স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম এবং ২০২৪-এ অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন, এ পর্যন্ত ১২টি। কিন্তু কোনো নির্বাচনই অভিযোগের বেড়াজাল অতিক্রম করতে পারেনি। প্রতিটি সংসদ নির্বাচনই অভিযোগে ভারাক্রান্ত। এর মধ্যে আবার মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারার ক্ষেত্রেও আমাদের সংসদগুলোর রয়েছে অনন্য রেকর্ড। ’৭৩ সংসদের অবসান হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংসতার মাধ্যমে। এদিকে এরশাদ আমলে ১৯৮৬ ও ’৮৮ সংসদের অবসান হয়েছে বিরোধী দলের চাপে। আর খালেদা জিয়ার ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে গঠিত সংসদের অকালমৃত্যু হয়েছে অনেকটা আঁতুরঘরেই। ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদের মেয়াদ পূর্তিই একটি মহাফুর্তির বিষয়। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর, একেবারে ডুমুরের ফুল! এ কাজ একবারই করেছিলেন শেখ হাসিনা ’৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের মেয়াদ শেষে। এ ছাড়া সবকটি ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে রক্তের পিচ্ছিল পথে। কোনোটা ক্ষমতার মসনদে, কোনোটা আবার রাজপথে। আর ইউর সঙ্গে কিউর মতো প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে লেপ্টে আছে অভিযোগের কলঙ্ক। সময় যত গড়িয়েছে, অভিযোগের মাত্রা ততই বেড়েছে। নির্বাচনে পরাজিত দল নানান অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যান করেছে। এদিকে নানান অনিয়ম থাকার পরও ১৯৭৩ সালে নির্বাচনকে নির্বাচন বলা চলে। এরপর ১৯৯১ সালের আগপর্যন্ত নির্বাচনগুলো ছিল সামরিক শাসকের ক্ষমতায় থাকার মোড়ক। এই ধারার বাঁক নেয় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে।
এরশাদ সরকারের পতনের পর পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত এ নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল। খুলনায় এক নির্বাচনী সমাবেশে শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে দৈনিক ইত্তেফাক শিরোনাম করেছিল—‘দেশে-বিদেশে রব উঠিয়াছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাইবে।’ কিন্তু এমনটি ঘটেনি। উল্টো বিএনপি বিজয়ী হয় এবং জামায়াতের সমর্থন নিয়ে ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর পরই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘অগণতান্ত্রিক শক্তি সূক্ষ্ম কারচুপি করেছে।’ যদিও নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ নিয়ে দলটির তৎকালীন নেতা ড. কামাল হোসেন দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় দেওয়া এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘অতিবিশ্বাস, আত্মম্ভরিতা এবং কর্মবিমুখতার কারণে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় হয়েছে। নির্বাচনের অনেক আগেই বিজয় সম্পর্কে তারা অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। সেজন্য নেতাকর্মীরা নিশ্চিত বিজয়ের আগাম গর্বে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন। এ ছাড়া ডানপন্থি ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো আওয়ামী লীগকে ভারতের সেবাদাস এবং ধর্মের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে যেভাবে অপপ্রচার চালিয়েছে, তার বিপক্ষে আওয়ামী লীগের প্রচারণা বরাবরই দুর্বল ছিল।’ এটি বাস্তব। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল আরও অনেক খেলা। এর মধ্যে প্রধান হলো, ভোটের ব্যালটে নৌকা প্রতীকের নিচেই নৌকার আদলে বিএনপির মহাসচিব থাকাকালে বহিষ্কৃত ওবায়দুর রহমানের দলের জাহাজ প্রতীক। যাকে বড় নৌকা মনে করে অনেকেই সিল দিয়েছেন।
১৯৯১ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করেন খালেদা জিয়া। যুক্তি ছিল, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো ১৯৯৪ সাল থেকে প্রায় আড়াই বছর আন্দোলন করেছে। ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা সেই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য। ৩০০ আসনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৫০ আসনে। ৪৬টি আসনে বিএনপির প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান। নির্বাচনের দিন বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় অন্তত ১০ জন নিহত হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পরও বিরোধী দলগুলোর জোরালো আন্দোলন অব্যাহত থাকে। এরপর একই বছর ১২ জুন অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগে ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন এবং ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। এর আগে বহুল আলোচিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল সংসদে পাস হয় ২৬ মার্চ ভোররাতে। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় মেনে নেয়নি বিএনপি। এর মাধ্যমে ২১ বছর পর ক্ষমতার মসনদে ফিরে আসে আওয়ামী লীগ এবং প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
আসে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ঘটনাবহুল অধ্যায়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জোটবদ্ধ হয়ে এ নির্বাচনে অংশ নেয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হয়ে মেয়াদ শেষে সংবিধান অনুসারে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আওয়ামী লীগ সরকার। তখন প্রধান উপদেষ্টা পদে আসীন হন তৎকালীন সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান। প্রধান উপদেষ্টার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো একটি নির্বাচিত সরকার হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করে সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে দায়িত্ব অর্পণ করতে পেরে আমি আনন্দিত।’ কিন্তু পরে নির্বাচনের প্রচারে শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, ‘বিএনপি যা বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাই করে।’ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে পরাজয়ের পর ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘স্থূল কারচুপি করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। জনগণ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে, আমার মেনে নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।’ এদিকে সংসদে যোগ না দেওয়ার ব্যাপারে বেশ অনড় ছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, ‘কারচুপির নির্বাচন বাতিল এবং জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম চলবে।’ আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করলেও, সঙ্গে সঙ্গে সংসদে যোগ দেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের ‘সন্ত্রাসীরা’ সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘুদের হত্যা করছে।
২০০১ সালে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকারের মেয়াদ শেষের দিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে সংবিধানে একটি বড় সংশোধনী আনে বিএনপি সরকার। অভিযোগ রয়েছে, নিজেদের পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে রেখে নির্বাচনের সময় সুবিধা আদায়ের জন্য এ কাজ করেছিল বিএনপি সরকার। এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। সংঘাতময় এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাজনীতিতে তৃতীয়পক্ষ হস্তক্ষেপ করে। প্রতিষ্ঠিত হয় সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। চলে দুই নেত্রী মাইনাস ফর্মুলা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ—উভয় দলকে ভেঙে টুকরো করার চেষ্টা হয়। কিন্তু এ উদ্যোগ সফল হয়নি। বরং দুই বছরের মধ্যে ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচন দিয়ে ‘নিরাপদ নির্গমনের’ পথ বেছে নেয় ফকরুদ্দীন-মইনউদ্দীনের সরকার। আসে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি না, সেটি নিয়ে গোড়া থেকেই সন্দেহ শুরু হয়। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়ার শর্ত ছিল, তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের মুক্তি এবং বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এ নিয়ে তীব্র দরকষাকষি চলে দীর্ঘ সময়। একপর্যায়ে সমঝোতা হয় উভয়পক্ষের মধ্যে। এদিকে নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রার্থী বাছাই, জোটের শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি, নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন—এসব কিছুর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বেশ গোছাল ছিল। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় ২৩০, বিএনপি পায় মাত্র ৩০টি আসন। সে নির্বাচনে দল হিসেবে সবচেয়ে ভরাডুবি হয়েছিল জামায়াতের। এ নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পারেনি বিএনপি। দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলা হয়।
২০১৪ ও ’১৮ সালের নির্বাচনের অভিযোগের পাহাড় বিরাজমান থাকাকালেই আসে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গ। এ নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশে অনেক পানি ঘোলা করা হয়েছে। কিন্তু এই ঘোলা পানিতে এখন পর্যন্ত অন্ধকারের শক্তি শিকার করতে পারেনি। এদিকে বিএনপি নির্বাচন থেকে দূরে থাকা এবং প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। এজন্য দলটির সাংগঠনিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। এরপরও হাল ছাড়েনি। ধারণা ছিল, বিদেশি শক্তি বিশেষ করে আমেরিকা ‘একটা কিছু’ করবে। র্যাবের ওপর স্যাংশন এবং ভিসা নীতি ঘোষণাসহ মৃদু ভূমিকম্পের মতো কিছু পদক্ষেপ আমেরিকা নিয়েছেও। কিন্তু তা শেখ হাসিনাকে মোটেই টলাতে পারেনি। এরপরও আমেরিকার দিকে চাতক পাখি হয়ে আশার ভেলা ভাসিয়ে রেখেছে বিএনপি ও সমমনারা। কিন্তু এ ভেলা যে শুধুই খেলা, তা প্রমাণিত হয়েছে ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান, ৯ তারিখ নির্বাচিতদের গেজেট প্রকাশ, ১০ জানুয়ারি নতুন এমপিদের শপথ গ্রহণ এবং ১১ জানুয়ারি মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের ঘটনায়। নানান আশঙ্কা ও উদ্বেগ কাটিয়ে ৭ থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত অকল্পনীয় সাফল্য দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সংসদ নির্বাচন সমালোচনার বাইরে রাখা যায়নি। এ নির্বাচনের গুণগান যেমন করা হয়েছে, তেমনই নানান অভিযোগও তোলা হয়েছে দেশ-বিদেশে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এ নির্বাচন নিয়ে আমজনতার অভিযোগও কিন্তু কম নয়। নৌকার প্রার্থীর শক্তি প্রয়োগ এবং ভোটকেন্দ্র দখলের অনেক অভিযোগ রয়েছে। আবার, কোনো কোনো প্রার্থীকে পাস করানো এবং কাউকে ফেল করানোর জন্য ‘ওপরের’ ব্লুপ্রিন্ট কার্যকর করার ঘটনাও ঘটেছে কারও কারও বিবেচনায়। পাশাপাশি অহমের অনেক ‘বিশাল’ নেতাও কলাগাছের মতো ধরাশায়ী হয়েছেন। এই ‘ধরাশায়ী’ হওয়ার বিষয়টি রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনবে বলে মনে করেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক