ছেন না। পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এ অবস্থায় কোন এলাকায় কার সঙ্গে কার বিরোধ, সেটি চিহ্নিত করাই হচ্ছে বিভাগীয় কমিটির প্রথম কাজ। এরপর সেসব জেলায় গিয়ে চিহ্নিত পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বিরোধ মেটাতে কাজ করবে কমিটি। এরই মধ্যে সব কমিটির কাছে নির্দেশনা পৌঁছে গেছে এবং তারা নাকি কাজও শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু এই কাজের নামে যে ‘অকাজ’ হবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, নিজ নিজ এলাকার কেন্দ্রীয় নেতারাই বিরোধ মেটানোর কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন। তারা নিজেরাই তো এলাকাভিত্তিক বিরোধের সঙ্গে জড়িত। আবার কারও কারও বিরুদ্ধে নানা ধরনের বাণিজ্যের পাশাপাশি মনোনয়নবাণিজ্যের অভিযোগ ওপেন সিক্রেট। ফলে সালিশদার হিসেবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কতটা, তাও বিবেচনার বিষয়। তাদের হস্তক্ষেপে কি বিরোধ মিটবে? এ বিষয়ে অবশ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গণমাধ্যমকে বলেছেন, কোন্দলে লিপ্ত পক্ষগুলোর সঙ্গে বসার পরও যদি বিরোধ না মেটে, তাহলে তাদের ঢাকায় কেন্দ্রীয় কমিটির সামনে বসানো হবে। এর পরও যদি তারা দলের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা অমান্য করেন, সে ক্ষেত্রে আমরা কঠোর থেকে কঠোরতর হব। প্রয়োজনে বহিষ্কার করার মতো সিদ্ধান্তও নেওয়া হতে পারে। এদিকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কেন্দ্র করে মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে শুধু স্বার্থের দ্বন্দ্ব নয়, মানসিক দূরত্বও তৈরি হয়ে গেছে। ফলে বিভাগীয় কমিটির পক্ষে বিরোধ মেটানো কঠিন হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। আর ইচ্ছা করলেই মানসিক বিরোধ মেটানো যায় না। তবে দল থেকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হলে মাঠপর্যায়ের নেতারা বেশিদিন বিরোধ পুষে রাখবেন না বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তবে বিরোধ কিন্তু তুষের আগুনের মতো থেকে যাবে। এ অবস্থায় বিএনপির পালে হাওয়া লাগলে অথবা অন্য কোনো কারণে সরকার বড় ধরনের বিপদে পড়লে তৃণমূলে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কতটা দৃঢ় অবস্থান নিতে পারবে, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করে নির্বাচনে ৬২টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক শীর্ষ নেতা ও হেভিওয়েট নৌকার প্রার্থীও এবার হেরেছেন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে। ফলে কোন্দল কেবল তৃণমূলে নয়, ব্যক্ত-অব্যক্ত অসন্তোষ কেন্দ্রেও বিরাজমান। কিন্তু এ বিষয়টিকে অনেকটা ডাল-ভাত হিসেবে বিবেচনা করেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার ভাষায়, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আমাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী, দলীয় প্রার্থী—সব মিলিয়ে সেখানে কিছু কিছু মান-অভিমান, অন্তঃকলহ ছিল, যার রেশ এখনো শেষ হয়নি কিছু কিছু জায়গায়। আমাদের নেত্রী সব বিভাগীয় কমিটিকে নির্দেশনা দিয়েছেন যে, বিভিন্ন জেলার যে অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো, এগুলোর সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঢাকায় ডেকে এনে এর সমাধান খুঁজে বের করা হবে এবং সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’ দলীয় ঘোষণা অনুসারে কোন্দল মেটানোর জন্য বিভাগীয় নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এমনকি বিভক্তি ঠেকাতে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। কিন্তু এসব উদ্যোগের মাধ্যমে দলটি কি তার অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে সক্ষম হবে? হলেও সেটি কতটা? এমন সব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। আওয়ামী লীগের কোন্দল ও বিভক্তি কতটা মেটানো যাবে। এই কি জলের মতো মিশে যাবে, নাকি থেকে যাবে এক স্থানে জড়ো করা ভাঙা কাচের টুকরোর মতো?

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, বিএনপি অংশ না নেওয়ায় ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সরকারের জন্য। সবাই জানে, প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে ভোট প্রদানে আগ্রহ থাকে না ভোটারদের। এ ছাড়া ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা গুরুত্বহীন হওয়ার প্রভাবও পড়েছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে। এই বাস্তবতায় প্রতি আসনে একজনকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও ভোটে দাঁড়াতে আগ্রহীদের সবাইকে নির্বাচন করার সুযোগ দেয় আওয়ামী লীগ। এতে ভোটাররা ভোট প্রদানে আগ্রহী হলেও তৃণমূলে কোন্দল বেড়েছে। কোথাও উঠেছে তুঙ্গে। অনেক জায়গায় সহিংসতায় রূপ নেয়। যে ধারা অব্যাহত থেকেছে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরও। এখনো বিভিন্ন জেলায় বিভেদ প্রকটভাবে দৃশ্যমান। বিশেষ করে যেসব আসনে নৌকার প্রার্থীরা একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরেছেন।

আওয়ামী লীগের আটটি বিভাগীয় কমিটি রয়েছে। এসব কমিটির মাধ্যমেই তৃণমূলের বিরোধ মেটানোর পরিকল্পনা করেছে দলটি। কিন্তু এই কমিটির কতটা প্রভাব আছে তৃণমূলের ওপর। এ এক বড় প্রশ্ন। অনেকেই বলছেন, নির্বাচন কেন্দ্র করে মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে যে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির পক্ষে সেটি পুরোপুরি দূর করা কঠিন হবে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে দলটির ভেতরে বিভেদ আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় আছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জিতে আবারও পাঁচ বছরের জন্য সরকার গঠন করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকার একটানা এত লম্বা সময় ক্ষমতায় ছিল না। এদিকে কোনো দল দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকলে সবাই নেতা হতে চান, কেউই আর মাঠের কর্মী থাকতে চান না। গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের অনেক নেতা যেমন ক্ষমতাবান হয়েছেন, তেমনি তাদের সম্পদের পরিমাণও বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। রাজনীতি করলে এখন ক্ষমতা ও অর্থ দুটিই অর্জন করা যায়—এ কারণে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে চান। এটি প্রমাণিত সত্য, এ পরিস্থিতিতে দলের মধ্যকার বিরোধ পুরোপুরি মেটানো প্রায় অসম্ভব। এরপরও কেন্দ্রীয় চাপে দেখা যাবে, সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিরোধ থেকেই যাবে। আর দলের নির্দেশ অমান্য করলে বহিষ্কার করার যে হুঁশিয়ারির প্রভাব বাস্তবে কতটা পড়বে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। এই বহিষ্কার কাণ্ডকে বহুল ব্যবহৃত এটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখা হয়। এই কৌশল আগেও প্রয়োগ করা হয়েছে। ঘরের ছেলে ঘরে বরণ করার মতো বহিষ্কৃত নেতাকর্মীদের আবার দলে ফিরিয়ে আনার নজিরও অনেক। সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তাতে দীর্ঘমেয়াদে আওয়ামী লীগের ভেতরে বিরোধ আরও বাড়তে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দলের ভেতরকার যে সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ এখন দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গোঁজামিলের কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতাসীনরা নিজেরাই তৈরি করেছেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সেই পুরোনো গীত, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ভরসা।’ আর সংকটের উপকারিতারও এক ধরনের ন্যারেটিভ আছে। বলা হয়, কোন্দল মানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এতেও কিন্তু এক ধরনের গতি এবং উদ্যম সৃষ্টি হয়। এখন দেখা যাক ক্ষমতাসীন দলে শেষতক কী হয়!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জুলাই ঘোষণাপত্র ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার অবৈধ : ফরহাদ মজহার

ভ্যাট-ট্যাক্স বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিলের আহ্বান

ঢাকায় নাটোরবাসীর মিলনমেলা শুক্রবার

সোনারগাঁয়ে শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব

বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ সংবিধান সংস্কার কমিশনের

পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন মোখলেছুর রহমান

শেখ পরিবার সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ : দুদু 

শীতে বাড়ছে ডায়রিয়া, ৮৫ শতাংশ রোগীই শিশু

এসএমসি’র ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে লোগো উন্মোচন 

৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে ফের ভোটগ্রহণের প্রস্তাব

১০

‘একদম চুপ, কান ফাটাইয়া ফেলমু’, অধ্যক্ষকে জামায়াত কর্মী

১১

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন

১২

বগুড়ায় নাশকতা মামলায় যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৩

বিয়েতে অস্বীকৃতি, বাবার গুলিতে মেয়ে নিহত

১৪

সাত কৃষককে ধরে নিয়ে গেল সন্ত্রাসীরা, মুক্তিপণ দাবি

১৫

ছাগলকাণ্ড : সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রিমান্ডে

১৬

চীন যাচ্ছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, হবে যেসব আলোচনা

১৭

শৈশবের বন্ধুদের প্রিয় কবিতা শোনালেন মির্জা ফখরুল

১৮

পুতুল-টিউলিপসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

১৯

পুতুলকে ‘হু’ থেকে অপসারণে অনলাইনে চলছে গণস্বাক্ষর, ব্যাপক সাড়া

২০
X