শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
এম এ মান্নান
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৩, ০১:৫২ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাক্ষাৎকারে পরিকল্পনামন্ত্রী

মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ নিয়ে সরকার ভীত নয়

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। ছবি : সংগৃহীত
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। ছবি : সংগৃহীত

এম এ মান্নান বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের মন্ত্রী ও সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য। তিনি ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সিএসপি ক্যাডারে যোগদান করেন। পর্যায়ক্রমে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে পদোন্নতি পেয়ে সরকারের বিভিন্ন পদে নিয়োজিত ছিলেন। ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক এবং এনজিও ব্যুরোতে মহাপরিচালক। ২০০৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে সুনামগঞ্জ-৩ আসনে জয়ী হয়ে কয়েকটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ফের একই আসন থেকে বিজয়ী হয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, মেগাপ্রকল্প, প্রকল্প ব্যয় ও চুরি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা এবং পরিকল্পনা কমিশনের ক্ষমতায়নসহ নানা বিষয় নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

কালবেলা : বর্তমান সরকারের সময়কালে বেশ কিছু মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি সম্পন্ন হয়েছে আর কিছু চলমান। মেগাপ্রকল্পগুলো গ্রহণে কী উদ্দেশ্য ছিল? সেটি কতটুকু পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন?

এম এ মান্নান : আর্থিক বিচারে ফলাফল কী হয়েছে সেটি আমি বলতে পারব না। কারণ এ বিষয়ে আমি গবেষক নই। তবে পদ্মা সেতুর কথাই ধরা যাক। আমাদের মাতৃভূমিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে রেখেছিল বিশাল পদ্মা নদী। যমুনা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে আমরা উত্তরবঙ্গকে মোটামুটি যুক্ত করতে পেরেছিলাম। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গ বাইরে থেকে গিয়েছিল। দক্ষিণবঙ্গকে সেতুর মাধ্যমে যুক্ত করা যাবে, এটি সাধারণ মানুষের চিন্তাতেও ছিল না। এটা আমরা করতে পেরেছি। এর পেছনে আমাদের দুটো উদ্দেশ্য ছিল—এক. দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলকে অর্থনীতির মূল ধারায় সংযুক্ত করা এবং জাতীয় অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজসহ সবকিছুর গতিশীলতা সৃষ্টি করা। আমরা এক পরিবার। ভালো যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছিল প্রচুর। তাতে রাজনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছিল। আর দ্বিতীয়টি হলো—পদ্মা সেতুর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, যোগাযোগ আরও সুদৃঢ় হয়েছে, যার ফল আমরা এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছি। মেগাপ্রকল্পের জন্য প্রযুক্তি এবং অর্থের প্রয়োজন ছিল। এ ক্ষেত্রে সরকার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে।

পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে অর্থের চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল প্রযুক্তির। প্রচণ্ড খরস্রোতা, ভয়ংকর নদী যাকে কীর্তিনাশা নামে ডাকা হয়, তাকে নিয়ন্ত্রণে এনে কাজ করতে হবে। খুবই কঠিন কাজ। পৃথিবীর তাবৎ নদী বিজ্ঞানীরা বলেন, এ নদীর চরিত্র আলাদা। পদ্মা নদী আয়তনে বা প্রশস্তে ছোট হলেও এর তলদেশ স্থিতিশীল না। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করব। এ বিষয়ে কথা হয় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে। তারা জানাল সেতু নির্মাণে অর্থ ও কারিগরি সহায়তা দেবে। ডিজাইনও চূড়ান্ত হয়ে যায়। আমরা যখনই টাকার বিষয়ে আলোচনা করব, তখন নানা অজুহাত দেখানো শুরু করল তারা। বিশেষ করে দুর্নীতির অভিযোগ এনে অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক সরে গেল। তারা বলল, এখানে দুর্নীতি হচ্ছে বা হবে। অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করব। প্রধানমন্ত্রীর জিদের কারণেই পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। শুধু তাই নয়, এটি দিয়ে আমরা বিশ্ববাসীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, আমরাও বড় কাজ করতে পারি। সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি, নদীর তলদেশে টানেল তৈরি হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে হাতে নেওয়া রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প আমরাই সাহসের সঙ্গে বাস্তবায়ন করছি। মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, ঢাকা-কক্সবাজার রেললাইন, বিআরটি ইত্যাদি বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ আমরাই হাতে নিয়েছি। এগুলো সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা পরিবর্তন হয়ে যাবে, গতি আরও বাড়বে।

কালবেলা : অনেকেই বলছেন ২০২৪ সাল থেকে মেগাপ্রকল্পের ঋণের অর্থ শোধ করতে গিয়ে বিপদে পড়বে সরকার। এ বিষয়ে আপনারা কোনো চাপবোধ করছেন কি?

এম এ মান্নান : না, আমরা এ বিষয়ে কোনো চাপবোধ করছি না। সরকার কি খরচ চালাতে পারছে না? সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারছে না? নতুন প্রকল্প হাতে নিতে পারছি না? এমন কোনো পরিস্থিতি দেশে নেই। আমাদের রাজস্ব ব্যয়, উন্নয়ন ব্যয় বাড়ছে। ২০২৩-২৪ বছরে আমরা গত বছরের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়েছি। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়ার ফলে সরকার অর্থায়নসংক্রান্ত কোনো চাপে নেই। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি আমরা আরও প্রকল্প পাস করেছি। বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে কখনো ব্যর্থ হয়নি। প্রতিবছর বাজেটের বড় একটা অংশ থাকে অতীতের ঋণ পরিশোধের জন্য। এ বছরের বাজেটেও বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ঋণ পরিশোধের; ভবিষ্যতেও থাকবে। মেগাপ্রকল্প থেকে আমাদের আয়ও আসছে। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু থেকে টোলবাবদ অর্থ পেয়েছি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করা হয়েছে। মেট্রোরেল পুরোপুরি চালু না হলেও কিছু আয় আসছে। মেট্রোরেল চলতি বছরের শেষ নাগাদ যখন কমলাপুর পর্যন্ত যাওয়া-আসা শুরু করবে, তখন আয়ও বেড়ে যাবে। শুধু অর্থের দিক দেখলে হবে না, জনকল্যাণের দিকটিও দেখতে হবে। মানুষের আয় বাড়ছে। আমাদের সরকার হয়তো আয় করছে এক টাকা কিন্তু জনগণ এটি ব্যবহার করে পাঁচ টাকা আয় করছে। মানুষের চলাচল, ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে। নিট আয়কে দুইভাবে দেখতে হবে। এক. চলমান আয় এবং সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক আয়। দুই. অর্থনৈতিক আয়, যাতে প্রকল্পগুলো লাভজনক হয়। পদ্মা সেতু থেকে সরকার আয় করছে হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পরোক্ষভাবে দক্ষিণ বাংলার মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, আরও আসবে। সেই হিসাব করলে আমরা অনেক বেশি সুবিধা পাব। মেগাপ্রকল্পের ঋণ পরিশোধ নিয়ে সরকার ভীত নয়।

কালবেলা : প্রকল্পগুলোর ব্যয় নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্বের গড় থেকেও বাংলাদেশে প্রকল্প ব্যয় বেশি। প্রকল্প ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না কেন?

এম এ মান্নান : আমি কস্ট ইকোনমিস্ট নই। তাই সেতু নির্মাণের ব্যয় হিসাব করার জ্ঞান আমার নেই। তবে এটুকু বলতে পারি, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করে না। নৈতিক অবস্থানের পাশাপাশি জ্ঞানেরও একটি অবস্থান রয়েছে। আমরা ধরে নিই সরকারে যেসব ব্যক্তি বা সংস্থা কাজ করছেন তারা রেসপনসেবল (দায়িত্বশীল), তারা পেশাজীবী এবং তারা আমাদের উত্তম সেবাই দিচ্ছেন। নানা কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাব এসব প্রকল্পে পড়ে। এ ছাড়া বিদেশি কনসালটেশন রয়েছেন, তাদের আসা-যাওয়ার খরচ বেড়েছে। আমাদের এখানে জমির দাম বেশি। কাজ শুরু করার পর নতুন অনেক কিছু সংযোজন হয়, যার ফলে ব্যয় বেড়ে যায়। এটা মানতেই হবে, আমরা একটা জীবন্ত ব্যবস্থার মধ্যে বেঁচে আছি, প্রতিনিয়ত সমন্বয় করে চলতে হবে। এখানে আপনি একদম স্থবির অবস্থা আশা করবেন, এটা ঠিক নয়।

কালবেলা : অনেক দেশ থেকে বাংলাদেশে প্রকল্প ব্যয় বেশি, এর কারণ কী?

এম এ মান্নান : প্রকল্পের একটি অনুষঙ্গ হলো জমি। যে প্রকল্পই হাতে নিই না কেন, তার জন্য প্রয়োজন জায়গা। যেটা বাংলাদেশে অত্যন্ত কম। ঘনবসতি হওয়ায় এখানকার জমির দাম অনেক বেশি। ভারতে মাথাপিছু জমির পরিমাণ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং ভারতে প্রকল্প ব্যয় কম। চীন-ভিয়েতনামও কম ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। চীন ও ভিয়েতনামে জমির মালিক সরকার। দেশগুলোর সরকার সরাসরি গিয়ে রেললাইন নির্মাণ শুরু করে, কাউকে জিজ্ঞাসাও করে না। কোনো ক্ষতিপূরণ দেয় না কিন্তু আমরা ক্ষতিপূরণ দিই, পুনর্বাসন করি। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখারও খরচ দেওয়া হয়। সবকিছু যোগ করলে স্বাভাবিকভাবেই খরচ বেশি হয়। জমির পরিমাণ কম থাকায় সড়ক বা কোনো অবকাঠামো নির্মাণের সময় সেখানে কিছু স্থাপনা পড়ে যায়। বিশেষ করে ধর্মীয় স্থাপনাগুলো অনেক বেশি আবেগের। এগুলো সমন্বয় করতে গিয়ে ব্যয় বেড়ে যায়।

কালবেলা : গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যও ভালো। কিন্তু কর-জিডিপি রেশিও বাড়ছে না কেন?

এম এ মান্নান : কর-জিডিপি হ্রাসের অন্যতম কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য শ্লথ হওয়া। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো তুলনামূলকভাবে কম আয় করেছে। ব্যবসায়ীরা কম আয় করায় সরকারের আয়ও আনুপাতিক হারে কম হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি অনেক সময় তরতরিয়ে বাড়ছে, আনুপাতিক হারে; অ্যাবসুলেট টার্মে নয়। কিন্তু কর বাড়ছে না। এবার দেশে আমদানি কম হয়েছে। এ কারণে শুল্ক আয় কম হয়েছে। নতুন ভ্যাট আইন এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়নি। তবে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমার ধারণা, ভ্যাটের নামে যে টাকা আদায় করা হয়, তার এক-তৃতীয়াংশ আমরা পাই না। যারা আদায় করেন তারা এটা রেখে দেন। অনেক সময় আদায় করা হয় না, ক্রেতাকে ছাড় দিয়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয়ে আমাদের আরও উন্নতি করতে হবে। দেশের মানুষের আয়কর দেওয়ার অভ্যাস ছিল না। আবার আর্থিকভাবে যে খুব একটা আরামে ছিলাম সেটাও নয়। এখনো আমাদের কৃষি খাত আয়করমুক্ত। আমাদের কৃষি এখন ভালো করছে। তবে পুরাতন সেই ঐতিহ্য এখনো রয়ে গেছে। কর না দিয়েও অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে সচেতনতা বেড়েছে, আমরা শিগগিরই এ খাতে হাত দেব।

কালবেলা : বাংলাদেশের কিছু পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জবাবদ সরকারকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এটি কি ভ্রান্ত পরিকল্পনার ফল?

এম এ মান্নান : এটি একটা আইনি বিষয়। বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের সবকিছু মরে যাচ্ছিল। দ্রুত বিদ্যুৎ চাই। জেনে-বুঝে চুক্তিতে সই করা হয়েছে। এখন আইনগতভাবে ওই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা যাচ্ছে না। একবারে লাখো-কোটি টাকা না দিয়ে, ধীরে ধীরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে যেতে হবে। এটা ভালো ব্যবস্থা নয়। একে কেউ ভালো ব্যবস্থা বলেননি। ঠেকায় পড়ে এ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সরকার ধীরে ধীরে সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে। এর একটা সীমা রয়েছে, আবহমানকাল চার্জব্যবস্থা চলবে না। চুক্তিতে সময় নির্দিষ্ট করা আছে। আমরা একটা বিশ্বাসযোগ্য সরকার হিসেবে চুক্তিতে বরখেলাপ করতে পারি না। তাহলে আমরা পৃথিবীর কোথাও মুখ দেখাতে পারব না।

কালবেলা : আপনি পরিকল্পনামন্ত্রী থাকা অবস্থায় কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন পরিকল্পনা বিভাগকে গতিশীল ও স্বচ্ছ করতে। এ ক্ষেত্রে কতটা অগ্রগতি হয়েছে?

এম এ মান্নান : আমার সেই উদ্দেশ্য এখনো আছে। এ উদ্দেশ্য শুধু আমার একার নয়, পুরো কমিশনের। তদারকি বাড়াতে পরিকল্পনা কমিশনের বিকেন্দ্রীয়করণ করতে চেয়েছিলাম। লক্ষ্য থেকে এখনো পিছিয়ে যায়নি, নীতিগত কারণে অপেক্ষা করছি। বিভাগে মন্ত্রণালয়ের কোনো অফিস হতে পারে না। আগে আমাকে অধিদপ্তর বানাতে হবে ঢাকায়, তারপর বিভাজন করা যাবে; বিষয়টা টেকনিক্যাল। আমরা কাজ করছি। আমার নিজস্ব একটা প্রকল্প ছিল, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান রিসার্চ ইনস্টিটিউট। পরিসংখ্যানের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। এখানে আমাদের প্রশিক্ষিত লোকবলের প্রয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি একটা ফ্লোরও দিয়েছেন। একে ভবনভিত্তিক কোনো ইনস্টিটিউট নয়, গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।

কালবেলা : ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করবে বাংলাদেশ। সে সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পরিকল্পনা কমিশন কতটা প্রস্তুত?

এম এ মান্নান : পরিকল্পনার একটি তাত্ত্বিক প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক কোনো অর্থব্যবস্থা নয়। আমাদের অর্থনীতির ৮০ ভাগের বেশি বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। দিন দিন এটি আরও বাড়বে। সরকারের অবদান কমে আসবে। তবে সবকিছু ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। যেমন—শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত। এগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, কারণ কোটি কোটি মানুষ এখান থেকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা পেয়ে থাকে, যেটি বেসরকারি খাত থেকে আশা করা যায় না। আমার ধারণা ২০-২৫ বছর পরে বড় বড় কিছু খাত বাদে সবকিছু বেসরকারি খাতে চলে যাবে, যদি না সারা বিশ্বে রাজনৈতিক কোনো পটপরিবর্তন হয়।

কালবেলা : উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর আমাদের বৈদেশিক সহায়তা কমে যাবে, ঋণের সুদের হার বেড়ে যাবে। এসব চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করবেন?

এম এ মান্নান : অবশ্যই, এটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। তবে এটা কোনো ভয়ের বিষয় নয়, স্বস্তির বিষয়। আমাদের রূপান্তর এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে ঋণ থেকে আমরা সরে আসতে পারি। আমরা খয়রাতি ঋণ, স্বল্প সুদে ঋণ থেকে সরে আসছি। আগামী চার-পাঁচ বছরে আমরা খয়রাতি সহায়তার পর্যায়ে থাকব না। আমরা এখন দুই জায়গা থেকে অর্থ পাব—এক. আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থ আহরণ বাড়ছে এবং দুই. অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ বাড়াচ্ছি। আমাদের চেয়ে উন্নত রাষ্ট্রগুলো যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের সরকারের ঋণ অনেক বেশি। ঋণকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে উৎপানদশীল খাতে ঋণের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যে ঋণ করছি, তা শিক্ষা, বিদ্যুৎ, পানি, অবকাঠামো নির্মাণ খাতে ব্যয় করেছি। প্রতিটি খাত থেকে আমরা ভালো রিটার্ন পাব।

কালবেলা : উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্য বাড়ছে। এটা কমাতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে কেন?

এম এ মান্নান : জ্ঞানীরা বলে থাকেন, উন্নয়নের প্রথম দিকে বৈষম্য বাড়ে। এটা নাকি নিয়ম। আমাদের আগে যেসব দেশ উন্নতি করেছে, তারাও বৈষম্যের জ্বরে ভুগেছে। আমাদেরও এমন হবে। তবে এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। একটা পর্যায়ে গিয়ে সমতা আসতে শুরু করবে। এটা ভবিষ্যতের বিষয়। বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু আশার কথা হচ্ছে—দেশে অতিদরিদ্র কমেছে। ৪ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ এখন অতিদরিদ্র। এটা আমাদের জন্য বিরাট অর্জন। বৈষম্য এখন অনেক বেশি। কিন্তু অতিদরিদ্র থেকে আমরা বেরিয়ে আসছি।

কালবেলা : সরকার অর্থ পাচার বন্ধ করতে পারছেন না কেন?

এম এ মান্নান : পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ইচ্ছা আমাদের রয়েছে। কিন্তু প্রক্রিয়াটা এত সহজ নয়। কারণ আমরা একটা রাষ্ট্র, আবার যেখানে গিয়ে তারা আশ্রয় নিচ্ছে সেটাও একটা রাষ্ট্র। ওই দেশের আইনকানুন রয়েছে। ওখানে গিয়ে তারা নাগরিকত্ব পান। অনেকে পাসপোর্টও নিয়েছে। ওইসব দেশে আইনকানুন অনেক লিবারেল। তারা আহ্বান করে, আসুন টাকা নিয়ে; আমরা আপনাকে থাকার সুযোগ দেব, খাবার সুযোগ দেব। আপনাকে কিছুদিন পর নাগরিকত্ব দেব। যারা বাংলাদেশ থেকে টাকা চুরি করেছে, তাদের মনের ভেতরে ভয় আছে। এই টাকা নিয়ে তারা এখানে বসবাস করতে পারবে না। একসময় কেউ না কেউ ধরে ফেলবে। সুতরাং আগেভাগেই তারা পালিয়ে যায়। তারা আগে তাদের স্ত্রী-সন্তান পাঠায়। যখন মহাঝড় আসে, তখন চলে যায়। আমরা পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে চাই, কিন্তু আনার প্রক্রিয়াটা অনেক কঠিন।

কালবেলা : বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

এম এ মান্নান : আমরা যদি তাদের সুযোগ দিই, তাহলে তারা সুযোগ নেবেই। কেউ কেউ হয়তো ভালো মানুষ, তারা এ দেশের ভালো করতে চান। বন্ধু হিসেবে আসতে পারেন কিন্তু আমি যদি তাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসি, তবে তিনি অনধিকার চর্চা করবেনই। তারা এক ধরনের ক্ষুদ্র চিন্তা থেকে এগুলো করে থাকেন। প্রচলিত পথে বিরোধী দল সুবিধা করতে পারছে না। সুবিধা করতে পারার একমাত্র পথ হলো নির্বাচন। কিন্তু আপনি সেই নির্বাচন ঘর থেকে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে চাইছেন। আর তখনই প্রয়োজন হয় বিদেশি শক্তির। আমি তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এটা তাদের কাজ নয়। আমরা তাদের ডেকে আনছি।

কালবেলা : আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে আপনার প্রত্যাশা কী?

এম এ মান্নান : আমি চাই সুন্দর একটি নির্বাচন হোক। নির্বাচনে আমার একটা স্টেক আছে। আমি এ পর্যন্ত চারবার নির্বাচন করেছি। প্রথমবার স্বতন্ত্র হিসেবে, সেবার সামান্য ভোটে হেরেছিলাম। পরের তিনটিতে জিতেছি। ভালো ভোট পেয়েই জিতেছি। আমি আশা করি আগামী নির্বাচনেও আমি একইভাবে জিতব। পুরো দুনিয়ায় যত জ্ঞানী-গুণী রয়েছেন, তারা সবাই বলেন বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা, শান্তি-শৃঙ্খলা এবং ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুর্কিসহ অনেক দেশে স্থিতিশীলতা আর রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার জন্যই উন্নতি হয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১০

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১১

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১২

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৩

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৪

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৫

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

১৬

জুলাই বিপ্লবে আহত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বাবুকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড

১৭

মাদকাসক্ত ছেলেকে কারাগারে দিলেন মা

১৮

কপ২৯-এর এনসিকিউজি টেক্সট হতাশাজনক : পরিবেশ উপদেষ্টা

১৯

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নিরাপদ থাকবে যেসব দেশ

২০
X