অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলা ও বাঙালি, ভয় নাই ওরে ভয় নাই...

বাংলা ও বাঙালি, ভয় নাই ওরে ভয় নাই...

বাংলা ভাষার কি সত্যি দুর্দিন চলছে? এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে বলতে চাই–আপনি যদি গুগল সার্চ করেন, দেখবেন, জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ভাষার ভেতর বাংলা আছে পঞ্চম অথবা সপ্তম অবস্থানে। কোনো কোনো তথ্য সূত্র এটা নিয়ে মতান্তরে বিশ্বাসী হলেও সবাই স্বীকার করেন, বাংলা আছে প্রথম দশে। মেন্ডারিন, যা কিনা চায়নিজদের প্রধান ভাষা, তা আছে এক নম্বরে। স্প্যানিশ, ইংলিশ, ফ্রেন্স, হিন্দির পরই রয়েছে বাংলা। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন, লেখেন ও পড়েন। চাইলেই ভাষাটিকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এর জন্য কী করছি?

একটা কথা বলা যেতেই পারে যে, দেশের চেয়ে বিদেশে প্রবাসীদের ভেতর বাংলা চর্চা অধিক। প্রথমত দেশ ছেড়ে আসার বেদনা, আর পরে যোগ হয় সন্তানদের চিন্তা। নতুন প্রজন্ম যেন বাংলা ভাষা ভুলে না যায় বা পড়তে-লিখতে পারে, সেজন্য মা-বাবাদের আকুলতা দেখার মতো। দেশে যেমন অভিভাবকরা টাকা-পয়সা খরচ করে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন, বিদেশে ঠিক তার উল্টো। সপ্তাহান্তে বহু আশা ও বিনোদনের ছুটির দিনেও তারা বাচ্চাদের বাংলা পড়াতে, বাংলা শেখাতে নিয়ে ছোটেন। অনেক দূরে দূরে গিয়ে বাঙালিদের গড়ে তোলা বাংলা স্কুলগুলোতে বাচ্চারা পাঠ নেয়। এমন কোনো বিদেশে বসবাসরত বাঙালি পরিবারের দেখা মিলবে না, যাদের সন্তান বাংলা বোঝে না বা বাংলা বলতে জানে না। এই প্রাথমিক পাঠদানের পেছনে যে আবেগই কাজ করুক না কেন, আখেরে এতে আমাদের মাতৃভাষাই প্রাণ পায়। শক্তি খুঁজে পায় নবীন প্রজন্মে।

গবেষক ইফতেখার মাহমুদ লিখেছেন: জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়াত প্রবাসী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের পাশাপাশি মার্টিন কেম্পশেন বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ ও গবেষণা করেছেন। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের হান্স হারডার গবেষণা করেছেন চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার নিয়ে। তিনি প্রাচীনতম বাংলা কবিতা চর্যাপদ নিয়েও গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন।

পোল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এলভিয়েতা ওয়াল্টার বাংলা থেকে পোলিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ও বিভূতিভূষণ অনুবাদ করছেন। বেলজিয়ামের নাগরিক ফাদার দ্যতিয়েন গবেষণা করেছেন বাংলা ভাষার পুরোনো বই ও পাণ্ডুলিপি নিয়ে। সেসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে বাংলা ভাষায় রচনা করেছেন মৌলিক সাহিত্য। অতি সম্প্রতি ডেনমার্কের আলবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য বেঙ্গল স্টাডি সেন্টার খোলার প্রক্রিয়া চলছে।

অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাচর্চার সূচনা করেছিলেন লেখক ও চিন্তাবিদ আবু সায়ীদ আইয়ুব এবং শিবনারায়ণ রায়। তাদের প্রেরণায় মারিয়েন ম্যাডার্ন বাংলা গবেষণা ও অনুবাদে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশটিতে যেসব এশীয় ভাষা শেখার জন্য গুরুত্ব দিয়েছে, বাংলার অবস্থান তাতে তৃতীয়।

জাপানের এক অধ্যাপক ভারতে গিয়ে হিন্দি শিখেছিলেন। দিল্লিতে পড়াশোনা করার সময় তিনি বাংলার প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে বাংলা শেখা শেষ করে এখন তিনি টোকিওতে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক। এই যে টান এবং এই দায়–এর কারণ আছে। সে কথায় যাওয়ার আগে আমি প্রয়াত উইলিয়াম রাদিচের কথা বলব। আমাদের ভাগ্য আমরা তাকে চোখে দেখেছি। চট্টগ্রামে ফুলকিতে এসছিলেন রাদিচে। ঘরোয়া আড্ডায় তার কণ্ঠে বিশুদ্ধ বাংলায় জীবনানন্দ দাশ শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের। আমার ছেলে অর্ককে তিনি বাংলায় অটোগ্রাফও দিয়েছিলেন। কে এই রাদিচে?

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচনা অনুবাদের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে বাংলা শিখেছেন। পরে ওই বিভাগেই রাদিচে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপক তপন রায় চৌধুরীর অধীনে মাইকেল মধুসূদন দত্ত সম্পর্কে গবেষণা করেন। বাংলা ভাষা থেকে রাদিচের উল্লেখযোগ্য অনুবাদকর্মের মধ্যে রয়েছে Rabindranath Tagore: Selected Poems, Rabindranath Tagore: Selected Short Stories, Rabindranath Tagore: The Post Office, The Poem of the Killing of Meghnad প্রভৃতি। অনুবাদ করেছেন অন্যান্য ভাষা থেকেও। তার নিজের কবিতা, প্রবন্ধ ও সম্পাদনাকর্মও রয়েছে। তার পিতামহ ও পিতৃব্য ব্রিটিশ ভারতে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন।

এবার সাধারণ মানুষের কথায় আসা যাক। আমি বহুদেশ ভ্রমণ করেছি। ভ্রমণ আমার নেশা। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বাংলা জানেন এমন বলা মানুষের সংখ্যা কম নয়। হাওয়াই ও নমপেন বহুদূরের দুই শহর। একটি আমেরিকার অঙ্গরাজ্য, আরেকটি এশিয়ায়। উভয় দেশে আমি বাংলা জানা আমেরিকান আর কম্বোডিয়ানের দেখা পেয়েছি। মার্ট নামে ষাট বছরের যে মানুষটি, তার প্রেমিকাকে নিয়ে হাওয়াই এসেছিলেন তার বাংলা জানার কারণ রবীন্দ্রনাথ। গান শুনতেন কিন্তু ভাষা বুঝতেন না। এভাবেই শুরু। গানের কথা বুঝতে গিয়ে শিখতে শিখতে শান্তি নিকেতন ঘুরে আসা মানুষটি শুদ্ধ বাংলা জানেন। বলতে পারেন। কম্বোডিয়ার ভদ্রলোক বাংলা শিখেছেন ইতিহাস জানতে। যারা খবর রাখেন তাদের অজানা নয়, গৃহযুদ্ধ আর সশস্ত্র বিপ্লবের নামে কী পরিমাণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন সে দেশে। আমি যখন সে দেশে যাই তখন ৫০ বছরের ওপরে বয়স, এমন জনগোষ্ঠীর দেখা মেলাই ছিল ভার। নারীদের দেখা মিললেও পুরুষের দেখা মিলত না। কারণ পলপট এক জেনারেশনকে প্রায় পুরো নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সে যাই হোক, মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি ও আমাদের জান দেওয়ার ইতিহাস পড়তে গিয়ে বাংলা শেখা খেন খেমারাকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিল শুধু বাংলা প্রেমের কারণে।

আজ আমরা অনেক দূর চলে এসেছি। এক সময়ের অভাব-অনটন আর দরিদ্রতার দেশ নামে পরিচিত বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মাতৃভাষা তার মর্যাদা আর ভালোবাসায় অধিষ্ঠিত। কিন্তু ভাষার ওপর অত্যাচার বা তার বিরুদ্ধে থাকা মানুষের আক্রমণ কমেনি। এক সময় উর্দু আধিপত্যকে আমরা ভয় পেয়ে আন্দোলন করেছি। আমাদের অগ্রজরা প্রাণ দিয়েছেন। আজ আগ্রাসনের ধারা ভিন্ন। এখন মাথার ওপর ধর্মীয় ভাষা, ঘাড়ের কাছে হিন্দি। মগজে ইংরেজি। কোনো ভাষার বিরুদ্ধেই বলার কিছু নেই। বরং আমি আরবি, হিন্দি, ইংরেজি ভাষা ভালোবাসি। এই সেদিনও পাকিস্তানি এক নারীর সঙ্গে উর্দুতে কথা বলে দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। হিন্দি বলতে পারি বলেই ভাঙা উর্দুতে কথা হয়েছিল। ভাষার কোনো দোষ নেই। ভাষা পবিত্র এক মাধ্যম। সমস্যা হলো তাকে আত্মস্থ না করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। আমি কোনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র ছিলাম না। করপোরেশনের স্কুলে পড়া সাধারণ মানের ছাত্র। ইংরেজি ভাষার এই অস্ট্রেলিয়া দেশে আমার তো জীবনযাপনে কোনো সমস্যা হয় না। এমন হাজার হাজার বাঙালি দুনিয়ার নানা দেশে জীবনযাপন করছেন। ধীরে ধীরে নিজেদের তৈরি করে শান্তিতে আছেন। সমস্যা আগ্রাসনে। সমস্যা চাপিয়ে দেওয়া। যদিও বাঙালির ভাষা কেড়ে নেওয়া যায় না। সম্ভবও না। ওই যে মানুষগুলোর কথা লিখলাম, তারা এমনি এমনি বাংলা প্রেমে মজেননি। মজার মতো লালন ফকির, হাছন রাজা, মাইকেল মধুসূদন, বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, এস এম সুলতান আছেন বলেই মজেন। মজতে থাকবেন আজীবন। যেমন আবু সায়ীদ আইয়ুব। বাংলা না জানা মানুষ বাংলা জেনে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এমন লিখলেন যে, এখনো কেউ তা ডিঙাতে পারেননি। অথচ আইয়ুব তিন পুরুষ ধরে কলকাতায় বসবাস করেও বাংলা জানতেন না। ১৬ বছর বয়সে উর্দু পত্রিকায় গীতাঞ্জলি পড়ে মুগ্ধ হন তিনি। অতঃপর বাংলা বাঙালির জামাই গৌরী আইয়ুবের বর ও সাহিত্যে এক ইতিহাস।

ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের বাংলা প্রেম জাগে। বইমেলায় বইপুস্তক প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায়। যদিও ডিজিটাল বাস্তবতা এ বিষয়গুলোকে আঘাত করতে শুরু করেছে। মানুষ বিশেষত নবীন প্রজন্ম এখন মজে আছে, মজেই থাকে রিডার, অডিও, গল্প ভিডিও, কবিতায়। বাংলা গান ছবি সবকিছুতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যাই ঘটুক, যেভাবে ঘটুক, কোনোভাবেই যেন আমাদের মাতৃভাষার অপমান না হয়। ধর্ম ব্যবসায়ীরা হোক আর মজুতদার হোক, যেই তার চরিত্র হননের চেষ্টা করবে তাকেই যেন উপযুক্ত জবাব দিতে পারে বাংলা ভাষা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, সিডনি প্রবাসী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪৬তম বিসিএসের প্রিলি পরীক্ষা শুরু

দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে চালক ও সহকারী নিহত

তানজানিয়ায় বন্যা-ভূমিধসে নিহত ১৫৫

বিএনপি-জামায়াতের ৭ নেতাকর্মী কারাগারে

পাবনায় অগ্রণী ব্যাংকের ভল্ট থেকে ১০ কোটি টাকা উধাও, অতঃপর

প্রেম করে বিয়ে / ফ্ল্যাটে মিলল স্বামী-স্ত্রীর লাশ, পাশে ছিল চিরকুট

দিনাজপুরে ফিলিং স্টেশনে অগ্নিকাণ্ড, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা

ভারতের লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোট শুরু

ছুটির দিনটি কেমন যাবে আপনার?

এক রাতে ৫ সেচ মেশিন চুরি, বোরো ধান চাষে শঙ্কা

১০

টোল আদায় নিয়ে সংঘর্ষ, আহত ২৫

১১

ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ গেল মোটরসাইকেল আরোহীর

১২

দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

১৩

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধান বিরোধী নয় : হাইকোর্ট

১৪

আজ ৪৬তম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষা, যেসব নির্দেশনা মানতে হবে

১৫

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

১৬

২৬ এপ্রিল : নামাজের সময়সূচি

১৭

শুক্রবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৮

হাতি শুঁড় দিয়ে আছাড় মারল কৃষককে

১৯

বাবার বাড়ি যাওয়ায় স্ত্রীকে ২৭ কোপ দিলেন স্বামী

২০
*/ ?>
X