বিশ্বজুড়ে বাড়ছে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট জেএন.১-এর সংক্রমণ। চলতি মাসে দেশে চারজন মৃত্যুবরণ করেছে, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ৮.৬২ শতাংশে পৌঁছেছে। এরই মধ্যে ২৩ জানুয়ারি এক দিনে ৪০৬ জনের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে ৩৫ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের জীবাণু পাওয়া গেছে। গত ১৮ জানুয়ারি ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২৮ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে এবং নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ছিল ৪.৯২ শতাংশ। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৮২৩ জনে। ২০১৯ সালের শেষ ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর শুরু। এরপর ইতালি ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ সারা বিশ্বের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়েছে এ করোনাভাইরাস কভিড-১৯। ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ৬৯ কোটি ৯৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩৭৪ জন। সুস্থ হয়েছে ৬৬ কোটি ৯৪ লাখ ৭১ হাজার ২৮৮ এবং মৃত্যুবরণ করেছে ৬৯ লাখ ৫৭ হাজার ৬০১ জন।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথমবারের মতো তিনজনের করোনা সংক্রমণের তথ্য জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা ২৯ হাজার ৪৮১ জন। শনাক্ত ও মৃত্যু পর্যালোচনায় মোট মৃত্যুহার ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। দেশে করোনা আক্রান্তের পর সেরে উঠেছে ২০ লাখ ১৪ হাজার ২০১ জন। সুস্থতার হার ৯৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। লকডাউন, সাধারণ ছুটি এবং প্রতিষেধক টিকাদানের পর থেকে করোনার সংক্রমণ কমে যেতে থাকে। কিন্তু ক্রমাগত জিনবিন্যাস বদলের কারণে সংক্রমণ সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বজুড়ে নতুন করে আক্রান্তের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে সংক্রমণ ছড়িয়েছে এবং ভারতের গোয়া, কেরালাসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে ২১ জনের শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুসারে, বিশ্বে গত ২২ জানুয়ারি এক দিনে ৫ হাজার ৭৮৪ জন কভিড আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ২২ জন।
করোনাভাইরাসের নতুন উপধরন জেএন.১ আগের সব ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে বেশি সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গত বছর ১৫ ডিসেম্বর করোনাভাইরাসের নতুন ধরনটি জেএন.১ শনাক্ত হয় চীনে এবং এরই মধ্যে সেখানে অন্তত সাতজন আক্রান্তের সন্ধান মেলে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা একে ‘আগ্রহের ধরন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং কভিডের এ উপধরনের দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। করোনাভাইরাসের এই উপধরন বিএ.২.৮৬-এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রে শনাক্ত হয় যাকে জেএন.১ বলে ধারণা করা হতো। তবে এ দুই নামের উপধরনের মধ্যে সামান্য কিছু তফাত রয়েছে বলে মতামত সেখানকার রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সেন্টারের। ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে মানুষের দেহে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ার ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম রোগী মৃত্যুবরণ করে। এরপর দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। অল্প কদিনের মধ্যে কভিড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক দিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জনে পৌঁছায় এবং এক দিনে মৃতের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায়। করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বগতির সময়ে দেশে গড় কভিড সংক্রমণের হার ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে। সঙ্গে বাড়তে থাকে চিকিৎসাসেবা প্রদানের নানা সংকট। এক বিপর্যস্ত অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বেশ কয়েকটি বড় হাসপাতালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সুশৃঙ্খলভাবে করোনার প্রতিষেধক টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হওয়ায় ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে। টিকা নেওয়ার দুই মাস পর দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া শুরু করা হয়। দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়ার বেশ কিছু বিরতির পর ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষের মধ্যে বুস্টার ডোজ টিকা দেওয়া শুরু করে বাংলাদেশ। পরে বুস্টার ডোজের আওতায়ও আনা হয় সর্বস্তরের জনগণকে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, করোনা টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার এক সপ্তাহ পর অ্যান্টিবডি তৈরি শুরু হয় আর তিন সপ্তাহ পর ডিটেক্টবল হয়। আর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার এক সপ্তাহ পরই মোটামুটি অ্যান্টিবডি শুরু হবে। করোনা টিকার দুটি ডোজ নিলে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে।
চীনের উহান শহরে প্রথম সার্স-কভিড-২ বা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়ে দ্রুততম সময়ে তা সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে ডব্লিউএইচও এটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ হিসেবে অবহিত করে। শীতকালে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকায় ধারণা করা হচ্ছে, ওমিক্রনের আরেক উপধরন বিএ.২.৮৬-এর তুলনায় জেএন.১ করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অতিরিক্ত পরিবর্তনের কারণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া অব্যাহত থাকতে পারে, যদিও বিএ.২.৮৬ থেকেই জেএন.১-এর উৎপত্তি। শীতের মৌসুমে যেহেতু যে কোনো ধরনের ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি, সেহেতু এসব সংক্রমণের পাশাপাশি করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টেরও সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। বিগত বছরে আদি ভাইরাসের শত শত ভ্যারিয়েন্টের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে যত ধরনের করোনাবিরোধী টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে, তা শুধু আদি করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনকে অকার্যকর করার ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করে। ভাইরাসের ব্রেক-থ্রু সংক্রমণ ঘটায় বুস্টার ডোজ টিকা নেওয়ার পরও অনেক মানুষকে করোনাভাইরাসের শিকার হতে হয়। তাই করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিশেষ গুণসম্পন্ন টিকার নতুন ভার্সন থাকা দরকার। তবে সেই সংক্রমণ ততটা ভয়াবহ রূপ নিতে দেখা যাওয়ার কথা নয়। তবে করোনা বিস্তার লাভের আশঙ্কা দেখা দিতেই দেশের সব হাসপাতালে করোনা ইউনিট ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে হবে। এরই মধ্যে রাজধানীর বেশ কিছু হাসপাতালে টিকাদান কর্মসূচি চালু হয়েছে। বয়স্ক এবং রোগাক্রান্ত মানুষ, অন্তঃসত্ত্বা নারীকে বুস্টার ডোজ অর্থাৎ তৃতীয় ও চতুর্থ ডোজ টিকা নিতে হবে।
শুধু টিকা করোনা সংক্রমণ থেকে কাউকে শতভাগ নিশ্চয়তা দেয় না বলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সর্বাত্মক সতর্কতা অবলম্বনই করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধের উত্তম পথ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক পরাকে অবহেলা করা সহজে বিপদ ডেকে আনে। মুখে মাস্ক থাকলে করোনা আক্রান্ত রোগীর নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরোনো ড্রপলেট মাস্ক ও মুখের মাঝখানে আর্দ্র বাতাসের সংস্পর্শে এসে বাইরে দ্রুতগতিতে না ছড়িয়ে কাছাকাছি মাটিতে গিয়ে পড়ে। ফলে কাছের মানুষের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ রুমালে ঢেকে রাখাও করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। লোক সমাগমস্থলে মানুষের মধ্যে তিন থেকে ছয় ফুট সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ভিটামিন ‘ডি’ পেতে গায়ে রোদ লাগাতে হবে। কারও সঙ্গে করমর্দন বা কোলাকুলি করা যাবে না। আনন্দানুষ্ঠানের নামে অহেতুক জনসমাগম বর্জন করতে হবে। করোনার লক্ষণ দেখা দিলে আইসোলেশনে চলে যেতে হবে। সাবান পানি দিয়ে বারবার হাত ধুতে হবে। আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত জেএন.১ উপধরনকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ হিসেবে অবহিত করেছে। তবে এটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বলা হলেই বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠবে। করোনাভাইরাসের উপধরন জেএন.১ আপাতদৃষ্টিতে তত মারাত্মক নয় বলে অনুমান করা হলেও বেশি মানুষ আক্রান্ত হতে শুরু করলে মৃত্যুও বাড়তে থাকবে। তাই করোনাভাইরাস উপধরন জেএন.১-এর সংক্রমণ রোধ এবং দ্রুততম সময়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে করোনার নতুন উপধরনের সিকোয়েন্সিংয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নজরদারি বাড়াতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী