আলম রায়হান
প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৫২ এএম
আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:৫৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এখন কী করবে বিএনপি

এখন কী করবে বিএনপি

সংশয়-সংকট উপেক্ষা করে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান, এমপি ও মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি মাইলফলক ঘটনা। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার আছে ফুরফুরা মেজাজে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর গলায় বলছেন, ‘ক্ষমতায় আসতে অন্ধকার গলি খুঁজছে বিএনপি।’ নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ ধরনের নিশ্চিত খবর আছে। আবার এটি রাজনৈতিক কৌশলগত উচ্চারণও হতে পারে। সঙ্গে এ বক্তব্যের মধ্যে অন্যরকম বাস্তবতাও আছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘অন্ধকার গলি খুঁজছে।’ কিন্তু খুঁজলেই যে পাওয়া যাবে তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? দলটি কি এতদিন অন্ধকার গলি খোঁজেনি? নিশ্চয়ই খুঁজেছে। রাজনীতিতে অন্ধকার গলি খোঁজা নতুন কোনো ঘটনা নয়। আর বিএনপি ঘরানার দলগুলোর জন্য তো অন্ধকারে চলাই মূল প্রবণতা, মূল ধারা। এর সঙ্গে আরেকটি বাস্তবতা আছে। তা হচ্ছে—২০০৮ সালের নির্বাচনী ফলাফল এবং ধারাবাহিকভাবে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বেশ কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন বর্জনের পর নির্বাচনী রাজনীতিতে ভরসা করা বিএনপির জন্য খুবই কঠিন হয়ে গেছে বলে অনেকেই মনে করেন। এ প্রসঙ্গে বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, নির্বাচনে জনসমর্থন নিজের পক্ষে নিয়ে তা ভোটে রূপান্তরিত করা বেশ কৌশলের বিষয়। এটি বিষয়চর্চারও। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রায় ১৬ বছরের নির্বাচনী অনাভ্যাসে বিষয়টি বিএনপির জন্য বড় রকমের জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অনেকেরই ধারণা। অবশ্য এ অনাভ্যাসের বিষয়টি দলকে কতটা গ্রাস করেছে, তা পরীক্ষা করার জন্য অতি নিকটে উপজেলা নির্বাচন পরীক্ষা ক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। আবার এ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেও ক্ষমতায় যাওয়ার সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে অন্তত আরও পাঁচ বছর পথ চেয়ে থাকতে হবে। আর এ পাঁচ বছরে বিএনপি কী করবে এবং সরকারের বিরুদ্ধে কতটাই-বা কী করতে পারবে; গত ১৬ বছরেই-বা কী করতে পেরেছে। এসব নিয়ে দলের ভেতর যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনই আন্দোলন নিয়েও নানা প্রশ্ন জোরালো হয়েছে তৃণমূলে। বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, বর্জনে এখন পর্যন্ত কী অর্জন হয়েছে? আর শুধু প্রশ্ন করাই নয়, বিএনপির নেতাকর্মীরা যেন অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে গেছেন। গত ২৯ অক্টোবর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা কর্মসূচি চললেও বিএনপির নেতাকর্মীদের রাজধানীর রাজপথে খুব কমই দেখা গেছে। জামায়াত-শিবির স্টাইলে ঝটিকা মিছিল বা কিছু সময় অবস্থান করেই চলে গেছেন তারা। যেন এই আছে এই নেই। জেলা-উপজেলায় তারা যেন লাজুক পান্ডা। আর নির্বাচনের পর এ ধারা থেকেও বিএনপি নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে। এখন তারা নতুন করে কৌশল নির্ধারণের কথা ভাবছে এবং বলছে। যে বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে ড. আবদুল মঈন খানের সাম্প্রতিক বক্তব্যে। অবশ্য রাজনীতিতে প্রকাশ্য বক্তব্যই একমাত্র বিবেচ্য নয়। সবাই জানেন, রাজনীতিতে মুখে আর অন্তরের কথা এক হয় না। এরকম কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। বরং মুখে হাসি অন্তরে বিষ—এ হচ্ছে রাজনীতির একটি স্বীকৃত ধারা। আস্তিনের মধ্যে লুকানো থাকতে পারে বিষ মাখানো ছুরি। ইতিহাসে এর অনেক দৃষ্টান্ত আছে।

ঢাকায় গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের আগে বিএনপির তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে যে উচ্চাশা ও উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা ছিল, তাতে এখন প্রচণ্ড ভাটির টান স্পষ্ট। দলটির ফেসবুক পেইজের ভিডিওতে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ারের সংখ্যাও কমেছে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগেই। এখন শূন্যের ঘর ছুঁইছুঁই। যদিও এক বছর ধরে নেতারা বলে আসছিলেন, তাদের ‘চূড়ান্ত আন্দোলনে’ লক্ষ্য থাকবে ঢাকা। তবে হরতাল ও অবরোধের টানা কর্মসূচিতেও মিছিল চোখে পড়েছে কালেভদ্রে। আর মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের পরদিন ২৯ অক্টোবর থেকে টানা কর্মসূচি শুরুর পর দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশ কারাগারে, বাকিরা আত্মগোপনে। নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হয় তালাবন্ধ। দীর্ঘ সময় পর নিজ অফিসের বন্ধ তালা ভাঙার বিষয়টি এমন বীরদর্পে করা হয়েছে যেন একটি বিশাল কাজ করে ফেলেছে। এক সময় স্লোগান দেওয়া হতো, ‘জেলের তালা ভাঙব, উমুক ভাইকে আনব।’ এই স্লোগানের আদলেই হয়তো বিএনপি নিজের অফিসের তালা ভেঙেছে। কিন্তু এর কোনো প্রভাব পড়েনি রাজনীতিতে, বরং অনেকেরই হাসির উদ্রেক করেছে। আবার প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকেরই রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি মনে করিয়ে দিয়েছে, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে ও বন্ধু আমার! না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে..।’

আবার এর অর্থ এই নয় যে, বিএনপির বন্ধুর আগমনের অপেক্ষা একেবারে নিরর্থক। বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনৈতিক শক্তি মূলত দুটি। এক. ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী আওয়ামী লীগ। দুই. ৭১-এ পরাজিত এন্টি আওয়ামী লীগ ধারা। এই এন্টি ধারা ২০০৮ সাল থেকে শুধুই ব্যাকফুটে গেছে। কিন্তু চিরকালই যে ব্যাকফুটে থাকবে এমনটি মনে করা নিশ্চয়ই বাস্তবসম্মত নয়। হয়তো একসময় সামনে এসে দাঁড়াবে উন্মত্ত দানবের মতো। আর সেটি যদি আওয়ামী লীগের পক্ষে সামলানো সম্ভব নাও হয়, তাহলেও বিএনপির খুব বেশি খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ দানবের সহযাত্রী অথবা ক্রীড়নক হতে হলেও নিজস্ব কিছু শক্তির প্রয়োজন হয়। আওয়ামী লীগ সরকারকে উপড়ে ফেলার দানবীয় শক্তির সহযাত্রী হওয়ার শক্তি-সক্ষমতা কি বিএনপির এখন আর আছে? এটি গভীরভাবে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। স্মরণ করা যেতে পারে, নির্বাচন প্রতিহত করার নামে কয়েক দিনের টানা কর্মসূচির প্রভাব জনজীবনে থাকলেও তা সরকারকে চাপে ফেলার অবস্থায় নিতে পারেনি বিএনপি। অফিস-আদালত সবই চলেছে স্বাভাবিকভাবে। দূরের পথে যাত্রীবাহী বাস চলাচলে ব্যাঘাত ঘটলেও পণ্য সরবরাহ ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক। আর পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকলেই-বা সরকারে কী আসে যায়? দাম বাড়বে—এই তো! কিন্তু পণ্যের দাম বাড়াকে সরকার কি খুব একটা বিবেচনায় নেয়? নাকি বিব্রত হয়? প্রমাণিত সত্য, হয় না। এদিকে এবার ব্যবসায়ীদের দিক থেকেও রাজনৈতিক ‘সমঝোতার ডাক’ সেভাবে আসেনি। বরং তারা সিন্ডিকেট কাভারেজে অতি মুনাফার তালে ছিলেন। পাশাপাশি আগের বছরগুলোর মতো কূটনীতিপাড়ার তৎপরতাও খুব একটা সক্রিয় ছিল না। এ অবস্থায় বিএনপির তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে হতাশার এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের অক্ষমতার বিষয়টি স্পষ্ট বলেই মানছেন অনেকে। গত ৮ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে এর প্রতিধ্বনি করেছেন মেজর হাফিজ। তিনি বলেছিলেন, ‘সশস্ত্র প্রতিরোধের সামনে নিরস্ত্র ব্যক্তি কতটুকু করতে পারে?... আমি মনে করি বিএনপির এই নির্বাচনে যাওয়া উচিত।’ একই সময় একই মত ছিল সাধারণ কর্মী-সমর্থকদেরও। তাদের বিশ্লেষণ ছিল, ক্ষমতায় বাইরে ১৬ বছর থেকে নির্বাচন বয়কট কতটা ফল বয়ে আনবে। সরকারকে ফ্যাসিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত করে শুধু নির্বাচন বর্জনের কি সমাধান আসার কথা? নিশ্চয়ই না। গৃহীত কৌশলের বিকল্প থাকার প্রয়োজন ছিল। এবার দেখা গেছে, সরকারের ক্রাকডাউনে ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা সব আত্মগোপনে চলে গেলেন, অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এদিকে তৃণমূলের প্রতি বার্তাটা নিয়েও ধোঁয়াশা ছিল। বিএনপির এ বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও ছিল ‘ঝামেলায়’। ফলে দলটির শক্তিশালী অবস্থান থাকা বগুড়ায়ও দলটির নেতাকর্মীরা জোরালোভাবে কর্মসূচি পালন করতে পারেননি। তপশিল ঘোষণার দিন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এরপর তারা পিছু হটে। এদিকে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে পুলিশ সরে গেলেও নেতাকর্মীরা ভেড়েননি তালা ভাঙার আগ পর্যন্ত। এরপরও যারা যাচ্ছেন তারাও সতর্ক মৃগকুল, পেটের ভেতর শব্দেও দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। উল্লেখ্য, গত ২৮ অক্টোবর কাকরাইল ও বিজয়নগরে সংঘর্ষের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় আসামির সংখ্যা কয়েক হাজার। এতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সিংহভাগেরই নাম রয়েছে। তাদের মধ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মির্জা আব্বাসসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের বহু নেতাই গ্রেপ্তার হয়ে গেছেন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ‘আত্মগোপনে’ থেকে প্রতিদিন ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন করেছেন। যার কোনো প্রভাব পড়েনি রাজনীতি বা আন্দোলনে। এ ছিল তোতা পাখির কথার মতো রাজনীতিতে এক ধরনের বিনোদনের জোগান। প্রসঙ্গত, জনাব রিজভী যে আত্মগোপনে ছিলেন তা সরকারের জ্ঞাতেই ছিল।

বিএনপির এ হীনবল দশা শুধু সরকারের অ্যাগ্রেসিভ মনোভাবের কারণে নয়। অনেকেই মনে করেন, প্রতিষ্ঠাকালীন অবস্থা থেকে বিএনপি বিচ্যুতিও দলটির হীনবল হওয়ার অন্যতম কারণ। দলে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কমিটি বাণিজ্যের আকাশচুম্বী বিকাশ ঘটেছে। ত্যাগী নেতারা হয়েছেন নির্বাসিত। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, খুলনার নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সিলেটের আরিফুল হক চৌধুরী, বরিশালের মজিবর রহমান সরোয়ারের কথা। সামগ্রিক বিশ্লেষণে অনেকেই মনে করেন, রাজপথে বলপ্রয়োগ করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার সনাতনী আন্দোলনে বিএনপি সফল হওয়ার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। এ অবস্থায় বিএনপি প্রকৃত অর্থেই রাজনীতিতে পথহারা পথিকের দশায় পড়েছে। এখন দেখা যাক, কী করে বিএনপি।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জোড়া সেঞ্চুরিতে রেকর্ড জয় ভারতের

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রোগ্রামার শাহেদা মুস্তাফিজকে নিয়ে রাহিতুলের বই

বাপার সংবাদ সম্মেলন / ‘পরিবেশ রক্ষায় প্রতিবন্ধক আমলারা, বন্ধু হচ্ছে জনগণ’

সর্বক্ষেত্রে মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করুন : সাবেক এমপি হাবিব

জুলাই ঘোষণাপত্র ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার অবৈধ : ফরহাদ মজহার

ভ্যাট-ট্যাক্স বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিলের আহ্বান

ঢাকায় নাটোরবাসীর মিলনমেলা শুক্রবার

সোনারগাঁয়ে শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব

বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ সংবিধান সংস্কার কমিশনের

পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন মোখলেছুর রহমান

১০

শেখ পরিবার সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ : দুদু 

১১

শীতে বাড়ছে ডায়রিয়া, ৮৫ শতাংশ রোগীই শিশু

১২

এসএমসি’র ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে লোগো উন্মোচন 

১৩

৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে ফের ভোটগ্রহণের প্রস্তাব

১৪

‘একদম চুপ, কান ফাটাইয়া ফেলমু’, অধ্যক্ষকে জামায়াত কর্মী

১৫

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন

১৬

বগুড়ায় নাশকতা মামলায় যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৭

বিয়েতে অস্বীকৃতি, বাবার গুলিতে মেয়ে নিহত

১৮

সাত কৃষককে ধরে নিয়ে গেল সন্ত্রাসীরা, মুক্তিপণ দাবি

১৯

ছাগলকাণ্ড : সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রিমান্ডে

২০
X