শংকর মৈত্র
প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:২১ এএম
আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:৫৮ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ম্যাকিয়াভেলির তত্ত্ব ও বিএনপির রাজনীতি

ম্যাকিয়াভেলির তত্ত্ব ও বিএনপির রাজনীতি

‘শাসনক্ষমতার বৈধতা কোনো নৈতিকতার মাপকাঠিতে আবদ্ধ নয়, কর্তৃত্ব আর ক্ষমতাই এখানে মূল বিষয়। যার ক্ষমতা আছে সেই শাসন করবে, নৈতিকতা কাউকে ক্ষমতায় বসায় না। ক্ষমতা অর্জন আর ক্ষমতা রক্ষা করাই রাজনীতির মূল নীতি। ক্ষমতার উপযুক্ত ব্যবহার দিয়েই জনগণের আনুগত্য অর্জন করতে হয়। রাজনীতি মানেই হলো ক্ষমতা গ্রহণ আর প্রয়োগের নীতি।’ উপরোক্ত কথাগুলো আমার নয়। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক নিকোলা ম্যাকিয়াভেলির। শিক্ষিত মানুষজন ম্যাকিয়াভেলি নিশ্চয়ই পড়েছেন। ম্যাকিয়াভেলির বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য প্রিন্স। যেখানে তিনি রাজনীতিকে একটা সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে বর্ণনা করেছেন। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য সরকারের ধারাবাহিকতা ও দীর্ঘ শাসনের কথা বলেছেন তিনি। বর্তমান বিশ্বে বেশিরভাগ দেশেই ম্যাকিয়াভেলির তত্ত্ব অনুযায়ীই রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। সেটা পাশ্চাত্যেই হোক আর প্রাচ্যেই হোক। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এটা স্পষ্টতই দৃশ্যমান। গত ১৫ বছরের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এই তত্ত্ব ভালো করেই প্রয়োগ ঘটিয়েছে। তার কারণ হতে পারে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে জানেন এবং আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক ম্যাকিয়াভেলিকে ভালো করে আয়ত্ত করেছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে যে তফাত দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, আওয়ামী লীগ ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স শুধু পড়েনইনি—এই রাষ্ট্রচিন্তকের তত্ত্ব তারা প্রয়োগ ঘটিয়েছেন বাস্তবে। আর বিএনপির নীতিনির্ধারকরা ম্যাকিয়াভেলি কিংবা তার তত্ত্ব না পড়ে, প্রয়োগের চেষ্টা না করে ফরহাদ মজহার, ইউটিউবার বিপ্লবী পিনাকী ভট্টাচার্য, তাজ হাসমী, কনক সরোয়ার, ইলিয়াসদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করে তাদের তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। গত কয়েক বছরে এই ইউটিউবাররা বিদেশে বসে বিএনপির আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। তারা দিন তারিখ পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়েছে কখন সরকারের পতন হবে, বিএনপির কারা কী দায়িত্ব পাবেন, আমেরিকা কী কী করবে—এমন নানাকিছু। আর তাদের কথায় মুগ্ধ হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন। শেষ পর্যন্ত যথা সময়েই নির্বাচন হয়ে গেল, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করল। বিএনপির এখন আম-ছালা দুটিই যাওয়ার উপক্রম।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না রাজনীতি একটা কূটকৌশলের খেলা। কৌশলে যে জয়ী হবে সেই ক্ষমতা ভোগ করবে। এবার টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এলো আওয়ামী লীগ। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতি উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতিকে বিসর্জন দিয়ে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে প্রাধান্য দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলে। সেই থেকেই মূলত দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে দেশের রাজনীতি। এক পক্ষে আওয়ামী লীগ যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে এগিয়ে যেতে চায়। অন্য পক্ষে অ্যান্টি আওয়ামী লীগ। অ্যান্টি আওয়ামী লীগের সম্মিলিত দল হলো বিএনপি। যাদের সঙ্গে জড়ো হয় মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মীয় মৌলবাদীরা। আওয়ামী লীগকে একা সবার বিরুদ্ধে লড়তে হয়। ১৯৮০ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন, সেই থেকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগ এখন দেশের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করা দল।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তারপর মাঝখানে এক মেয়াদ বিরতি, বহুল আলোচিত ওয়ান ইলেভেনের সরকারের পর ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত টানা চার মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ২০০৮ সালে ওয়ানইলেভেন থেকে সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। বিএনপি বিরোধী দল হয়। এরপর ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র সাতটি আসন পায়। একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়েই মূলত সবচেয়ে বেশি বিতর্ক। বলা হয় রাতের বেলা ব্যালট বাক্স ভরে যায়। আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রশাসনের যোগসাজশে রাতেই ভোট দিয়ে দেওয়া হয়। যদিও এর কোনো দালিলিক প্রমাণ হাজির করতে পারেনি বিএনপি। তবে মুখে মুখে বিষয়টি এতই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, ২০১৮-এর নির্বাচন মানেই রাতের ভোটের নির্বাচন। এর বিরুদ্ধে বিএনপি মাঠের আন্দোলনে নামে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হলেও বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানায়। তারা নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়, বাস ট্রেন পুড়িয়ে সহিংসতা করে। এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়। তারা নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয়।

বারবার নির্বাচন বর্জন করায় বিএনপির রাজনীতিই এখন প্রশ্নের মুখে। নির্বাচনে না আসায় দলটির ভবিষ্যৎ কী হবে—তা সময়ই বলে দেবে। ম্যাকিয়াভেলির ‘পাওয়ার পলিটিক্স’ তত্ত্ব যারা না বুঝবে, তারা ক্ষমতাহীনই থাকবে। টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। আর শেখ হাসিনাও টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেন। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না, টানা ক্ষমতায় থাকায় দলের মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে অনেকের আর্থিক দুর্নীতির লাগাম টানা যায়নি। প্রায় সব মন্ত্রী এমপির সম্পদ শতগুণ বেড়েছে। নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা দাখিল করা হয়েছে, তাতেই এই বিশাল সম্পদ অর্জনের তথ্য উঠে এসেছে। এটা এবার অস্বাভাবিক লেগেছে।

বিশেষ করে একজন মন্ত্রীর ‘হাজার কোটি’ টাকা অবৈধভাবে বিদেশ পাচার করেছেন। এমন ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। যিনি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দাখিল করতে বলেছিলেন। বলেছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ভূমিকায় থাকবেন। সেই মন্ত্রীই কি না ৫ বছর পর হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে পাচার করে দিলেন! এমন আরও অনেক মন্ত্রী-এমপির হলফনামায় সম্পদ বিবরণের চিত্র দেখে হতাশ হতে হয়েছে। আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুকন্যা বিশ্বাস করে যাকেই দায়িত্ব দিয়েছেন, তিনিই দায়িত্ব পেয়ে অকৃতজ্ঞ হয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। রাষ্ট্রের এত গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েও তারা সামান্যতম লোভও সামলাতে পারেননি। তাই এবার বঙ্গবন্ধুকন্যা তার মন্ত্রিসভায় যাদের স্থান দিয়েছেন, আশা করি তাদের সম্পদের বিবরণ সরকারের কেবিনেট ডিভিশনে জমা রাখবেন এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন। তাদের স্ত্রী, সন্তান, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কার কী আছে, তা জানাবেন। এটাই প্রত্যাশা। গত ১০ বছরের যাদের সম্পদ শতগুণ বেড়েছে, যারা বিদেশ সম্পদ পাচার করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকন্যার ওপর আস্থা রেখেছে। সবার প্রত্যাশা এবার তিনি এমন নজির স্থাপন করে যাবেন, যাতে বলতে পারে জাতির পিতা একটা জাতিকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, আর তার কন্যা একটা জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে গেছেন। শুরুতে বলেছিলাম ম্যাকিয়াভেলির কথা। বিএনপির রাজনীতি নির্বাচন বর্জনের চোরাবালিতে আটকে গেছে। পাওয়ার পলিটিক্সে নির্বাচন আর জনগণের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। উড়ে এসে জুড়ে বসার দিন শেষ। মানুষের সমস্যা চিহ্নিত করে মানুষের দোরগোড়ায় যেতে হবে। তা না করে কেউ এসে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে এই বিশ্বাস থেকে বের না হতে পারলে বিএনপির রাজনীতি আর উঠে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না।

লেখক: হেড অব নিউজ, চ্যানেল এস

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমরা কোন ব্যর্থ নির্বাচন চাচ্ছি না : জামায়াত আমির

তোফাজ্জলের খুনিরা যেন রেহাই না পায় : লায়ন ফারুক

ফিলিস্তিন নিয়ে সমন্বয়ক সারজিসের স্ট্যাটাস

ভাইরাল সেই সাইনবোর্ড নিয়ে যা জানা গেল

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহবায়ক কমিটি বিলুপ্ত

বৃষ্টি নিয়ে সুখবর

গণঅধিকার অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে খুঁটি হিসেবে কাজ করছে

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত

‘ভারতকে ছাড়া বাংলাদেশের পরিস্থিতি উন্নতি হবে না’

ইসরায়েলকে ছাড় দিচ্ছে না প্রতিরোধ যোদ্ধারা

১০

কয়রায় গণঅধিকার পরিষদের আনন্দ মিছিল 

১১

অবশেষে কমলো সোনার দাম

১২

ভারতে টাইগার রবির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ

১৩

যুক্তরাষ্ট্রে ঘূর্ণিঝড় হেলেনের ভয়াবহ তাণ্ডব

১৪

মামলার আসামি হলেই গ্রেপ্তার নয় : আইজিপি

১৫

বৈরুতে বিপাকে বাংলাদেশিরা, দ্রুত সরে যাওয়ার পরামর্শ

১৬

বিএনপি জনগণের ভালোবাসার ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় : নয়ন

১৭

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকারীদের বিচার দাবি ‘সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের’

১৮

আরব শেখদের লালসার শিকার ভারতের কুমারীরাও!

১৯

বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে গেল ৯৯ টন ইলিশ

২০
X