ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের একপাশে বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, অন্যপাশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। একটির ঐতিহ্য অন্যটির সম্ভাবনা দুটিই এ অভ্যুত্থানের ভেতরে ছিল। ঐতিহ্যটি অবশ্য আরও পুরোনো; ১৮৫৭-তে উপমহাদেশে সিপাহি অভ্যুত্থান হয়েছিল, পাশাপাশি কৃষক বিদ্রোহ ঘটেছে, সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা আমরা জানি, বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও ঐতিহ্যটা প্রবহমান ছিল। ১৯৪৫-এর শেষদিকে—বিশেষভাবে বাংলায় একটি প্রায়-বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যেটিকে দমন করা হয়েছে প্রথমে নির্বাচন দিয়ে। তারপর দাঙ্গা ঘটিয়ে এবং আরও পরে সাতচল্লিশের দেশ ভাগ সম্ভব করে।
ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকা সম্পর্ক উভয়কেই বুঝতে সুবিধা হবে। বস্তুত এ অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানীর নাম বারবারই আসবে। তিনিই ছিলেন এর প্রধান সংগঠক এবং মূর্ত প্রতীক। তার নেতৃত্বেই ১৯৬৮ সালের শেষে ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে লাটভবন ঘেরাও এবং পরদিন হরতাল ডাকা হয়, নির্দিষ্ট অর্থে যেখান থেকে ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সূত্রপাত। আরও বড় সত্য এটি যে, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের ভেতরে যে সমাজতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটিকে তিনি পুরোপুরি ধারণ করতেন।
ভাসানী শুধু যে ওই অভ্যুত্থানের তা নয়, এ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরই সামনে ছিলেন এবং আন্দোলনের জন্য যত কাজ করেছেন, ততই আক্রান্ত হয়েছেন। রাষ্ট্র তাকে আটক করেছে, তার সহযোগীরা কেউ বলেছে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল, কেউ বলেছে হঠকারী; অনুসারীরা অনেকেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কারণ একটাই, তিনি তার অবস্থান থেকে বিচ্যুত হননি। তা তার অবস্থানটা কী ছিল? সেটা ছিল মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রামের। মেহনতিদের দলেই ছিলেন তিনি; কিন্তু তাকে বুর্জোয়াদের সঙ্গে দল গড়তে হয়েছে, কাজও করতে হয়েছে। কেননা মেহনতিদের সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল তখন ছিল না এবং যেহেতু তিনি মেহনতিদের মুক্তির জন্য লড়ছিলেন, তাই ওই মুক্তির যারা বিরোধী তারা তো বটেই, মুক্তির যারা অল্পস্বল্প সমর্থক তারাও তাকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি। এ কে ফজলুল হক সম্পর্কে গল্প আছে, অবিভক্ত বাংলায় এক সময়ে যখন তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের নিন্দাসূচক মন্তব্য করা হচ্ছিল, তখন কারণ জানতে চাওয়া এক অনুরাগীকে তিনি বলেছিলেন, আমগাছেই তো লোকে ঢিল ছুড়বে, শ্যাওড়াগাছে ছুড়বে কেন? মওলানা ভাসানীর নিন্দাকারীরাও ঠিক ওই কারণেই তাকে আক্রমণ করেছে। গাছ থেকে আম পড়লে তাদের সুবিধা। জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে মওলানা ভাসানীর আদর্শিক অবস্থান বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যাবে ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্টের জয়ের পর বার্লিন শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য লন্ডনে আটকাপড়া অবস্থায়।
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তার অবস্থান ছিল স্পষ্ট। একেবারেই অস্পষ্টতাবিহীন। ঊনসত্তর এ ধারণাকেই তিনি কার্যকর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি আবার মেহনতি মানুষের মুক্তিও চাইতেন, যে জন্য তার পক্ষে সমাজতন্ত্রী না হয়ে উপায় ছিল না। সমাজতন্ত্রে তার আস্থা গ্রন্থপাঠের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়নি; তেমন সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত ছিলেন। তিনি সমাজতন্ত্রী হয়েছেন অভিজ্ঞতা থেকে এবং কমিউনিস্টদের সঙ্গে মতামতের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে, যেটা বিশেষভাবে ঘটেছে কারাবন্দি অবস্থাতে। তার অবস্থান খুবই পরিষ্কার ছিল। কিন্তু যারা পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং যারা মেহনতিদের বিপক্ষে কাজ করেছে, তাদের পক্ষে তাকে বোঝা সম্ভব ছিল না। তাদের কারও কারও কাছে তাই তার ভূমিকা মনে হয়েছে ক্ষতিকর; ছাড় দিয়ে কেউ কেউ বলেছে তিনি রহস্যময়। রহস্যটা অবশ্য অন্য কোথাও ছিল না, ছিল বুর্জোয়াদের দিক থেকে তাকে বুঝতে চাওয়ার অসম্মতিতে।
জনগণের দৃষ্টিতে দেখতে গেলে মওলানার মতো জনসংগঠক ও ধারাবাহিকভাবে সংগ্রামী জননেতা তার সময়ে এ উপমহাদেশে দ্বিতীয় কাউকে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। গান্ধী ও জিন্নাহ তার আগের, তাদের বিস্তর আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছিল, তবে তারা কেউই মেহনতি মানুষদের নেতা ছিলেন না, তারা ধনীদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠার রাজনীতিই করেছেন। মওলানার রহস্যময়তার আরও একটা কারণ তার বৃহত্ত্ব। তিনি খুবই বড় ছিলেন, অথচ তাকে খাটো মনে হয়েছে। কারণ ‘খাটো’ মানুষদের সঙ্গে তার ওঠাবসা। আন্তর্জাতিকভাবে তিনি এ উপমহাদেশের বড় বড় নেতার মতো পরিচিত ছিলেন না, কিন্তু তার নিজের ভেতরে যে আন্তর্জাতিকতা ছিল, সেটি অসামান্য। তিনি কৃষকদের নেতা, কৃষকের ওপর শোষণ যে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট, স্থানীয় শাসকরা যে একটি বিশ্বব্যবস্থার অংশ, সেটা তিনি যেভাবে দেখতে পেয়েছেন ও প্রচার করেছেন অন্য কোনো জনপ্রিয় নেতাকে সেটা সেভাবে করতে দেখা যায়নি। মেহনতি মানুষের মুক্তির সমস্যাকে তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেননি এবং এটা তার কাছে মোটেই অস্পষ্ট ছিল না যে, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম এক ও অভিন্ন বটে।
যেহেতু তিনি মওলানা ছিলেন, তাই ধারণা করা হতো তিনি সাম্প্রদায়িক, অথচ মওলানা ভাসানী শুধু যে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তা-ই নয়, আসলে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাতেই আস্থা রেখেছিলেন। রাষ্ট্রকে তিনি ধর্মের সঙ্গে মেশাতে চাননি, আলাদা রাখতে চেয়েছেন। তিনি যে কংগ্রেস পার্টি পরিত্যাগ করেছিলেন সেটা এ কারণে নয় যে, কংগ্রেস ততদিনে হিন্দু ভাবমূর্তি ধারণ করেছে, বরং এ কারণে যে, কংগ্রেস ধনীদের দলে পরিণত হয়ে গেছে এবং তার মুসলিম লীগে যোগদানের পেছনে ইসলামপ্রীতি ছিল না, ছিল এই আশা যে মুসলিম লীগে থাকলে গরিব মানুষদের সঙ্গে থাকা ও তাদের হয়ে কথা বলা সম্ভব হবে। তার পাকিস্তান আর জিন্নাহর পাকিস্তান মোটেই এক জিনিস ছিল না, আর ছিল না বলেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী মুসলিম গঠনের কাজে। তাকে মনে করা হতো অশিক্ষিত, কাঠমোল্লা। যে ইত্তেফাক পত্রিকা মওলানা নিজের উদ্যোগে ও শ্রমে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সে পত্রিকাটি দখল করে নিয়ে যিনি নিজের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার ভিত্তিটি তৈরি করেছিলেন সেই তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াও ন্যাপ গঠনের পর মওলানাকে বলতে শুরু করেছিলেন, ফাইভ পাস লুঙ্গিসর্বস্ব মওলানা। আর আওয়ামী লীগ যখন গঠিত হয় সেসময়ে মওলানার সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দেওয়াতে তার পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেগে গিয়ে বলে বসেছিলেন, ‘এ সমস্ত আপনি বুঝবেন না। কারণ, এ সমস্ত জানতে হলে অনেক শিক্ষার প্রয়োজন, তা আপনার নাই।’ মওলানার জন্য সে উক্তি গভীর মর্মবেদনার কারণ হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ঘটনাটির কথা তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে স্মরণ করেছেন। শামসুল হক পরে পরস্পরবিরোধী নানান ধরনের চাপে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, মওলানার ক্ষেত্রে যেটি ঘটা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। ১৯৪৯ সালেই তিনি কারারুদ্ধ হন, ছিলেন ঢাকা জেলে।
ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময়ে আপসপন্থি কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তো মওলানাকে আইয়ুব খানের চেয়েও বড় শত্রু ভাবতেন। মোহাম্মদ ফরহাদ লিখিত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের রিপোর্ট সে কথাই বলে। আর জামায়াতে ইসলামের কাছে তো ভাসানী ছিলেন জীবন্ত শয়তানদের মতো দুশমন। ঊনসত্তরের পর উগ্রপন্থি বলে কথিত মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল হক, আবদুল মতিনের মতো কমিউনিস্ট নেতারাও মওলানাকে ত্যাগ করেছিলেন তিনি পেটি বুর্জোয়া অস্থিরতা ত্যাগ করতে পারেননি এ দুশ্চিন্তায়। পশ্চিমা গণমাধ্যম তার নাম দিয়েছিল প্রফেট অব ভায়োলেন্স; উদারনীতিবাদের কেউ কেউ বলেছেন ফায়ার-ইটিং মওলানা। মওলানাকে নিয়ে আলোচনা বিশেষভাবে প্রয়োজনে হবে এজন্য যে, ঊনসত্তরের অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষাকে ও চেতনাকে, তিনি যেভাবে নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন এবং যেভাবে তাকে সমাজবিপ্লবের দিকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট ছিলেন, অন্য কোনো নেতার পক্ষেই তেমনটা করা সম্ভব হয়নি। সম্ভব ছিলও না। মওলানা ভাসানী ছিলেন আজন্ম বিপ্লবী। তার শত্রু ও মিত্রদের দেখলে ঊনসত্তরকে চেনাটা সহজ হয়। মওলানা ভাসানী এবং ঊনসত্তরকে আলাদা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়