বাংলাদেশ তরুণের দেশ। বর্তমানে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। এ তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশের রূপকার। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের কান্ডারি। তারুণ্য জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। যে সময়ে একজন তরুণ নিজেকে গড়তে শিখে, যে সময়ে নিজেকে তৈরি করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সুবর্ণ সময় পার করে। তারুণ্যে অনেক স্বপ্ন ও আশা থাকে। এটি উৎসাহের সময়, আত্মবিশ্বাসের উন্নতির সময়। যদি তারুণ্যের এই সময়ে সে কোনো ভুল কাজ বা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম না হয় তবে, তার সারাটি জীবন মূল্যহীন হয়, বৃথা হয়ে যায়। তাই এ সময়ে যাতে তরুণরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং ভুল পথে পা না বাড়ায়, সেজন্য একটা সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যেন সে জানতে পারে কোন পথটি সঠিক, কোন পথ দিয়ে এগিয়ে যাবে এবং কোন পথটিকে অগ্রাধিকার দেবে আর কোন পথকে এড়িয়ে চলতে হবে। অর্থাৎ ভালো-মন্দ বিচারের ভার নিজেকেই নিতে হবে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম তরুণদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘ভিন্নভাবে চিন্তা করার ও উদ্ভাবনের সাহস থাকতে হবে, অপরিচিত পথে চলার ও অসম্ভব জিনিস আবিষ্কারের সাহস থাকতে হবে এবং সমস্যাকে জয় করে সফল হতে হবে। এসব মহান গুণের দ্বারা তরুণদের চালিত হতে হবে। তরুণ প্রজন্মের প্রতি এই আমার বার্তা।’
তারুণ্যই জীবনকে মহাজীবনের দিকে পৌঁছে দেয়। তাই আমাদের তরুণদের ভিন্নভাবে চিন্তা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ তরুণ আধিক্য জনগোষ্ঠী একই বয়সে থাকবে না। কালের পরিক্রমায় বার্ধক্য আসবে এবং বিরাট একটা অংশের জনগণ কর্মক্ষমতা হারাবে। প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সেটাই হয়। কিন্তু বাধ সাধবে যদি এ বিপুল জনগণ জাতীয় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বোঝা এই অর্থে যে, তরুণ বয়সে নানাবিধ কু-অভ্যাস, অস্বাস্থ্যকর ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মাধ্যমে তার যদি নিজের সুস্বাস্থ্য নামক সম্পদকে অবহেলায় জর্জরিত করে থাকে তবে, বৃদ্ধ বয়সে পরিবার ও রাষ্ট্রের বোঝা হওয়া ছাড়া আর কোনো সুফলে আসবে না তারা। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে, দেশে অসংক্রামক রোগের আগ্রাসনে। বর্তমানে ৬৭ শতাংশ মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে। রোগ, চিকিৎসায় অসাধ্য ব্যয়, দরিদ্রতা সেই অবহেলার ফসল। সুতরাং এমন পরিস্থিতি বদলাতে দীর্ঘমেয়াদে পদক্ষেপ হিসেবে তরুণদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। তারুণ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে তাদের সার্বিক সম্পৃক্ততা ও সুফল নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু শঙ্কা জেগেছে, আদৌ আমরা তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারব কি না! কারণ তামাক ও মাদকের আগ্রাসনে তরুণরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে।
বৈশ্বিকভাবে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে, তরুণ বয়সেই বেশিরভাগ তরুণ ছেলেমেয়ে কৌতূহলবশত বা পারিপার্শ্বিক প্ররোচনায় ভয়াবহ মাদক ও ধূমপানের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। হয়তোবা তার উপলক্ষ থাকে, কোনো একটি বিশেষ দিন বা বিশেষ অনুষ্ঠান। হয়তো সে ভাবে, আজ শুধু আনন্দ, ফুর্তি করব। কাল থেকে আর তামাক/মাদক খাব না, তওবা করব। আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা অসংখ্য নেতিবাচক নজির তৈরি করেছে। মূলত, মাদক ও ধূমপানের নেশা এমনই ক্ষতিকর একটি নেশা, যেটা একবার নিলে বারবার নিতে ইচ্ছে করে। কৌতূহলবশত কিংবা প্ররোচনায় যে তরুণটি মাদক ও ধূমপানের জালে জড়িয়ে পড়ছে, তাদের ফেরানো কঠিন। সুতরাং তরুণদের এসব ক্ষতিকর নেশাকে ‘না’ বলতে হবে।
আমাদের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন দোরগোড়ায়। আসন্ন নির্বাচনেও ‘এক্স ফ্যাক্টর’ আমাদের তরুণরা। তাদের ভোটেই চূড়ান্ত হবে আগামীর জনপ্রতিনিধি। সুতরাং এখানেও সঠিক সিদ্ধান্তের মুনশিয়ানা দেখতে আপামর জনগণ বিশেষত আমাদের মতো জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা উন্মুখ হয়ে আছে। পক্ষান্তরে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সর্বদলীয় প্রার্থীদের কাছেও আমাদের প্রত্যাশার শেষ নেই। উন্নয়ন সবাই প্রত্যাশা করে। কিন্তু কোনো উন্নয়ন জনগণকে পাশ কাটিয়ে হতে পারে না। বিশেষ করে তরুণদের উপেক্ষা করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীরা তাদের প্রচারণায় তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তি প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন, যা অত্যন্ত ভালো দিক। এর সঙ্গে ধূমপান ও মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে জনপ্রতিনিধিদের অঙ্গীকার প্রয়োজন, যা হতে পারে সময়ের শুভ উদ্যোগ ও অঙ্গীকার। তাদের উচিত হবে এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কাজ করে যাওয়া। পাশাপাশি নির্বাচনের প্রচারণায় কোনোভাবেই যেন তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার না হয়, সেটা নিশ্চিত করা। কারণ বাংলাদেশে মাদকাসক্তি পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেজনক! সামাজিক অবক্ষয়সহ প্রায় সব অপরাধের পেছনে অন্যতম প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে মাদক। গণমাধ্যমের প্রকাশিত তথ্যমতে, দেশে প্রায় এক কোটি মানুষ মাদকাসক্ত রয়েছে যাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ তরুণ-কিশোর। অন্যদিকে মাদকাসক্তির বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে ধূমপান। ধূমপান হচ্ছে মাদকের রাজ্যে প্রবেশের মূল দরজা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে ৬০ ভাগ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে তারা প্রথমে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়, তারপর মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীকালে তারা গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেনসহ বিভিন্ন মরণনেশায় আসক্ত হয়। বর্তমানে কিশোর-তরুণরা বন্ধুদের প্ররোচনায় ধূমপান শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে এর একটি বিরাট অংশ মাদক সেবন ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজমান এমন নেতিবাচক অবস্থা আরও উসকে দিচ্ছে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলো। বলা যায়, আগুনে ঘি ঢালছে! সিগারেট কোম্পানিগুলো কিশোর-তরুণদের যাতায়াত বেশি, এমন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ‘ধূমপানের স্থান’ তৈরি করে দিচ্ছে। যেখানে ধূমপান থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাদকও সেবন করা হয়। তরুণদের মধ্যে থেকে সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ উঠে যাচ্ছে। পাশাপাশি এসব স্থানে পরিবার-পরিজন নিয়ে উপভোগ্য সময় কাটাতে আসা মানুষজন ভয়াবহ স্বাস্থ্যগত ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ধূমপানের আখড়া তৈরি করে ব্যবসা প্রসার করাই মূল উদ্দেশ্য সিগারেট কোম্পানির। গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেট কোম্পানিগুলো ‘স্মোকিং জোন’ তৈরিতে অবস্থান অনুযায়ী রেস্টুরেন্ট মালিককে এককালীন ৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদ অর্থ সুবিধা দেয়। এসব স্থানে এবং খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রে তামাক কোম্পানির বিজ্ঞাপনসামগ্রী প্রদর্শন করা হচ্ছে, যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। নাটক, সিনেমাতেও তরুণদের আইডল, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা নায়ক, নায়িকাদের দ্বারা ধূমপানে উৎসাহিত করে এমন দৃশ্য প্রচার করা হচ্ছে। অন্যদিকে, সিগারেট কোম্পানিগুলোর বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার বাড়ছে। যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে সেটা রীতিমতো উদ্বেগজনক! সুতরাং বসে থাকার সময় নেই। তরুণদের রক্ষায় কাজ করতে হবে।
কবি হেলাল হাফিজের বিখ্যাত উক্তি—‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার।’ এ যুদ্ধ বলতে কারও বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কোনো পদক্ষেপ বা কারও ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা নয়। এ যুদ্ধ মাদক ও তামাকের নেশায় নীল না হয়ে তরুণরা নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা, নিজেকে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ। কারণ প্রধানমন্ত্রী আমাদের যুবসমাজের ওপর খুবই আশাবাদী। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নতি করতে চান। শুধু তিনি কেন, যে সরকারই আসুক না কেন, ক্ষমতার রদবদলের পরিক্রমায় সবার শক্তি হবে আগামী প্রজন্ম অর্থাৎ শিশু-কিশোর, তরুণরা। বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে। অপেক্ষা উন্নত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ দেখার। আমরা আশাবাদী তারুণ্যের জোয়ারে সেই মাহেন্দ্রক্ষণও আসবে। তারুণ্যের জয় হবে, আমরা দেখে যেতে পারব সেই দিনটি। সেজন্য তারুণ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। জনপ্রতিনিধিরা আগামী পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব নিতে চলেছেন। তাদের অঙ্গীকার ও বাস্তবতার কেন্দ্রবিন্দু মিলে যাক।
দেশের মাদক নির্মূলে ও তামাক নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশ থেকে তামাক নির্মূলের সাহসী ঘোষণা দিয়েছেন। মাদকের বিরুদ্ধেও তিনি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছেন। এসব পদক্ষেপ হলো, উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করার যে রসদ সেটাকে সমুন্নত রাখা। অর্থাৎ তরুণদের সুরক্ষিত রাখা, যেদিকে তিনি সদাতৎপর। আগামীর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন করতে হলে তরুণদের মধ্যে ধূমপান, মাদকাসক্তিসহ ক্ষতিকর আচার-আচরণ প্রতিরোধে দলমত নির্বিশেষে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আগামী প্রজন্মকে রক্ষার জন্য দায়িত্ব আমার, আপনার, আমাদের সবার। নতুন বছরে নতুন সরকার এদিকটায় সুনজর দেবে, এ প্রত্যাশা করি। একই সঙ্গে নির্বাচনে তরুণদের ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
লেখক: অধ্যাপক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা
একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র